বিশ্বের বর্তমান  মুসলমান জনসংখ্যা ১.৯০ বিলিয়ন বা তার ও অধিক।  এই জনসংখ্যার অধিকাংশই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে বাস করে ।  ধার্মিক  হওয়া স্বত্তে ও  বর্তমান বিশ্বের মুসলমান আগের তুলনায় অনেক বদলিয়েছে।  ইসলাম ধর্মের প্রথম দিকের মুসলমান ছিল সৎ, ত্যাগী,উদ্যোগী, কঠোর পরিশ্রমী, নতুন আবিস্কারক এবং  ঈমানের তাজা শক্তিতে বলীয়ান। এক সময় পৃথিবীর অর্ধেক যথা এশিয়া,আফ্রিকা এবং ইউরোপ এদের রাজত্ব ছিল। দুঃখের বিষয় এ সব মুসলমান  বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিয়ে সবকিছু  হারিয়ে আজ দিশেহারা ।   বর্তমান মুসলমানের দুঃখ,দুর্দশা  এবং  চরম দুরবস্থা দেখলে চোখে পানি আসে। অনেক দেশেই মুসলমানরা খাদ্য়,বস্ত্র,আশ্রয় এবং স্বাস্থ্যহীন অবস্থার মধ্যে বাস করছে।

ইসলাম আধ্যাত্মিক  এবং নিয়ম কানুনের দিক থেকে  অধিক মর্যাদার ধর্ম।   এই ধর্মের  প্রথম বাণী “ইকরা বিসমি রাব্বিকা আল্লাজি খালাক” পড় তোমার পালনকর্তার নামে এবং তোমার স্রষ্টার নামে, যিনি বিশ্বজগতের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।  আধ্যাত্মিক দিক থেকে এই ধর্ম উচ্চ মর্যাদা বহন করে- এটা সর্বজন স্বীকৃত । যে কোনো ধর্মের চেয়ে এই ধর্ম সব চেয়ে বেশি কঠিন, সুষ্ঠ দৈনন্দিন নিয়ম-কানুন মেনে চলার নির্দেশ বহন করে  ।

ইসলাম ধর্মে   ৫ টি স্তম্ভ রয়েছে  তার প্রতিটিই অত্যধিক গুরুত্ব বহন করে- নিম্নে অতি সংক্ষিপ্ত বিবরন দেয়া হলো : 

 ১ ) ঈমান – মুখে স্বীকৃতি ও অন্তরে বিশ্বাস করা। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ…  এর বাংলা অর্থ হল, “আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ বা উপাস্য নেই এবং  মুহাম্মাদ তিনি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।”

২  ) নামাজ : এই ধর্মের প্রতিটি  লোককে দিনে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে নামাজের মাধ্যমে আল্লাহকে স্বরণ করতে হয়। আমরা কানাডার মতো দেশে বাস করি যেখানে মুসলমান সংখ্যালগিষ্ট।  এখানে ও টরন্টো শহরে প্রায় প্রতি মহল্লায় মসজিদ,মোসল্লাহ এবং টরন্টো ও উপ-শহরে মক্তব ও মাদ্রাসা  রয়েছে। প্রতি শুক্রবার মসজিদে বিভিন্ন দেশের মুসল্লিদের নামাজ জমাতে আদায় করার সুযোগ রয়েছে ।  এ দেশে প্রতিটি অফিস,কারখানা, হাসপাতাল,স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি  বা কাজের জায়গায় নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমান পুরুষ/নারী সময় মতো কাজ থেকে বিরতি নিয়ে নামাজ পড়ে ।  এ দেশে  দশ থেকে বিশটি পরিবার কোনো কমিউনিটি  বা মহল্লায় থাকলে একটি নামাজের মসল্লাহ বা মসজিদ করে নামাজ ও ধর্ম শিক্ষা করে। কানাডা খ্রীষ্টান সংখ্যাগরিষ্ট দেশ হওয়া স্বত্তেও প্রতিটি ধর্মের লোক নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারে।   ইউরোপ, আমেরিকা বা ব্রিটিশ দ্বীপেগুলিতে   প্রথম দিকে আফ্রিকা থেকে যে সব কালো লোকদের ক্রীতদাস হিসাবে  নিয়ে আসা হতো  -ওরা  সে যুগে ও রাস্তায় দাঁড়িয়ে আজান দিয়ে ২-৪ জন মিলে  জামাত করে নামাজ আদায় করতো বলে লিখিত  প্রমান পাওয়া যায়। আমি ১৯৮৬ সনে অত্যধিক শীতে নিউজার্সি খোলামাঠে আফ্রিকার কালো মুসলমানদের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়েছি।  কানাডার Yukun territory যেখানে সারা বৎসর বরফ থাকে,সেখানে ও  মসজিদ বা মসমসল্লাহ করে মুসলমান নামাজ পড়ে।  

৩  ) রোজা :  রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজ, যে যেখানেই থাকুক না কেন সূর্য উঠা থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত পানাহার এবং আত্মসংযমের  সাথে রোজা রাখার যে নিয়ম এটা অন্য্ ধর্মের জন্য চিন্তার বাহিরে। অন্য্ ধর্মের লোক অবাক হয়ে প্রশ্ন করে  “তোমরা কি ভাবে সারাদিন পানাহার না করে থাকো ? ” ইসলাম ধর্মে এটা সব চেয়ে বড়  সাধনা এবং পরিবার বা মসজিদে একত্রে সবাই মিলে ইফতারি করা  খুবই আনন্দের।  এখানে প্রতিটি মসজিদে প্রতিদিন ইফতারে ৫০০- ১০০০ লোক একত্রে খাওয়াদাওয়া করে।    টরন্টো ও তার উপ-শহরে  প্রতিটি মসজিদে দুই/তিন জন কোরান হাফেজ তারাবির নামাজ পড়ান এবং অনেকেই বিনা মজুরিতে (ভলান্টিয়ার ) হিসাবে পড়ান।  ৩০ পারা কোরান মুখস্ত রাখা এক বড়  সাধনা , তা চিন্তা করলেই বুঝা যায়।  ১৫০০ বৎসর পূর্বে এই কোরান জিব্রাইল ফেরেস্তার মাধ্যমে মুহাম্মদ (স:) নিকট আমাদের জন্য এসেছিলো এবং আজ পর্যন্ত একটি অক্ষর ও পরিবর্তন হয় নি।  রোজার শেষে সারা বিশ্বে ১.৯০ বিলিয়ন লোক একত্রে ঈদ (আনন্দ ) উদযাপন  মুসলমানদের জন্য একটা বড়  ধরণের উৎসব। 

৪  ) হজ্জ্ব :  বৎসরে একবার  সারা পৃথিবী থেকে  ২-৩ মিলিয়ন  আর্থিক সঙ্গতিপূর্ণ লোক মক্কা (সৌদি আরব)  হজ্জ্ব করতে যাওয়া এটা ও একটা বড়ো বিস্ময়কর ঘটনা;এত বড়  একত্রিত পূর্ণের কাজ যা অন্য্ ধর্মে দেখা যায় না।  তা ছাড়া এই দিনে সারা বিশ্বে প্রতিটি সঙ্গতিপূর্ণ লোক পশু কোরবানি দিয়ে হজরত ইব্রাহিম (আ: ) স্বরণ করে এটা ও এক  বিস্ময়কর  ।  

৫  ) যাকাত : পবিত্র কোরানে যাকাত সম্পর্কে (২.৫%) যে বিধান দেয়া হয়েছে তা গরিব -ধনীর  ব্যবধানের  সুন্দর ব্যবস্থা।  প্রতিটি  অবস্থাসম্পর্ণ ব্যক্তি তার ধন-সম্পদের  ২.৫% যাকাত বাধ্যতামূলক ও পবিত্র করার জন্য এ বিধান আল্লাহ দিয়েছেন।    

 প্রায় ১৫০০ বৎসর পূর্বে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব থেকে নানাহ বাধা-বিপত্তি, আর্থিক সংকট, যুদ্ধ-বিগ্রহ  অতিক্রম করে এই ধর্ম্ম আজ এ পর্যায়ে এসেছে।  

১ ) তৃতীয় বিশ্বের মুসলমান জাতি উন্নত বিশ্বের সাথে তুলনা করলে অনেক দিক থেকেই পিছিয়ে রয়েছে এবং এই পিছিয়ে থাকার কারণগুলি একটু বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন :  

অভাব : ক) সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান বিশ্বাস করে যে একজন দরিদ্র ব্যক্তি মৃত্যুর পর দ্রুত জান্নাতে প্রবেশ করবে  ;কারণ বেশি সম্পদশালী ব্যক্তি  পরকালে তাদের সম্পদের বিবরণ  দিতে হবে এবং জাহান্নামে যাওয়ার সম্ভবনা বেশি  ।  এ দুনিয়া হলো একমাত্র পরকালের পুণ্য সঞ্চয় করার জন্য, এখানে যে যত পুণ্য সঞ্চয় করবে, পরকালে তত সুখে থাকবে।  আমি এক আলেমের নাম শুনেছি, যিনি শুধু তিনটি মরিচ দিয়ে খাওয়া শেষ করতেন,  বলতেন “বেশি খাওয়া ও  বেশি  সুখে থাকলে পরকালে জবাব দিতে হবে। 

খ) অনেক  দেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি থাকায় জনগণকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হয় না।  ইসলামে মৌলবাদী,ধর্ম ও রাজনীতিকে একত্রিত করার জন্য গণতান্ত্রিক অগ্রগতির পথে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করে। 

  আফগানিস্তানে  তালেবান সরকার থাকাকালীন সময় মহিলাদের উপর কট্টর নীতি নির্ধারণ করে, যার ফলে মহিলারা  চাকুরিচ্যুত  হয় এবং বাহির থেকে অন্দরমহলে অবস্থান করতে বাধ্য করে।  স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের 

সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে। গরিব, ধনী নির্বিশেষে সবাইকে সমান  শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে কোনো জাতিকে উন্নতির দিকে নেয়া কঠিন।    

২ ) আইনের অপব্যবহার : সব দেশে আইন আছে; কিন্তু সব দেশে আইনের সঠিক প্রয়োগ নেই।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে আইনের অপব্যবহার একটি উদ্বেগের বিষয়।  আইন আছে তার সম- ব্যবহার নেই, তৃতীয়  বিশ্বজুড়ে কর্তৃপক্ষ ক্রমবর্ধমানভাবে বিক্ষোভ দমন করার জন্য বেআইনি শক্তি প্রয়োগ এবং দমনমূলক নীতি  অবলম্বন করে । এ সব করতে গিয়ে অনেক দেশে দুর্নীতিবাজ সরকার শেষ রক্ষা করতে পারে না, উচ্ছেদ হতে বাধ্য হয়।   

ক  ) সরকার প্রায়ই বিক্ষোভকারীদের দাবি অধিকারের পরিবর্তে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে, যার ফলে বেআইনিভাবে ছত্রভঙ্গ করা, গ্রেপ্তার, জেল -জরিমানা,মারধর এবং এমনকি বিক্ষোভের সময় হত্যাকাণ্ড ও  ঘটে। কিন্তু উন্নত দেশ যেমন কানাডা -এখানে বিক্ষোভকারী দল প্রধানদের সঙ্গে(পক্ষ-বিপক্ষ)  আলোচনা স্বাপেক্ষে দাবি-দাওয়া  মীমাংসা করা হয়।  

খ) বিক্ষোভকারীদের হয়রানি, ভয় দেখানো এবং শাস্তি দেওয়ার হুমকি,  প্রাণঘাতী অস্ত্র যেমন   টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ব্যবহার করে। 

গ) তৃতীয় বিশ্বে লাখ লাখ শরণার্থীর জীবন, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হইতেছে।

ঘ) মায়ানমার,সুদান,লিবিয়া,সিরিয়া,নাইজেরিয়া এবং আরও অসংখ্য দেশ অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের ফলে লক্ষ লক্ষ লোক আশ্রয়হীন,খাদ্য-বস্ত্র হীন অবস্থায় মারা যাচ্ছে এবং অনেকে খোলা আকাশের নিচে বাস করে।    

   ৩ ) মুসলমান ধর্মের লোক সারা বিশ্বে সব চেয়ে বেশি নির্যাতিত হচ্ছে।

ক) অধিকাংশ মুসলমান দেশে রাজতন্ত্র ও সামরিক শাসন জারি করে দেশ পরিচালনা করে। তাছাড়া  অদক্ষ জনপ্রতিনিধি দিয়ে দেশ পরিচালনা করে।  

 খ) সব কিছুতে ধর্ম টেনে আনা সঠিক  নয় ; ধর্ম মানুষের মনকে খারাপ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে।  কিন্তু ধর্ম মেনে অন্যায় কাজ করা অন্যায়। 

গ )   এই দুনিয়াতে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে হলে, জ্ঞান-গরিমায় অন্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। ধর্মে জ্ঞানার্জন করতে নিষেধ করা হয় নি বরং ইসলাম ধর্মে প্রথম বলা হয়েছে “ইকরা ” পড়ো ,জ্ঞান লাভ করো। 

ঘ )   নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যথা হিংসা,বিদ্বেষ ভুলে,নিজের এবং চারিপাশের পরিবর্তন করে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে  এগিয়ে যেতে হবে- তবেই  মুক্তি ।  আপনি একা অগ্রগতির শিখরে উঠে নিজে বাহবা নিলেন ,সবাই পিছনে পড়ে থাকলো, এতে আর কি লাভ ?  কে যেন  বলছিলো “সারা শরীরের রক্ত যদি মুখে এনে লাল করে দেখানো যায় ” -তাকে কি স্বাস্থবান  বলে ? 

সমাপ্ত   

পূর্ববর্তী নিবন্ধসন্দেহ
পরবর্তী নিবন্ধ“কানাডা-বাংলাদেশ ডায়াস্পোরা জীবন” বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান।
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন