Catalyst বা অনুঘটক শব্দটি শিখেছিলাম ছোটোবেলায় হাইস্কুলে রসায়ণ ক্লাসের প্রাক্টিকাল করার সময়। হাইর্ডোজেন এবং অক্সিজেনের সমন্বয়ে পানি তৈরির ক্ষেত্রে ম্যাঙ্গানিজ ডাই অক্সাইড অনুঘটক হিসাবে কাজ করে, অর্থাৎ সে নিজে অক্ষত থেকে অন্যের কাজ ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করে। তবে আজকে আমি কোনো রসায়নের কথা বলতে আসিনি। কথা বলবো একজন মানুষ-অনুঘটক সমন্ধে।

রসায়ণ জগতের মতো মাসনুষের মধ্যেও কিছু কিছু মানুষ আছে যারা নীরবে, অর্থাৎ ঢাক ঢোল না পিটিয়ে প্রতিনিয়ত অনুঘটকের কাজ করে যায়। এদের কাউকে কখনো কখনো চোখে পড়ে, আবার পড়ে না। তবে যুগে যুগে এই জাতীয় মানুষের আগমন ঘটেছে, এবং মানুষের বা পৃথিবীর উন্নয়নে এই জাতীয় মানুষের খুব দরকার।

আমার আজকের লেখার মানুষরূপী অনুঘটকের নাম অলোক দাস। কানাডাতে আসার আগে আমি কখনো উনাকে চিনতাম না, কিন্তু এখন উনি ভালো একজন বন্ধু। আমার কানাডাতে প্রথম পরিচিত বাংলাদেশী !! আমি যখন কানাডাতে প্রথম আসি তখন এখানকার অবস্থা এতো ভালো ছিল না, বা এতো বাংলাদেশিও ছিল না। জাতীয় বেকারত্বের হারও অনেক বেশি ছিল, আর সোশ্যাল মিডিয়ার কোনো নাম গন্ধও ছিল না।

আমি সদ্য ইউরোপ থেকে পড়াশুনা শেষ করে এখানে ইমিগ্রান্ট হয়ে এসেছি। তখনো কোনো বাংলাদেশিকে চিনতাম না। এক চাইনিজ ক্লাসমেট আমার জন্য একটি জেলখানার সেল জাতীয় ছোটো রুম ঠিক করে রেখেছিলো। এসেই একেবারে হতাশ !! কারণ ইউরোপে আমার স্টুডেন্ট ডর্মেটরিটি ছিল ৪ ষ্টার হোটেলের মতো। যাহোক তারপরেও আল্লাহর কাছে লক্ষ শোকর যে ওই চাইনিজ বন্ধু রুমের চাবি নিয়ে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে ছিল।

প্রথম প্রথম আমার পড়াশুনা এবং অভিজ্ঞতা অনুযায়ী চাকরির আবেদন করতে থাকলাম। কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারলাম, আমাকে একেবারে শুরু থেকে শুরু করতে হবে এবং কিছুটা আপগ্রেডও করতে হবে। ইতিমধ্যে জমানো অর্থ শেষ হতে চলেছে তাই ভাবলাম, যে কোনো ধরণের একটি সারভাইভাল জব আগে দরকার, তারপর লোন নিয়ে পড়াশুনা করা যাবে। আমি যেহেতু ইমিগ্রান্ট হয়ে এসেছিলাম এবং কিছু ক্যাশ সঙ্গে ছিল তাই আমি তখন সোশ্যাল এসিস্টেন্সেরও আবেদন যোগ্য ছিলাম না। যাহোক হটাৎ করে টরোন্টর কিং স্ট্রিট এ একটি রেস্টুরেন্টে ডিশ ওয়াশ অর্থাৎ গামলা পরিষ্কারের কাজের ইন্টারভিও কল পেলাম। কানাডাতে প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ।

ইন্টাভিউতে জিজ্ঞেস করলো আমার Previous Experience আছে কি না। আমি বললাম না আমি দেশে কখনো খাওয়ার পরে নিজের প্লেটও পরিষ্কার করিনি (গর্বের বিষয় না), তবে ফিনল্যান্ডে পড়শুনাকালীন সময়ে নিজের থালাবাসন নিজেই ধুয়েছি, সে জন্য মনে হয় আমার কোনো অসুবিধা হবে না। যাহোক তাদের লোক খুব দ্রুত দরকার ছিল, তাই আমাকে তারা চাকরিটি দিয়ে দিলো। কিন্তু কাজের ২/১ দিন যেতেই বুঝলাম আমি যে ডিশ ওয়াশ মনে করেছি এটি তা নয়। খুবই হতাশ এবং মন খারাপ লাগছিলো, এবং শেয়ার করার মতো কেউ ছিল না। বাসায় ফিরে টেলিভিশন দেখা, রেডিও শোনা যার লাইব্রেরিতে গিয়ে কানাডিয়ান সংস্কৃতি সমন্ধে কিছু পড়া এই ছাড়া আর কিছু ছিল না। কাজের ২/১ দিন বাদে ডিশ ওয়াশিং মেশিনের পাশে দাঁড়িয়ে পাইল-আপ করা থালবাসনের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিলাম। হটাৎ পিছন থেকে বাংলা একটি বাক্য শুনতে পেলাম। “ভাই আপনি কি বাংলাদেশী”. লোকটির সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা ছিল এবং বেশ হ্যান্ডসাম।

আমি যেন এক মধুর বাণী শুনলাম। পাশ ফিরে তাকিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলাম জি ভাই, আপনি। উনি বললেন আমি বাংলাদেশি, আমার নাম অলক দাস। বলে সুন্দর একটি ছোট হাসি। এর পর উনি আমার সমন্ধে জানলেন। এবং উনি বেলছিলেন, “আপনার ভাই ভালো পড়াশুনা আছে, দেখবেন আপনি ভালো কিছু করবেন, আমি নিশ্চিৎ। প্রথম হয়তো একটু কষ্ট হবে, তবে আমরা আছি ভাই”. ওই কথাগুলি আমার জন্য খুবই অনুপ্ৰণামূলক ছিল এবং এখনো আছে। হটাৎ করে যেন নুইয়ে পড়া কনফিডেন্সের পিলারটা আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালো। আলোকদা ওখানে আমার থেকে উপরের পোস্টে কাজ করতেন, অর্থ্যাৎ উনি ছিলেন প্রেপ-কুক। যাহোক উনি আমার একাকিত্বের কথা শুনে Jamison রোডে উনাদের বাসার ঠিকানা দিয়ে আমাকে যেতে বললেন।

আমি পরবর্তী ছুটির দিনে উনাদের বাসায় গেলাম। উনি ওখানে আরো কয়েকজন নিয়ে থাকেন। তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। উনারা সবাই মোটামুটি নতুন আসা, তবে আমার থেকে কিছুটা আগে, এবং সবাই রেস্টুরেন্টে কাজ করেন, আমার থেকে উপরের পোস্টে। তারপরেও উনাদের বাসার সকলেই আমাকে অনেক সমাদর এবং সম্মান করতেন। যাহোক আমি ওই কাজটি বেশিদিন করতে পারি নাই। এর পর অনেক কাজ, অনেক চ্যালেঞ্জ, অনেক ঝামেলা গেছে, কিন্তু আলোক দার ওই কথাগুলি সবসমই কানের মধ্যে বাজতো (ভালো কিছু অবশ্যই হবে) . আর তাই শত চ্যালেঞ্জও হাল ছাড়িনাই।

এরপর বেশ কয়েকবছর গেছে। অবশেষে Ryerson বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুটা পড়াশুনা শেষে আল্লাহর রহমতে পছন্দমতো একটি প্রফেশনাল চাকরি হয়। তারপর আর আল্লাহর রহমতে পিছে তাকাতে হয়নি। ওদিকে অলকদাও দীর্ঘদিন হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার পর বর্তমানে নিজেই একটি রেস্টুরেন্ট দিয়ে বৌ-বাচ্চা নিয়ে আল্লাহর রহমতে খুব ভালো আছেন। উনি বাড়ি নয়, জায়গা কিনে সেখানে বাড়ি তৈরী করেছেন। উনি অত্যান্ত পরিশ্রমী একজন লোক। আর সঙ্গে আছেন তার স্ত্রি বর্ণালী, যার সহযোগিতা না হলে অলকদার এতদূর আসতে বেশ কষ্ট হতো। উনারা দুজনই দুজনার। উনাদের সুন্দর দুটি ছেলে আছে। উনার রেস্টুরেন্টের নাম “চাটনি” Etobikoke তে Royal York এবং Bloor subway স্টেশনের কাছেই। শুধু নিজে ব্যাবসাই করছেন না, বরং কর্মসংস্থান করেছেন আরো ২/৪ জন মানুষের, একজন সফল উদ্যোক্তা।

এখন আসুন শুনি, আমি কেন উনাকে নিয়ে লিখতে বসেছি। আলোকদাকে জিজ্ঞেস করলে উনি বলবেন, না ভাই কি করেছি আপনার জন্য। উনি আসলে জানেন না উনার সেই প্রথম দিকের অনুপ্রেরণামূলক কথাগুলি এবং আমার একাকিত্ব সময়ের উনি এবং উনার বাসার অন্যদের সমাদর এবং ভরসা শুধু আমাকে নয়, বরং আমার মতো প্রায় শতখানেক লোককে তাদের কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। উনি এক্ষেত্রে নিজের অজান্তেই একজন খাঁটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন, এবং এই দেশে প্রথমে এসে আপনি কার কাছে পড়ছেন সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, জায়গামতো না পড়লে আপনার খবর আছে। উনিতো আলাহর রহমতে অনেক ভালো আছেন, কিন্তু উনার সেই সোযোগিতার প্রতিদান উনাকে না দিতে পারলেও উনার অন্যের জন্য কিছু করার Inspirationকে ভুলতে পারি নাই। ভেবেছিলাম যদি কখনো আল্লাহ সুযোগ দেন তাহলে চেষ্টা করবো আমার দায়িত্বটুকু করতে। আল্লাহকে অনেক ধন্যবাদ আমি সকলের দোয়ায় সেটি করতে পেরেছি এবং করে যাচ্ছি। ধন্যবাদ আলোকদা।

বিগত ১৩ বৎসর যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের প্লেসমেন্ট সুপারভাইস করছি, সাথে সরাসরি মেন্টরিং করেছি বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের ইমিগ্রান্ট প্রফেশনালদের। এই সংখ্যা ৫০ জন হওয়ার পরে গনা ছেড়ে দিয়েছি। যারা একসময় অড জব করে সরকারকে মাসে ২০০ ডলার ট্যাক্স দিতেন তারা এখন প্রায় মাসে ২০০০ ডলার ট্যাক্স দেন, পৌঁছে গেছেন তাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে। এই মানুষগুলিকে সহায়তা ছাড়া অন্নান্য যে এওয়ার্ড গুলি পেয়েছি সেগুলির পিছনে অবশ্যই আলোকদার অবদান অনস্বীকার্য। হয়তো উনি এগুলি জানেনও না। শুধু আমাকে নয়, উনি এভাবে আরও অনেককে নীরবে সহায়তা করেছেন। এজন্যই উনাকে আমি একজন নীরব অনুঘটক বেলেছি। আমার কঠিন সময়ে উনার অনুপ্রেণামূলক কথাগুলি এবং আন্তরিকতা আমার খুবই প্রয়োজন ছিল। উনার মাধ্যমে বিদ্যুৎ, বিভাষ, ভাস্কর বা তাপসের মতো আরও কিছু ভালো বন্ধুদের দেখা মিলেছে। সমাজে এই জাতীয় মানুষরূপী অনুঘটকের খুব প্রয়োজন। আশা করি আমরা যারা একটু পুরাতন তারা যেন নতুন কেউ বা নতুন আসা কোনো ইমিগ্রান্টকে হতাশার বাণী না শুনাই, তাদেরকে যেন ছোট করে না দেখি, তাদের সামনে যেন অহেতুক ফুটানি না দেখাই এবং ইতিবাচক কিছু না বলতে পারলেও যেন নীতিবাচক কিছু না বলি।

কমিউনিটির অনেকগুলি মানুষের দুঃসহ অবস্থার মধ্যে নিজে খুব বেশি ভালো অবস্থানে থাকার থেকে কমিউনিটির অনেক মানুষের ভালো অবস্থার মধ্যে নিজে মোটামুটি ভালো অবস্থানে থাকা অনেক ভালো। আমি প্রথম যখন এসেছিলাম তখন বাংলাদেশী খুব কম লোকজনকে কোনো অফিস আদালতে দেখতাম, কিন্তু আলাহর রহমতে এখন প্রফেশনাল কাজে কোনো অফিস আদালতে গেলে প্রায়ই বাংলাদেশিদের দেখতে পাই এবং তারা অনেক ভালো পজিশনে আছে। এটি কি একটি সুন্দর চিত্র নয়। আসুন আমরা সবাই যে যার অবস্থান থেকে আমাদের কমিউনিটির সবার জন্য সাধ্যমত সহযোগিতা করি।
অবশেষে আমি আলোকদার সুসাস্থ, আরও অধিকতর সাফল্য এবং তার পরিবারের জন্য শুভ কামনা করে শেষ করছি। আপনারা Etobicokeতে গেলে আলোকদার চাটনি থেকে ঘুরে আসবেন, কিছু না খেলেও অন্তত তাকে হেলো বলে আসবেন।
“I AM AN INDIVIDUAL BUT BUILT STRONGER WITH THE WELCOMING COMMUNITY.”
সবাই ভালো থাকবেন।
মুকুল।
টরন্টো।

১ মন্তব্য

  1. you are right.In Canada,he is one of my family’s best friends. In fact, we were able to settle here in Toronto well because of Alok da, his great wife-Bornali di. We are grateful to them. They are very cooperative.I wish Alok da and Bornali di all the best.

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন