অনেক দিন আগে টেলিভিশনে, ব্রিটেনের Channel 4 এ একটি সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। বিষয়বস্তু ছিল “How British Colonialism Destroyed India”। সাক্ষাৎকারে উপস্থিত ছিলেন ভারতের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, কূটনৈতিক এবং লেখক শশী থারুর। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শশী থারুরের একটি বিখ্যাত বই রয়েছে। নাম ”Inglorious Empire: What British Did to India ”। এটি মূলত ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনামলে ভারতকে লুন্ঠনের ইতিহাসের বিশ্লেষণ। সম্ভবত সেই কারণেই ইন্টারভিউয়ে তার ডাক পড়েছে। সেই ইন্টার্ভিউরের অনেক কিছুই এখন মনে নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি শশী থারুরের রাজনৈতিক বক্তব্য বা মতাদর্শকে সমর্থনও করিনা। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভুলতে পারিনি তার বক্তব্যের দুটি লাইন। নিজের ছেলে মেয়েকেও এখন এই লাইন দুটি শুনতে বলি। শশী থারুর নিজের অতীত ইতিহাস জানার গুরুত্ব সম্পর্কে তরুণদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “If you dont know where have you come from, how will you appreciate where are you going ?” ভাষান্তর করলে অর্থ দাঁড়ায় “তুমি কোন জায়গা থেকে উঠে এসেছো তা যদি না জানো, তাহলে বুঝবে কিভাবে কোথায় তোমার গন্তব্য ?” শিকড় বা স্বরূপের সন্ধানে মানুষের প্রচেষ্টা নুতন কিছু নয়। নিজের ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানার আগ্রহ মানুষের চিরন্তন। একটি জাতি বা সম্প্রদায় যখন তার নিজের ইতিহাস ভুলতে বসে অথবা অবজ্ঞা করে, তার শক্তি এবং স্বকীয়তার পতন তখন থেকেই শুরু হয়। আত্মপরিচয়ের সংকট তখন প্রবল হয়ে উঠে।
প্রবাসে এসে শিকড়ের সন্ধান অথবা নিজের উৎসের সাথে সম্পর্কিত থাকার বিষয়টি এক নুতন মাত্রা লাভ করে। বিস্মিত হয়ে দেখি এখানে কিছু সংখ্যক মানুষ মনে করেন যে শিকড় ফেলে এসেছি তার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রেখে লাভ কি। তার চেয়ে বরং নুতন দেশের নুতন সংস্কৃতির সাথে আপাদমস্তক মিশে গেলে তৈরী হবে নুতন ‘Self Identity’। ফেলে আসা জন্মভূমির সুখ দুঃখে তাদের কিছুই যায় আসে না। আবার অন্য দিকে দেখেছি প্রবাসে অনেক মানুষ নিজের বুকের ভিতর লালন করেন ছোট এক টুকরা বাংলাদেশ। এরাই সংখ্যাগরিষ্ট। জন্মভূমিতে বিরাজমান যেকোন চ্যালেঞ্জে তারা শংকিত হয়ে পড়েন আবার সামান্য অর্জনেও আন্দোলিত হন মনে ও মননে। চেতনা পূর্ণমাত্রায় জাগ্রত থাকলেও এখানেও আগ্রহ ও উদ্যোগ জনিত কিছু সীমাবদ্দতা লক্ষ্য করা যায়। একটি বাস্তব উদাহরণ দিলে হয়তো বিষয়টি পরিষ্কার হবে। Toronto District School Board (TDSB ) এ International Languages & African Heritage নামে আন্তর্জাতিক ভাষা শিক্ষার একটি কর্মসূচি চালু আছে যেখানে কিন্টারগার্টেন থেকে গ্রেড ৮ পর্যন্ত ছাত্ররা সপ্তাহে একদিন বিনা পয়সায় তাদের স্কুলে দুই ঘন্টার একটি ভাষা শিক্ষার ক্লাসে অংশ নিতে পারে। বলা বাহুল্য এর মধ্যে বাংলা ভাষা ও আছে। আমাদের ছেলে রাইফও প্রতি বুধবারের দুই ঘন্টার এই বাংলা ক্লাসে যায়। তার ক্লাসে সর্বসাকুল্ল্যে ছাত্র সংখ্যা পাঁচজন। রাইফের ক্লাসের পাশাপাশি অন্য দুটি ক্লাসের একটিতে তামিল এবং অন্যটিতে ম্যান্ডারিন ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়। বিপুল সংখ্যক ছাত্রের উপস্তিতিতে গম গম করে দুটো ক্লাস। দুটো ক্লাসেই ছাত্র সংখ্যা বাংলা ক্লাসের প্রায় তিনগুন। অথচ রাইফের স্কুলের আশে পাশে বসবাস করেন অনেক বাংলাদেশী। আমার কাছে বিষয়টি খুবই পীড়াদায়ক। আমরা বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা নিয়ে চায়ের কাপে তুফান তুলি। লং উইকএন্ডের দাওয়াতে বাড়িতে আমন্ত্রিত মানুষদের কুমার বিশ্বজিতের গান “একদিন বাঙালি ছিলাম রে” বাজিয়ে শুনাই, অথচ নিজের ছেলে মেয়েদের বাংলা ক্লাসে পাঠাতে অনীহা বোধ করি। বড়ই অদ্ভুত আমাদের মানসিকতা।
এমন এক সময় আসবে যখন হয়তো প্রবাসে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ভুলেই যাবে তাদের পূর্বপুরুষদের কীর্তিগাথা। জানবেও না কত সমৃদ্ধ এক ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে উঠে এসেছিলো তাদের বাবামা রা। হাজার বছরের সমৃদ্ধ এক ইতিহাস পড়ে থাকবে তাদের বিস্মৃতির আড়ালে। এই দায়ভার কার ? এই দায়ভার আমাদের, – আমাদের মতো বাবা মাদের। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের নয়। কারণ বিষয়টি তাদেরকে জানানোর, শিখানোর, উপস্থাপনের দায়িত্বটি আমাদেরই।
শিকড়ের অন্নেষণ করি বা নাই করি, মনে রাখা দরকার, এক শিকড়কে ভুলে গিয়ে আরেক শিকড়ের খুব বেশি গভীরে প্ৰোথিত হওয়া যায়না।