ট্রেনের সিটে বসে আছি চুপচাপ। শিকাগো থেকে মিসিগান গন্তব্য, এখানকার এম ট্রাক গুলো আমার কাছে এয়ার কানাডার চেয়ে ভালো লাগে । আরামে হাত পা মেলে বসে আসা যায় । আমার ঠিক সামনের সিটে বসা এক তরুণী মোবাইল ফোনে কথা বলছে অনবরত । প্রথমে খেয়াল করিনি আমি হেড ফোন কানে দিয়ে গান শুনছিলাম । মাঝে মাঝে দেখি মেয়েটা ইংলিশ থেকে বাংলায় কথা সুইচ করছে । মায়ের সাথে কথা বলছে ভাংগা বাংলায় আর বন্ধু বা অন্যকারো সাথে ইংলিশে , কথা চলার এক পর্যায়ে তাকে বলতে শুনলাম-
বিশ্বাস কর, অনেস্টলি বলতেছি- ওর সঙ্গে এখন আমার ব্রেক-আপ চলছে…। ওর মত বজ্জাত রে এতোদিন পাত্তা দিছি এই তো অনেক কিছু। এই তোর বিশ্বাস না হয় আমার স্ট্যাটাস দেখ ফেবু তে ,দেখ আমি সিংগেল । ফোন রেখে মেয়েটা কিছুক্ষন পর পর চোখ মুছছে । বুঝতে পারলাম মেয়েটার হৃদয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে ।মাকে ফোন করে আশ্বস্ত করছে সে ভালো আছে । আমার মনের মধ্যে কেমন যেন করে উঠল , আমারো এই বয়সের মেয়ে আছে , তাদের মুখ গুলো আমার চোখে ভাসছে । এত টুকু মেয়ে কি অবলীলায় কষ্টের কথা মাকে বলছে , বন্ধুদের বলছে । যে ছেলেটার সাথে সম্পর্ক ভাঙলও সে অন্য মেয়ের প্রেমে পড়েছে ।
আমার শিক্ষা গুরু এসব বিষয়ে আমার ছাত্র /ছাত্রী আর আমার মেয়েরা । এরা ব্রেক আপ হলে চকলেট কেক খায় ,ঘুরতে যায় , গান শুনে । আমি জিজ্ঞেস করি এই যে ব্রেক আপ হয় তাতে মনের উপর চাপ পড়ে না? পরে কিন্তু এটা নিয়ে পড়ে থাকলে কি চলবে ? তুমি ব্রেন দিয়ে জাস্টি ফাই করো ভালো উত্তর পাবে । মনকে শক্ত করো আর তোমার কন্ট্রোলে রাখো ।
মেয়েদের কাছে , ছাত্র/ছাত্রীদের কাছে যখন আমাদের সময়ের গল্প গুলি বলি ওরা হাসে আর ভাবে তোমারা ইম্ম্যাচিউর ছিলে । আমিও তাই বলি আমরা একবার পরলে সেই পরা থেকে আর উঠতেই পারতাম না । এই জেনারেশনের বুদ্ধির তারিফ করি । ভেঙ্গে পড়েনা পরিস্থিতির মোকাবেলা করে ।
আজকাল ব্রেক-আপ শব্দটা খুব শোনা যায়। অভিধানে ব্রেক-আপ শব্দের বাংলা করা হয়েছে অবসান, ছুটি, সাময়িক বিরতি ইত্যাদি। তরুণ-তরুণীরা যখন কারও সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের সর্বশেষ অবস্থা বোঝাতে এ শব্দটি উচ্চারণ করে- তখন বুঝতে হবে, তার হৃদয়রাজ্যের বাগানটির পরিচর্যা করত যে মালি, তাকে আপাতত ছুটি দেয়া হয়েছে। এটাকে বিরহ বলা যাবে কি? ভালোবাসার আগুন বুকে নিয়ে বিরহ পথ চলে। পথের শেষ হবে কখন- সেই অপেক্ষায় উন্মুখ থাকে। তরুণীর কথায় মনে হচ্ছে না- ব্রেক-আপ জিনিসটা যন্ত্রণাদায়ক কিছু।
বিরহ কতটা যন্ত্রণাদায়ক- যারা এর সংস্পর্শে এসেছেন, তারা ভালো বলতে পারবেন। তবে লোককাহিনী, গল্প-কবিতা-উপন্যাসে, নাটক-সিনেমা-গানে বিরহকাতর নর-নারীর যন্ত্রণার যে রূপ মূর্ত হয়ে উঠেছে- যুগে যুগে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, তা থেকে আমরা একটা ধারণা পাই। প্রচলিত কাহিনী এ রকম- মক্তবে পড়ার সময় ধনীর দুলালী লাইলির প্রণয়াসক্ত হয় এক ছাত্র। মাশুকের প্রতি আকর্ষণ তাকে এতটাই বিভোর করে- লোকজন প্রকৃত নাম বাদ দিয়ে তাকে ‘মজনুন’ নামে ডাকতে থাকে, যার অর্থ হচ্ছে প্রেমিক, পাগল ইত্যাদি। মজনুন থেকেই মজনু নামের উৎপত্তি, যাকে ছাড়া প্রেমের কাব্য অসম্পূর্ণ। পরবর্তী সময়ে মজনুর প্রেমের মূল্য না দিয়ে লাইলির পরিবার লাইলিকে অন্য একজনের সঙ্গে বিয়ে দিলে বিরহ-যাতনায় কাতর মজনু লোকালয় ছেড়ে নির্জনে চলে যান।
আমরা বা আমাদের পরবর্তী জেনারেশন একটা অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। সময়ের এই পরিবর্তন কে আমরা আশীর্বাদ হিসেবেই নিব। আমি যখন হাত বাড়ালেই দুনিয়া আমার পাচ্ছি , সেটা থেকে নিজেকে বঞ্চিত ক রতে চাই না। একটা সমাজের চরম উত্থান হয় কিছু পতনের মধ্য দিয়ে সেই সময় এটা একদিন অবশ্য ই স্থিতি হবে বেশ কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।
এই চরম অস্থির সময়ে আমরা হয়ত আর লাইলী মজনু চাই না , আবার ভালোবাসা ষ্টেশনে থেমে থেমে ব্রেক দিয়ে এগিয়ে যাক তাও চাই না ।
এর ই মধ্যে মেয়েটির সাথে আমার কিছু কথা হয়েছে আমি ওর পাশের সিটে বসেছি অনুমতি নিয়ে। ওর নাম তরু। ইউনিভার্সিটি র ১ ম বর্ষ শেষ করেছে। এই ছেলে টা ইটালীয়ান ক্লাশ ইলেভেন থেকে প্রেম যাকে বলে হাইস্কুল সুইট হার্ট। একই ভার্সিটিতে পড়ে।
আমি জানার চেষ্টা করছিলাম তার কথা থেকে কি কি কারনে এখানে ব্রেক আপ হতে পারে। তরু বললো আমি আমার কারন টা বলি শুনেন, আমি ছেলেটাকে প্রচন্ড ভালোবাসি আর আমার পরিবার বাংগালী আর মুসলিম ছাড়া অন্য কাওকে এক্সপেট করবে না। আমি বললাম তোমারা আরো সময় নিতে অনেক কিছু সহজ হয়ে যেত। সে বললো এই ছেলেটা আমাদের বাসায় গিয়েছিল আমার বাবা ঢুকতে দেয়নি। আর আমার মায়ের কিছু বলার নেই যদিও মা চান আমি সুখী হই। আর সেই থেকে ছেলেটা সরে যায়। অন্য রিলেশনশিপ এ জড়িয়ে পড়ছে।
আমি স্কুলে কাজের সুবাদে জানি এখানে ব্রেক আপ এবং ডিভোর্স হয় খুব ছোট্ট কারনে।
কেউ যদি বলে আমি তোমাকে আর ফিল করছি না, এখানেই শেষ হতে পারে অনেক দিনের সম্পর্ক। কিন্তু যতক্ষণ একসাথে থাকে অনেস্টি নিয়েই থাকে। আর প্রেমের ক্ষেত্রে অবশ্য ই থার্ড পারসন ঢুকে। আবার কোন অসর্তক মুহুর্তে মেয়েটা প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলে ছেলেটা ভয়ে হোক বা দায়িত্ব নিতে অপারগ হোক কেটে পরে। বোঝা পড়া ঠিক হবে না জানলে দুজনে মিউচুয়াল ব্রেক আপ করে, সেক্ষেত্রে বন্ধুরা থাকে এক টা গুড বাই কার্ড সাইন করে।
তরুর কাছে আরো অনেক কিছু জানলাম কিভাবে এই কঠিন সময় সে মোকাবেলা করেছে। সে আমাকে বললো, “নো ম্যাটার হট সাপোর্ট ইউর চাইল্ড ” যেটা আমার মা করছে আমাকে। আর আপনি নিশ্চ্য় ই আমাদের বাংগালী বাবাদের মানসিক তা জানেন, সন্তান কিছু খারাপ করলেই মায়ের দোষ।
আমরা ডেট্রয়েট মিশিগানে এসে নামলাম , মেয়েটা তখন অনেকটাই সামলে উঠেছে , আমি কাছে যেয়ে বললাম তরু তুমি সাহসী মেয়ে , যুক্তি দিয়ে হৃদয় কে চালাও তোমাদের দিয়ে হবে ।
তরুর চোখে জল , আর আমিও পরবর্তী ট্রেনের জন্য স্টেশনে নেমে গেলাম । যাবার আগে তরু বললো, আপনি বাংগালী মেয়েদের জন্য একটা মেসেজ দিতে পারবেন , আমি বিস্ময় নিয়ে তাকালাম ! বললো যত ঝড় ই আসুক জীবন একটাই বাচতে শিখো, নিজেকে ভালোবাসো “খবরদার মেয়ে আত্মহত্যা করবে না ” ।