টরন্টো থেকে:-
তখন ১৯৯৫ সাল। পি আর ও হিসেবে কৃষি মন্ত্রনালয়ে তিন বছর কাজ করছি। কৃষি মন্ত্রনালয় একটি বড় মন্ত্রনালয়। অনেক দফতর পরিদফতর আছে ঢাকা ও গাজীপুরসহ দেশের অন্যান্য স্থানে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর,কৃষি উন্নয়ন কর্পরেশন,কৃষি গবেষণা কাউন্সিল ,কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ,ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ,বীজ সম্প্রসারণ পরিদফতর ,তুলা উন্নয়ন পরিদফতর ইত্যাদি আরো দফতর / সংস্থা আছে এ মন্ত্রনালয়ের অধীনে। এ সকল দফতর / পরিদফতরের কর্মকর্তাদের জন্য প্রতিমাসেই দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে স্কলারশিপ এবং স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী শিক্ষা / প্রশিক্ষণের সুযোগ দেয়া হয়। সেকারণে বছরের প্রায় সব সময়েই কৃষি মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তাগণ বিদেশে যান বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা / প্রশিক্ষণের জন্য।
এ নিবন্ধে আমার যুক্তরাজ্যে একশত দিনের একটি প্রশিক্ষণে যাওয়া ও এতদসংক্রান্ত অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করব। ১৯৯৫ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর কর্মকর্তাদের প্রায় পঞ্চাশ জনের একটি বড় দলের যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন মেয়াদের প্রশিক্ষণের জন্য মন্তনালয়ে প্রস্তাব আসে। এ সকল প্রশিক্ষণের মধ্যে কোনো কোনটি যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন কলেজ / বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় মাস / চার মাস / তিন মাস ও এক বসরের ডিপ্লোমা কোর্সের প্রোগ্রামও ছিল। অধিদফতর / পরিদফতরের এ সকল প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে সংশ্লিষ্ট দফ্তরের কর্মকর্তাগণ ছাড়াও কৃষি মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য একটা নির্ধারিত কোটা থাকে। মন্ত্রী মহোদয় এসব কর্মকর্তাদের মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। সাধারণত মন্ত্রনালয়ের সচিব মহোদয় যে সব কর্মকর্তার নাম প্রস্তাব করেন তাতে বিশেষ কোনো কারণ না থাকলে মন্ত্রী মহোদয় অনুমোদন দিয়ে থাকেন।
মন্ত্রী ও সচিব মহোদয়ের বাক্তিগত কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেও মন্ত্রনালয়ের কোটায় এসকল প্রশিক্ষণের সুবাদে বিদেশে যাবার সুযোগ পেয়ে থাকেন। ইতোমধ্যে মন্ত্রী মহোদয়ের একান্তসচিব ,সচিব মহোদয়ের একান্তসচিব ও মন্ত্রনালয়ের অনেক সিনিয়র সহকারী সচিব / সহকারী সচিব বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় বিদেশে ঘুরে এসেছেন। এবার আমার পালা। তাই অনেকটা আশা নিয়ে অপেক্ষা করছি। কিন্তু আমার আশা নিরাশায় পরিনত হল যখন দেখলাম যে প্রশিক্ষণে যাবার জন্য নথিতে যে সব কর্মকর্তাদের নাম এসেছে তাতে আমার নাম নেই। আমার পরিবর্তে এমন সব কর্মকর্তার নাম প্রস্তাব করা হয়েছে যারা ইতিমধ্যে আরও দু’ তিনবার বিভিন্ন প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ সফর করে এসেছেন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শাখার সহকারী সচিবের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম সে যুগ্মসচিব সাহেবের পরামর্শ মতে নথিতে প্রস্তাবনা তৈরী করেছে। তার সাথে আর কথা না বাড়িয়ে আমি মন্ত্রীর দফতরে ফিরে বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রীর পি এস (একান্তসচিব) সাহেবের সাথে কথা বললাম। তিনি বললেন ,মন্ত্রী মহোদয়ের টেবিলে এ নথি পেশ করার আগে তুমি ” স্যার ” কে বিষয়টি জানাও।
সেমতে আমি একদিন সুযোগ মতো মন্ত্রী মহোদয়ের কক্ষে ঢুকে বিষয়টি তাকে জানালাম। তিনি বললেন, তোমাকে বাদ দেয়ার কোনো সুনিদৃষ্ট কারণ আছে নাকি? আমি, বললাম না স্যার। মন্ত্রী মহোদয় বললেন, ঠিক আছে নথিটি আমার কাছে আসুক,তখন দেখা যাবে।
এর দু’এক দিনের মধ্যে নথিটি মন্ত্রনালয়ের সচিবের দফতর হয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের দফতরে এলো। যথারীতি সেটি মন্ত্রী মহোদয়ের কক্ষে তার অনুমোদনের জন্য পেশ করা হলো। ঐদিন বিকালে আমি পি আই ডিতে গেছিলাম মন্ত্রী মহোদয়ের একটি নিউজ রেডি করে সংবাদ মাধ্যমে পাঠানোর জন্য। এসময় মন্ত্রী মহোদয়ের পি এস সাহেব সংবাদ কক্ষে ফোন করে আমাকে বললেন, তোমার জন্য সু সংবাদ আছে, তাড়াতাড়ি অফিসে আসো ! আমি তড়িঘড়ি করে নিউজটি রেডি করে ডিউটি অফিসারকে দিয়ে মন্ত্রীর দফতরে ফিরে এলাম এবং সরাসরি পি এস সাহেবের রুমে ঢুকলাম। আমাকে দেখে তিনি হেসে দিলেন এবং বললেন ,মিষ্টি টিষ্টি আনো, মন্ত্রী মহোদয় তোমাকে যুক্তরাজ্যে ট্রেনিং এ পাঠানোর জন্য নথিতে অনুমোদন দিয়েচেন! আমি বললাম,অবশ্যই মিষ্টি খাওয়াবো, নথিটি কি আমি একটু দেখতে পারি? তিনি বললেন, কেন নয় ? নথিটি তার টেবিলেই ছিল। তিনি সেটি আমাকে দেখিয়ে দিলেন। আমি নথিটি খুলে দেখলাম কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পয়তাল্লিশ জন কর্মকর্তা ও মন্ত্রনালয়ের পাঁচ জনসহ মোট পঞ্চাশ জন কর্মকর্তার নাম প্রস্তাব করা হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদের প্রশিক্ষণের জন্য। মন্ত্রনালয়ের পাঁচ জনের মধ্যে একজন উপসচিব,দুজন সিনিয়র সহকারী সচিব ও দুজন সহকারী সচিবের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। মন্ত্রী মহোদয় মন্ত্রনালয়ের ঐ পাঁচজনের মধ্যে থেকে তালিকার প্রথমে উল্লেখকৃত উপসচিবের নাম লাল কালির কলম দিয়ে কেটে মোটা নীল কালির কলম দিয়ে আমার নাম লিখে নথিতে অনুমোদন করে সচিব মহোদয়কে মার্ক করে দিয়েছেন।
বিষয়টি দেখে গর্ব ও মন্ত্রী মহোদয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মনটা ভরে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী মহোদয়ের কক্ষে ঢুকে তাকে সালাম দিয়ে আমার খুশির কথা তাকে বললাম। তিনি বললেন, যাও, এবার ট্রেনিং এ যাবার প্রস্তুতি শুরু কর। তবে যাবার আগে আমার পাবলিসিটির কাজকর্ম দেখার জন্য বাংলাদেশ টেলিভিশন ও পি আই ডি’তে বলে দিয়ে যেয়ো। আমি বললাম, অবশ্যই স্যার, আপনার পাবলিসিটির কোনো হাম্পার হবেনা।
অল্প কয়েকদিনের মধ্যে এতদসংক্রান্ত মন্ত্রনালয়ের আদেশ জারী হলো। আমাকে যে বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনয়ন দেয়া হযেছে সেটা হলো “MONITORING OF PUBLIC SECTOR PROGRAMMES AND PROJECTS” ।এ কোর্সটি বারো সপ্তাহবাপী এবং এটি অনুষ্ঠিত হবে যুক্তরাজ্যের নরউইচ শহরের “UNIVERSITY OF EAST ANGLIA” তে। ব্রিটিশ কাউন্সিল এ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির যাবতীয় কাজকর্ম সমন্বয় করবে বলে মন্ত্রনালয়ের আদেশে জানতে পারলাম। সেখানে ‘IELTS’ পরীক্ষা দিতে হবে অথবা যুক্তরাজ্যে যেয়ে ইংলিশ লাঙ্গুয়েজ স্কুলে চার সপ্তাহের লাঙ্গুয়েজ কোর্স করতে হবে মূল ট্রেনিং কোর্স শুরুর আগে। ব্রিটিশ কাউন্সিলে একদিন যেয়ে বললাম ,আমি এখানে ‘IELTS’ পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নেয়ার সময় পাব না। মন্ত্রী মহোদয়ের পাবলিক রিলেশনের কাজে আমাকে ব্যাস্ত থাকতে হয়। তাই আমি যুক্তরাজ্যে পৌছে ইংলিশ লাঙ্গুয়েজ কোর্স করতে চাই। ব্রিটিশ কাউন্সিলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বললেন ,কোনো সমস্যা নাই ,তবে মূল কোর্স শুরুর একমাস আগে যেয়ে লাঙ্গুয়েজ কোর্সে যোগদান করতে হবে। তিনি বললেন, আগামী জুলাই মাসের মাঝামাঝি আপনার মূল কোর্স শুরু হবে। আপনার সাথে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের শমশের আলী সাহেবও এই কোর্স এ মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনিও ব্যাস্ততার কারণে এখানে ‘IELTS’ করতে পারবেন না। কাজেই আপনারা দুজনে একসঙ্গে গেলে সব কিছু একসাথে করতে পারবেন। তার অফিসে একজন মোটাসোটা ও দাড়িওয়ালা বয়স্ক লোক বসা। তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাকে শমশের সাহেবের সাথে। মনটা একটু দমে গেল। শেষ পর্যন্ত এ রকম একজন লোক আমার পার্টনার! পরে অবশ্য ফিল করেছি যে শমশের সাহেব পার্টনার হিসেবে সুব একটা খারাপ ছিলেন না।
ব্রিটিশ কাউন্সিলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বললেন, হাতে সময় খুব বেশি নাই। আগামী জুন মাসের বারো তারিখে নরউইচের একটি লাঙ্গুয়েজ স্কুলে ক্লাস শুরু হবে। চার সপ্তাহবাপী ঐ কোর্স শেষ হলে IELTS করে জুলাই মাসের চৌদ্দ তারিখে আপনারা মূল ট্রেনিং কোর্সে যোগদান করতে পারবেন। তিনি বললেন, এই সময়ের মধ্যে প্রস্তুতি নিয়ে রওয়ানা হতে পারবেন কিনা। শমশের সাহেব ও আমি বললাম, কোনো সমস্যা নাই। আমি বললাম, আপনি প্রসেস শুরু করতে পারেন। তিনি আমাদের বসতে বলে বেরিয়ে গেলেন। এ সময়ের মধ্যে আমি ও শমশের সাহেব পরস্পরেরে সাথে আলাপ করে নিলাম।
ঘন্টাখানেক পরে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তার রুমে ফিরে এলেন। তার হাতে কয়েকটা এনভেলোপ দেখলাম। তিনি বললেন ,আমাদের পাসপোর্ট আছে তো ? আমি বললাম, আছে। শমশের সাহেবও জানালেন তারও আছে। তিনি এনভেলোপ গুলি একে একে আমাদের হাতে দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন কোনটা আগামীকাল ভিসার জন্য ব্রিটিশ হাই কমিশনে,কোনটা লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরে ও কোনটা ভিক্টোরিয়া রেল স্টেসনে ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রতিনিধিকে দিতে হবে। এ সব চিঠিতে আমাদের যাতায়াত ও অনন্য বিষয়ের নির্দেশনা দেয়া আছে। তিনি বললেন , ভিসার জন্য আগামীকালই পাসপোর্ট জমা দিতে হবে বেলা দশটার মধ্যে এবং বিকাল পাঁচটার মধ্যে সেটা ডেলিভারি নিতে হবে। তিনি বললেন ,আগামীকাল ভিসা পাওয়ার পরে তাকে যেন জানানো হয়। তিনি সেমতে লন্ডন ব্রিটিশ কাউন্সিল , নরউইচ লাঙ্গুয়েজ স্কুল ও ইউনিভার্সিটি কে আমাদের বিষয়ে জানাবেন। পরদিন কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়াই বিকালে ভিসাসহ পাসপোর্ট ফেরত পেলাম। ঐদিনই অফিসে যেয়ে মন্ত্রী মহোদয় ও অন্যান্য সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলাম।
৯ই জুন রাত ন’টায় ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজের বিমানে করে লন্ডনের পথে রওয়ানা হলাম। লন্ডনে যাবার পথে শমশের সাহেবের কাছে জানতে পারলাম এটা তার প্রথম বিমানে ভ্রমন ও বিদেশ সফর। তার ইংরেজীর জ্ঞান আমার থেকেও কম। তাই তিনি আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়া ও তাকে গাইড করার জন্যও অনুরোধ করলেন। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম। আমি নিজেও এর আগে ইন্ডিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশে যায়নি। তাই কিছুটা শংকা আমার মধ্যেও ছিল।
যাইহোক, দিল্লী হয়ে লন্ডন পৌছালাম সেখানকার সময় পরদিন ভোর ছ’টায়। লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরে নেমে আমাদের চোখ একেবারে ছানাবড়া ! বিমান বন্দরের বিশাল টার্মিনাল ভবন ও আর সব কিছু দেখে আমরা দিশেহারা! কিভাবে লন্ডন থেকে নরউইচ যাব বা কোথা থেকে ট্রেন / বাস পাবো এবং কোথায় যেয়ে থাকবো এসব নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। তাড়াহুড়ার কারণে আসার সময় এসব বিষয় ব্রিটিশ কাউন্সিলের ঐ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারি নাই।
তবে আমাদের এ ভয় বা শংকা অনেকটা দূর হয়ে গেল যখন দেখলাম ইমিগ্রেশন কাউন্টারের বাহিরে ব্রিটিশ কউন্সিলের একজন প্রতিনিধি হাতে একটা প্লাকার্ড / সিম্বল নিয়ে দাড়িয়ে আছে। তাতে আমাদের নাম লেখা। তাকে পরিচয় দিয়ে ঢাকা ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে দেয়া এনভেলোপ তার হাতে দিলাম। সে সেটা একনজর দেখে আমাদের বললেন,ফলো মি। সে আমাদের এয়ারপোর্টের বাহিরে নিয়ে আসলো ও তার গাড়িতে করে রওযানা দিল। শমশের সাহেব মুগ্ধ নয়নে ও একাগ্রমনে গাড়ির জানালা দিয়ে লন্ডন শহর দেখতে লাগলেন। আমিও দেখছি। ছোটকাল থেকে জেনে এসেছি উন্নত জীবনযাত্রা ,জ্ঞান গরিমা ও সান সওকাতের দিক থেকে লন্ডন বিশ্বের সেরা শহর। অনেক স্বপ্ন দেখতাম লন্ডন আসার জন্য। আজ আল্লাহ সেই স্বপ্ন পূরণ করলেন। এজন্য আল্লাহের কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম মনে মনে। আমাদের গাইড চুপচাপ ও একমনে গাড়ী ড্রাইভ করছিলেন। একসময় তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,আমরা কোথায় যাচ্ছি ? সে বললো ,আমরা এখন ভিক্টোরিয়া স্টেসনে যাব। সেখানে আমাদের ব্রিটিশ কাউন্সিল কাউন্টারে যেয়ে ট্রেনের টিকেট, টাকা ও অন্যান্য নির্দেশাবলী পাবো। প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট পরে আমরা ভিক্টোরিয়া স্টেসনে পৌছালাম। সে আমাদের ব্রিটিশ কাউন্সিলের কাউন্টারে পৌছে দিয়ে চলে গেল। কাউন্টারের প্রতিনিধি তখন অন্যান্য দেশ থেকে আগত কয়েকজন প্রশিক্ষনার্থীর সাথে কথা বলছিলেন। একসময় আমাদের ডাকলেন ,এবং আমাদের কাগজপত্র চাইলেন। আমরা ঢাকা থেকে প্রাপ্ত এনভেলোপ তাকে দিলাম। তিনি সেটি পড়ে আমাদের অপেক্ষা করতে বললেন। এ সময়ের মধ্যে আমরা ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে আবার ডাকলেন ও সেইসাথে একটি ট্রেনের টিকেট, নগদ সাতশত পাউন্ড ও একটি এনভেলোপ দিয়ে বললেন ,একটু পরে তোমাদের ট্রেনে তুলে দেব। তোমরা ঐ ট্রেনে লিভারপুল স্টেসনে নেমে আর একটি ট্রেনে করে নরউইচ যাবে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে সে আমাদের প্লাটফর্মে নিয়ে এলো ও একটি ট্রেনে তুলে দিয়ে চলে গেল। ট্রেনটি বিশ মিনিট পরে লিভারপুল স্টেশনে পৌছালে আমরা নেমে গেলাম। তখন বেলা প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। শমশের সাহেব যেন মুখে কুলুপ এটে দিয়েছেন ! সেই যে হিথ্রো নামার পর থেকে চারিদিকে মুগ্ধ চিত্তে সব কিছু দেখছেন তো দেখছেনই, কোনো টু শব্দ নেই ! তবে সব সময় আমার গায়ের সাথে আটার মত লেগে রয়েছেন ! লিভারপুলে নেমে আমি বললাম,কি ভাই ,খাওয়া দাওয়া কিছু লাগবে না ? নাকি চারিদিকের দৃশাবলী দেখে পেট ভরবেন ? আমার কোথায় তিনি যেন বাস্তবে ফিরে এলেন। বললেন, হাঁ পিআরও সাব , কিছু না খেলে এখন আর চলবে না। তাকে নিয়ে স্টেশনের একটি ফাস্ট ফুডের দোকান থেকে হালকা কিছু খেয়ে নিলাম। দু’জনের খাবার বিল হলো প্রায় বারো পাউন্ড। তিনি বললেন,দেখলেন পিআরও সাব, কি ডাকাত এরা ? সামান্য দু’পিচ পাউরুটি ও ডিম ভাজির জন্য বারো টাকা অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকার প্রায় এক হাজার টাকা ? আমি বললাম, এটা তো হবেই ,যে দেশের যে দাম, তা নিয়ে হিসেব করলে চলবে ?
আরো পনের মিনিট পরে নরউইচ গামী ট্রেন প্লাটফর্মে এলো। আমরা নির্ধারিত বগী ও সিট নিয়ে বসলাম। ইতোমধ্যে টিকেট দেখে জানতে পারলাম লন্ডন থেকে নরউইচ একশত চৌদ্দ মাইল। একজন পাসেন্জারকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম নরউইচ যেতে একঘন্টা চল্লিশ মিনিট সময় লাগবে।
ট্রেন লন্ডন ছেড়ে বিস্তীর্ণ সবুজ ফসলের মাঠ ও ক্ষেতের মধ্য দিয়ে যেতে লাগলো। এ সময়টা এদেশের সামার বা গ্রীষ্মকাল। তাই মাঠে প্রান্তরে ফুল ও সবুজের ছড়া ছড়ি। মুগ্ধ নয়নে সেসব নয়নাভিরাম দৃশাবলী দেখতে দেখতে চলছি। একসময় শমশের সাহেব বললেন,আমার কি মনে হয় জানেন পি আর ও সাব ? আমাদের দেশের কবি সাহিত্যিকরা আসলে অজ্ঞ, তাদের বহিবিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান খুবই সামান্য। তাদের কেউ কেউ দেশ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সুজলা সুফলা সশ্য শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ’ অপর একজন লিখেছেন ,’ধন্যে ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এ বসুন্ধরা…………’। তারা কখনো এসব দেশে আসে নাই তাই ঐ রকম লিখেছেন। এ দেশে আসলে তাদের ধারণা পাল্টে যেতো। আপনার কি মনে হয় ? আমি বললাম, সম্ভবত আপনার কথাই ঠিক। এ দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যই উপভোগ করার মত। সেটা হয়তো আমাদের কবি সাহিত্যিকদের অনেকেরই জানা নাই।
বেলা সাড়ে বারোটার সময় ট্রেন নরউইচ স্টেশনের প্লাটফর্মে এসে দাড়ালো। ট্রেন থেকে নেমে আমরা ব্রিটিশ কাউন্সিলের একজন প্রতিনিধি কে দেখতে পেলাম ব্রিটিশ কাউন্সিলের সিম্বল হাতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের পরিচয় সম্বলিত এনভেলোপ পেয়ে সে আমাদের নিয়ে তার গাড়িতে উঠলো। সে আমাকে রোয়িংটন রোডের এগারো নম্বর বাড়িতে নামিয়ে দিল এবং বলল মিসেস কাথরিন আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আপনার ইংলিশ লাঙ্গুয়েজ কোর্স চলাকালীন আপনি তার বাড়িতে থাকবেন। চার চপ্তাহ পরে আপনার কোর্স শেষ হলে আপনাকে ইউনিভার্সিটির টেরেস / হোস্টেলে নিয়ে যাওয়া হবে এবং মূল কোর্স চলাকালীন আপনাকে সেখানে থাকতে হবে। সে শমশের সহেব কে তার জন্য নির্ধারিত বাড়িতে নামিয়ে দিতে নিয়ে গেল। যাবার সময় শমশের সাহেবের দিকে তাকিয়ে মনে হলো তিনি যেন এতিম হয়ে গেলেন ! তার ধারণা ছিল না যে আমাদের পৃথক পৃথক বাড়িতে থাকতে হবে। পরে জেনেছি ব্রিটিশ কাউন্সিল কতৃপক্ষ দ্রুত ইংরেজী ভাষা শেখানোর জন্য ছাত্রছাত্রীদের এভাবে ইংলিশ ফামিলির সাথে এটাচমেন্ট দেয়। সাধারণত অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ / বৃদ্ধা ইংলিশ পরিবার এসব ছাত্রছাত্রী তাদের বাড়িতে রাখেন কিছু বাড়তি আয়ের জন্য। ব্রিটিশ কাউন্সিল তাদের এজন্য খরচপাতি দিয়ে থাকে।
তো এভাবে আমাদরে যুক্তরাজ্যে যাত্রা পথ শেষ হল। ঐ বৃদ্ধার বাড়িতে একমাস থেকে ইংলিশ লাঙ্গুয়েজ কোর্স শেষ করে ‘UNIVERSITY OF EAST ANGLIA’ এর কনস্টেবল টেরেসে মূল কোর্স চলাকালীন থেকেছি ও সেখান থেকেই সেপ্টেম্বরের ১৮ তারিখে লন্ডন হয়ে দেশে ফিরে আসি। এ সময়ের মধ্যে ঘটেছিলো অনেক ঘটনা ও অর্জন করেছিলাম প্রচুর অভিজ্ঞতা। কোর্স সুপারভাইজরের তত্ত্বাবধানে বেড়াতে গিয়েছি কেমব্রিজ ইউনিভারসিটি ও অক্সফোর্ড ইউনিভারসিটিতে, লন্ডন শহরের বিখ্যাত সব দর্শনীয় স্থানসহ ব্রাইটন ও বাথ সিটির সমুদ্রসৈকতে, গ্রেট ইয়ারমাউথ , এংলো সাকশন রাজ বংশের রাজপ্রাসাদ অয়েলশিংহাম ,বাক্সওয়ার্থ এগ্রিকালচার ফার্ম , কোলচেস্টার ও কিংসলেইন সিটি ,ইপচউইচ বন্দর, থেটফোর্ড ফরেস্ট এবং যুক্তরাজ্যের আরো অনেক ছোট বড় শহরে। এ সব স্থানে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা , বিভিন্ন দেশের প্রশিক্ষনার্থীদের সাথে বনধুত্ব ,ক্লাসে শমশের সাহেবের ইংরেজী বলা নিয়ে বিব্রতকর অবস্থা ইত্যাদি অনেক বিষয় নিয়ে আরো অনেক কিছু লেখার আছে। সেসব ঘটনাবলী নিয়ে পরবর্তিতে লেখার ইচ্ছা আছে। আজকের মত এখানেই শেষ করছি।