টরন্টো, কানাডা থেকেঃ-
আতশবাজির ঝলকানি বোধকরি সবাইরই ভালো লাগে।ছোটদের আরো বেশি ভালো লাগবে এটাই স্বাভাবিক।সেজন্যই আমার মেয়ে নুহা ৩১ ডিসেম্বর বিকেল থেকে বার বার বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার জন্য মিনতি করছিল।আমার তেমন সায় ছিল না। কারণ মনের শংকা, ভয়। রাত ১০ টা- ১১ টায় বের হয়ে ফিরতে ফিরতে গভীর রাত হয়ে যাবে। রাস্তায় তখন মানুষজন থাকবেতো। মানুষজন থাকলেও তাঁরা স্বাভাবিক থাকবেতো (মাতাল মানুষকে কি স্বাভাবিক বলা যায়?)। মাইনাস চার তাপমাত্রায় রাত্রে বেশিক্ষণ থাকলে ঠান্ডা লাগবেনাতো। কানাডায়তো কখনো নববর্ষ উদযাপন করতে যাইনি- স্ত্রী, কন্যাকে নিয়ে গিয়ে যদি রাতে ফেরার সময় ঝামেলায় পড়ি, আরো কত কী….।সন্ধ্যার পর আমার মেয়ে আবারও একই মিনতি করলো, এবার তাঁর মায়ের সামনে।আমার স্ত্রী শিউলী বললো, ‘চলো যাই’। আমি মুখে বললাম ‘ঠিক আছে’ কিন্তু মনে মনে সেই ভয়, আতংক, নানা প্রশ্ন। কিছুক্ষণ পরে আবার তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমরা যাবেই?’ দু’জনেই বললো, ‘না, এত রাত করে যাব না।’ আমি কনফিউজড্।তাঁরা কি মন থেকে না করেছে? লিভিং রুমে বসে সিপি টুয়েন্টি ফোর (টরন্টোর টিভি চ্যানেল)দেখছি।নাথান ফিলিপস্ স্কয়ারের নববর্ষ উদযাপনের আয়োজনের কথা কিছুক্ষণ পর পর দেখাচ্ছে।টিটিসি (টরন্টো ট্রান্সিট কমিশন) বিনামূল্যে সন্ধ্যা ৭ টা থেকে ১ জানুয়ারি ২০১৬ এর সকাল ৭টা পর্যন্ত যাত্রীবহনের ঘোষণা দিয়েছে, স্ক্রল নিউজে তাও দেখাচ্ছে বার বার।চোখের সামনে ভেসে উঠেলো ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫ তারিখের টরন্টো টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস্ পত্রিকার শিরোনাম ‘দ্যা ওয়ার্ল্ডস্ বিগেস্ট পার্টিস্’। খবরটিতে বিশ্বের সবচেয়ে ঝাঁকজমকপূর্ণ ১০টি নববর্ষ আয়োজনের কথা লেখা হয়েছিল যার মধ্যে টরন্টোর কথা বলা হয়েছিল। অন্যান্য যেসব আয়োজনের কথা বলা হয়েছিল তা হলো – লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস, রিও ডো জেনিরো, সিডনি, মিয়ামি, লাস ভেগাস, টোকিও এবং ভিয়েনা।বাসার কাছে এত বড় আয়োজন, আর দেখতে যাব না। বউ আর মেয়েকে বললাম, ‘রেডি হও, আমরা যাব’।তখন বাজে রাত ১০ টা।
টার্গেট করলাম ১০.৩০ টার বাস ধরবো। বলাবাহুল্য, টিটিসির বাস, ট্রেন, স্ট্রিট কার সবকিছু চলে নির্দিষ্ট সময় ধরে। খুউব কম সময় দেখেছি যে বাস নির্দিষ্ট সময়ের এক মিনিট আগে বা পরে আসে।তাই বাসা থেকে বাস, ট্রেনের সময় দেখে যে কোন ভ্রমণ পরিকল্পনা করা যায়।বাসা থেকে বের হয়ে লিফটের কাছে যেতেই (কানাডায় অবশ্য লিফট শব্দটি ব্যবহার করে না, সকলে ‘এলিভেটর’ বলে)পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম।লিফটে ভিড়; সাধারণত এ সময়ে এত ভিড় হয় না। ‘ডন সাইড ড্রাইভ’ বাস স্টপেসে গিয়ে আমার ধারণা পাল্টে যেতে লাগলো।অনেক মানুষ গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে এবং মনে হলো তাঁরা সবাই ফিলিপস্ স্কয়ারে যাওয়ার জন্য বের হয়েছে।বাসার সামনে থেকে ৬৭ নম্বর বাস ধরে ভিক্টোরিয়া পার্ক সাবওয়ে স্টেশন গেলাম।সেখানে গিয়ে মনে হলো সকাল বেলা স্কুল- কলেজ- অফিসে যাওয়ার সময় যেমন ভিড় হয় ঠিক সেরকম ভিড়। ট্রেনে উঠে বসার জায়গাও পেলাম না।সবার মধ্যে উৎসবের আমেজ, চারদিক থেকে বিভিন্ন আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। কারো কথাইতো বুঝতে পারছি না, তাই ‘আওয়াজ’ শব্দটি ব্যবহার করলাম। অবশ্য দু’ এক বার বাংলা ভাষার আলাপচারিতা কানে আসছিল।কানাডার অফিসিয়াল ল্যাংগুয়েজ দু’টি- ইংরেজি ও ফ্র্যাঞ্চ।কিন্তু এ দেশে প্রায় দু’শতাধিক ভাষা প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হয়।আমি আশ্চর্য হচ্ছিলাম সাবওয়ে ট্রেনে এরকম গুঞ্জণ শুনে। অন্যান্য সময় সাবওয়ের ভিতরে অনেকটা পিনপতন নিরবতা থাকে, প্রায় প্রত্যেক যাত্রীর কানে থাকে হেড ফোন- কেউ গান শুনে, কেউ মুভি দেখে, কেউ গেইম খেলে; কেউ পত্রিকা পড়ে, কেউ ক্রস ওয়ার্ড মেলাতে ব্যস্ত থাকে – সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত যেন ‘নিজের তরে নিজেরা আমরা, প্রত্যেকে আমরা নিজের তরে’।আজ কেন এই ব্যতিক্রম? আমি ও আমার বউ এ বিষয়ে আলাপ করলাম।আমাদের মনে হলো আজ সবাই নববর্ষ উদযাপনে যাচ্ছে, সবাই খুউব আনন্দিত, উৎসাহিত, উদ্বেলিত। কেউ যাচ্ছে পরিবার নিয়ে, কেউ যাচ্ছে বন্ধু- বান্ধবের সাথে: সঙ্গী- সাথীরা একে অপরের পরিচিত।অন্যান্য সময় যখন সাবওয়েতে ভ্রমণ করে তখন আশে পাশে সাধারণত কেউ পরিচিত থাকে না, তাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে সবাই।এসব আলাপ করতে করতে আমরা পৌঁছে গেলাম ‘ইয়াংগ স্টেশান’। এখানে আমাদের অন্য সাবওয়েতে যেতে হবে, এক নম্বর লাইনের ট্রেন। নীচ থেকে এসকেলেট্র দিয়ে উপরে উঠে ‘ব্লোর স্টেশন’ থেকে সাউথ বাউন্ড ট্রেন ধরলাম। এখানে দেখলাম দ্বিগুণ ভিড়, ট্রেনে দাঁড়ানোর জায়গা নেই।বসারতো জোঁ নেই, হাতল ধরার সুযোগও পেলাম না।বউকে বললাম, তুমি কিছু একটা ধরার চেষ্টা করো, আমি নুহাকে ধরে রাখছি। তাঁর উত্তর, এখানে কিছু না ধরলেও পরার কোন সুযোগ নেই, চারদিকে মানুষ। কয়েকটি স্টেশন পরেই ‘কুইন স্টেশন’। আমরা এখানেই নামলাম।চারদিকে মানুষ আর মানুষ।সংখ্যা কত হবে? লক্ষাধিক? আমি জানি না। এটা কি রাত ১১ টা নাকি দিনের ১১ টা? এত মানুষ টরন্টোতে থাকে?কয়েক ঘন্টা আগেও আমি ভেবেছিলাম বরফের সময়ে, এতো ঠান্ডায় রাতে মানুষজন অনুষ্ঠানে যাবেতো? এখন দেখি পুরো বিপরীত, মানুষের জন্য হাঁটতে পারছি না।
চারদিকে বাঁশির শব্দ, মাথায় ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ সম্বলিত আলো জ্বলমল হরেক রকমের টুপি, চমৎকার ও আকষর্ণীয় ড্রামের বাজনা (সব তৈজসপত্র যেমনঃ বালতি, বোতল ইত্যাদিকে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল), মনের আনন্দে বাজনার তালে তালে নৃত্য।মূল আয়োজন স্থলের কাছে যেতে যেতে আশে পাশের সকল আনন্দে আমরাও আনন্দিত হলাম।শীতের কাপুনিতে হাত বের করে ছবি তুলতে ইচ্ছে করলো না যদিও ছবি তোলার আশায় ক্যামেরা, আই প্যাড আর স্মার্ট ফোন সবই সাথে রেখেছিলাম। দু’ একটা যে তোলিনি, তা নয়। কিন্তু সেসব ছবির কোয়ালিটি দেখে ছবি তোলার আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম।বরফের স্কেটিং রিন্ক এ ছোট, বড়, যুবাদের স্কেটিং নৈপুন্য কিছুক্ষণ দেখে জনসমুদ্র ঠেলতে ঠেলতে স্টেজের কাছাকাছি গেলাম যখন তখন বাজে ১১.২০ টা। আরো ৪১ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে আতশবাজির ঝলকানি দেখার জন্য। এতক্ষণ কি দাড়িয়ে থাকতে পারবো? হয়তবা থাকতে পারতাম কিন্তু নুহা কোনভাবেই মাথায় টুপি পরতে রাজি হচ্ছিল না। তাই শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে একটা ছাউনীর নিচে আশ্রয় নিতে পিছু হটলাম। এত বড় আয়োজনে নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোন পদক্ষেপ চোখে পড়ল না। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে যখন জঙ্গী হামলার ভয়ে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো, কোথাও কোথাও উন্মুক্ত আকাশে সকল প্রকার আয়োজন নিষিদ্ধ করা হলো সেখানে টরন্টোর এত বড় আয়োজনে নিশ্ছিদ্র না হোক ছিদ্রসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থাও চোখে পড়ল না। একবার শুধু ২ জন পুলিশ দেখলাম তাও আবার ‘অক্সিলারি পুলিশ’।এরা আসলে স্বেচ্ছাসেবক পুলিশ যাঁদের কাছে সাধারণত অস্ত্র থাকে না।তবে কি সাদা পোষাকে পুলিশ ছিল? আমি জানি না।অবশ্য এ সময়ে আমরা কোন ঘটনা- দুঘর্টনা দেখিনি।কোথাও কোন মাতালও চোখে পড়েনি।সকলকে ভদ্র ও শান্তিপ্রিয় মনে হয়েছে।সবাই এসেছে ইংরেজি নতুন বছরকে বরণ করতে, আনন্দ করতে, আনন্দকে ভাগাভাগি করতে।
স্টেজে গান হচ্ছে।‘যেমন খুশি তেমন নাচ’ টাইপ নৃত্য চলছে গানের তালে তালে।কেউ কারো নাচ দেখছে না। মনের আনন্দে নাচছে সবাই আর অপেক্ষা করছে কখন ঘড়ির কাঁটা রাত ১২ টা অতিক্রম করবে। মাহেন্দ্রক্ষণ প্রায় উপস্থিত। নড়াচড়ার জায়গা নেই।আমরা যে ছাউনীর নিচে তা থেকে কিছুই দেখা যাবে না। আমার মেয়ের মন খারাপ হয়ে গেল। এদিক সেদিক কোনদিকে যেতে পারছি না আমরা। অনেক সংগ্রাম করে, ছাউনী থেকে একটু দূরে আসলাম। তাতেও নুহার মন ভরে না, কারণ আমাদের সামনে এক বিশাল গাছ। আতশবাজির খেলা দেখতে হবে খোলা আকাশের নিচে, গাছ- ছাউনী এগুলো সামনে থাকলে হয়? ততক্ষণে কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে – সমস্বরে সবাই চিৎকার করছে দশ, নয়, আট,…..এক। আতশবাজির রঙে পুরো আকাশ আলোকিত।নতুন এক আলোকিত বছরের আশা নিয়ে আমরা সবাই নতুন বছরকে বরণ করলাম। স্ত্রী আর কন্যা ছাড়া অনুষ্ঠানস্থলে কেউ পরিচিত ছিল না। তবুও আশে পাশের সবাই সবাইকে বললাম ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’।
২ জানুয়ারি ২০১৬
নববর্ষের আভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
আপনার লেখা সব সময় উপভোগ করি।
Nice one. 🙂