হেমন্তের আগুন-রাঙা বর্নালী পাতার দিনগুলো প্রায় শেষের দিকে। উত্তরের হিমবুড়ী সাদা তুষারের পাল্কিতে চড়ে প্রায় পৌঁছে গেছেন। আর তার আগমনি বার্তা নিয়ে কনকনে শীতের বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে শহরের যত রঙ। কিন্তু প্রকৃতির সাদাকালো প্রচ্ছদের সাথে যুদ্ধ করে নিজেদের নাগরিক জীবন রঙিন রাখতে টরন্টো শহরের কিছু স্বপ্নদ্রষ্টা সাদা মনের মানুষ মিলে আয়োজন করেন “খেলাঘরের” সর্বপ্রথম আড্ডা।
আর বাচ্চাবেলার রঙিন দিনগুলো মনে করে আর সেই নিষ্পাপ নির্জল আনন্দের গন্ধ পেয়ে জড়ো হয় প্রাক্তন খেলাঘরিয়ানসহ আরও অনেকে। এক নীলাভ শীতের নভেম্বরের তৃতীয় দিবসে ড্যানফোর্থে অবস্থিত মিজান কমপ্লেক্স অডিটোরিয়াম হয়ে ওঠে স্মৃতিচারন, ছেলেবেলার গান, আড্ডাবাজী, আলোর কথা ও একসাথে নতুন কিছু করার উচ্ছলতার মেলা।
সেই ছেলেবেলা থেকে খেলাঘরের সাথে আত্মার বন্ধনে জড়িয়ে যাওয়া প্রাক্তন খেলাঘরিয়ান সুমন সাইদের কথা অনুযায়ী সেই ১৯৫২ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় শিশু-কিশোর সংগঠন “খেলাঘর” যেখানে হাসি আনন্দে কাটে বর্নিল শৈশব। এরপর ধূমকেতুর মত ছড়িয়ে যায় সমগ্র দেশে এবং দেশের সীমানা পার করে বিদেশেও। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭০০ টিরও বেশি শাখা রয়েছে খেলাঘরের। টরন্টোতে বাঙালী শিশুদের নিয়ে এটি এধরনের প্রথম ও একমাত্র উদ্দ্যোগ।
ভিনদেশে আমাদের পরিচয় বছরের পর বছর বহন করবে আমাদের আগামী প্রজন্ম আর এই লক্ষ্যেই তাদেরকে উদ্দেশ্য করে ক্ষুদে বন্ধুদের জন্যই পথচলা শুরু “খেলাঘর কানাডা”র। আড্ডাটি শুরু হয় আয়োজকদের কথামত ঠিক সাড়ে চারটায়। প্রথমেই পরিচয়পর্ব এবং উপস্থিত সকলের সাথে “খেলাঘরের” ইতিহাস। বহু পুরাতন ও নতুন খেলাঘরিয়ান তাদের স্মৃতিচারণ করেন এবং যারা খেলাঘরের সাথে যুক্ত ছিলেন না তারা শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ততার কথা তুলে ধরেন এবং নব উদ্যমে কানাডায় পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। সকলেই আন্তরিকভাবে খেলাঘরের উদ্যোগে সমর্থন ও সক্রিয় সহযোগিতার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এর মধ্যে প্রাক্তন খেলাঘরিয়ানদের সমবেত কন্ঠে খেলাঘর সঙ্গীত ‘আমরা তো সৈনিক’ এর পরিবেশনা এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি করে এবং প্রাক্তন খেলাঘরিয়ান সকলেই সেই সুদূর অতীতের ঝলমলে হীরক-দ্যুতিময় দিনগুলোতে ফিরে ফিরে যান। উপস্থিত সকলেই এই গানের সাথে গলা মেলান। তারপর আবারও আড্ডা, আলোচনা, আবারও স্মৃতিচারণ। আবারও সেই স্মৃতি-জাগানিয়া পুরাতন খেলাঘর গানে ফিরে যাওয়া-এভাবেই বয়ে যায় সময়। সুমন সাইদ, মুক্তি প্রসাদ, বিপ্লব কুমারের সঙ্গীত পরিবেশনার পাশাপাশি দিলারা নাহার বাবুর কন্ঠে চমৎকার আবৃত্তি ও সফিক আহমেদের “বিদ্রোহী” কবিতার অংশবিশেষের আবৃত্তি সবাইকে চমকিত করে।। টরন্টোর মনশীলতা চর্চার পরিচিত প্রিয়মুখ হাসান মাহমুদ, দেলোয়ার এলাহী, মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ দুলালসহ এই আয়োজনে উপস্থিত টরন্টো সাংস্কৃতিক অঙ্গনের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উজ্জ্বল মুখগুলো তাদের মূল্যবান বক্তব্য প্রকাশ করেন। আরিফ হোসেন বনি, সুমন সাঈদ, জাহিদ হোসেন, শওকত হোসেন, ফরিদা হক, সাঈদা বারী, মেরী রাশেদীন, মৌ মধুবন্তী, নাজনীন আকবর, রতন রায়, হোসনে আরা জেমী, রেখা হাবিবুল্লাহ, এলিনা হাওলাদার, এ এম এম তোহা, মম কাজী, মাশহুদা ইসলাম, শাপলা শালুকসহ আরও যারাই আলোচনায় অংশ নিয়েছেন সবাই খেলাঘরের এই নতুন পথচলায় এবং শিশুদের নিয়ে কাজ শুরুর এই প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন, বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা প্রদান করে সম্মিলিত প্রয়াসে অনাবিল, নির্মোহ ঐক্যবদ্ধতায় সামনে এগিয়ে যাওয়ার উপর গুরুত্ব প্রদান করেন। নতুন প্রজন্মের পক্ষ থেকে আলোচনায় অংশ নিয়ে ফারাহ বলেন- নতুনদের নিয়ে কাজ করায় খেলাঘরের সঙ্গী হবেন তিনি।
বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হাসান মাহমুদ খুব মজা করে বলেন- “বিশ্বের প্রতিটি শিশুর মাঝেই রয়েছে একটি করে খেলাঘর।” আড্ডার সর্বশেষ বক্তা ছিলেন লেখক, দার্শনিক, মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব ও অসামান্য কবি আসাদ চৌধুরীর বক্তব্য। অত্যন্ত বিচক্ষন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি বলে যান বাংলাদেশ, কানাডা, ভাষা, শিশু, ইতিহাস, রাজনীতি এবং অভিবাসনের যত কথা, সেই সাথে হারিয়ে যান খেলাঘরের সাথে সম্পৃক্ততার দীর্ঘদিনের স্মৃতিচারণে। উপস্থিত সকলেই তা মন্ত্রমুগ্ধের মত করে শুনে যায়। তিনি তাঁর বক্তব্য শেষে বলেন- “ছেলেমেয়েরা বড় হয় বাবা মায়ের স্বপ্ন গায়ে মেখে।” আসাদ চৌধুরী তাঁর স্বপ্নচারী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে উপস্থিত দর্শকদের যে ঘোরের মাঝে নিয়ে যান, তা কাটে অত্যন্ত প্রানোচ্ছ্বল “আমরা করব জয়” গানটির ইংরেজী ও বাংলা পরিবেশনের মাধ্যমে। সকলেই যুক্ত হন এই অনুপ্রেরনা দানকারী গানটির কোরাসে। জামিল বিন খলিল ব্যাখ্যা করেন তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা এই “খেলাঘর কানাডা”কে ঘিরে, জানান- সবাই মিলেই সামনে যাওয়ার কথা। এরপর আসাদ চৌধুরীকে মধ্যে রেখে সকল বাচ্চাদের নিয়ে কেক কেটে শেষ হয় প্রথম খেলাঘর আড্ডা। তারপর কেক খাওয়া, আরও গল্প, ফটোসেশন ও হল পরিস্কার করা হয় একই সাথে।
কিছু কথা, স্মৃতিচারণ, কিছু গান, কবিতা, আড্ডা ও খাওয়ায় কেটে যায় স্বত:স্ফূর্ত প্রানোচ্ছ্বল একটি সন্ধ্যা। সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ও মিজান কমপ্লেক্সের মিজান ভাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বের হয়ে আসি ড্যানফোর্থ রোডের উপরে। মনটা একটু খারাপ লাগে এই ভেবে যে, সমস্ত বিকেল যেন সেই বাংলাদেশে ফেলে আসা ছেলেবেলায় কাটিয়ে এলাম আর এখন শীতল এই শহরের একাকী বাস্তবতার নির্মম পরিহাস যেন হেসে প্রশ্ন করছে কোনই বা রয়েছি এত দূরে প্রিয়জনদের ছেড়ে? কিন্তু বুকের মাঝে তবু রয়েছে বড় উজ্জ্বল আশার আলো- নতুন বন্ধু হবে- ক্ষুদে বন্ধু “খেলাঘরে”। আরও একটি ছেলেবেলা কাটানোর দুর্লভ সুযোগ হয়তে পেতেও পারি। এই আনন্দে আমার কুটিরের উদ্দেশ্যে শুরু করলাম আমার দীর্ঘ হন্টন যাত্রা।