ঈদুল ফিতর দেশে দেশে কালে কালে মুসলিমদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় উৎসব। ঈদ মানেই খুশি আর আনন্দে প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানো, সাধ্যমত উপহার দেয়া, জাকাত ফেতরা আদায় করা। এবারে করোনা ভাইরাসের কারণে প্রবাসীদের বেশিরভাগেরই ঈদে শুধু সাধ্যমত রেমিটেন্স পাঠানোই সম্ভব হয়েছে অন্য কোনো আনন্দ আর করা হচ্ছে না– আর আমার মনে হয় এটিই অন্যরকম আনন্দ। বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ ভাই কাল তাঁর একটি লেখায় আক্ষেপ করেছেন– এই ঈদে প্রবাসীরা দেশের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার সময় বিপুল পরিমান আর্থিক সাহায্য পাঠিয়েছেন, অথচ প্রবাসীদের সঙ্গে কি দুর্ব্যবহার ই না করা হয়। আমি বলি দেশে থাকি আর বিদেশে থাকি শিকড়ের টান কি আমরা ছাড়তে পারি?
এই ঈদে খুব মনে পড়ছে ছোটবেলার নির্ভেজাল আনন্দের ঈদ, দেশে এবং প্রবাসে কাটানো বিগত আনন্দময় ঈদ গুলোর কথা। এবারের ঈদ সারা বিশ্বে একেবারেই অন্যরকম, এমন ঈদ কখনোই আসে নি। যেমনটি কিছুদিন আগে খ্রিস্টীয় ইস্টার সানডে ছিল একেবারেই অন্যরকম।
ছোটবেলার রোজা আর ঈদের মধুর স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। ওই সময় সারা বছর বিশেষ করে রোজার মাসটা কাটতো অপেক্ষায়– ঈদের অপেক্ষায়। রোজার দিন গুলোতে সেহেরীর সময় পাড়ার ভাইয়েরা থালা বাটি বাজিয়ে, কখনো মাইক বাজিয়ে রোজাদারদের ঘুম ভাঙাতো সেহেরি খাওয়ার জন্য। আবার সাইরেনও বাজতো সেহেরি আর ইফতারের সময়। ছোটবেলা ঈদের প্রস্তুতি অর্থাৎ নতুন জামা, জুতা, ছোট্ট ভ্যানিটি ব্যাগ, চুড়ি এসব কেনা শুরু হতো অনেক আগেই। ২৭শে রোজার দিন মেহেদির পাতা বাটা দিয়ে হাত রাঙ্গাতাম, কার রং কত ভালো হতো তা নিয়েও চলতো তুমুল প্রতিযোগিতা। যার মেহেদী কোরবানির ঈদ পর্যন্ত থাকতো তার নাকি সোয়াব বেশি হতো। কারো কারো নখের মেহেদির রং সত্যি কোরবানির ঈদ পর্যন্ত থাকতো। আম্মা সবসময়ই আমার রং বেরঙের নানা ডিজাইনের জামা বানিয়ে দিতেন, খুব ভালো সেলাই করতেন আম্মা, কোনো দর্জি তাঁর ধারে কাছে আসতে পারতো না।
ঈদের জামা, জুতা আলমারিতে লুকিয়ে রাখতাম, কাওকেই দেখতাম না। শুধুমাত্র ঈদের দিন সকালে বের করতাম। ঈদের দিন ভোর রাতে আম্মা উঠে বিভিন্ন রকমের সেমাই, জর্দা, পুডিং, হালুয়া বানাতেন। আমি রান্নাঘরে আম্মাকে একটু সাহায্যের চেষ্টা করতাম আর মুগ্ধ হয়ে আম্মার রান্না দেখতাম। আব্বা এবং ভাইয়েরা নতুন সাবান দিয়ে গোসল করে নতুন পায়জামা–পাঞ্জাবি পরে টুপি মাথায় দিয়ে, আতর মেখে, জায়নামাজ নিয়ে ঈদের মাঠে চলে যেতেন সেমাই খেয়েই। আব্বা যাওয়ার সময় আমাদেরকে ঈদের টাকা বা সেলামি দিয়ে যেতেন। আমাদের ছেলেবেলায় মহিলারা ঈদের নামাজ পড়তে মাঠে বা মসজিদে যেতেন না। তাই আমি আর আম্মা বাসায় থাকতাম। ইতোমধ্যেই আম্মা শাহানার মা খালাকে নিয়ে লেগে যেতেন পোলাও কোর্মা, কোপ্তা কালিয়া রান্নার কাজে। আর আমি গোসল করে নতুন জামা জুতো আর ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে বের হয় যেতাম বেড়াতে বান্ধবীদের সাথে। একবার ঈদে লুঙ্গী সেট পড়েছিলাম মনে পড়ে, তখন ওটা খুব স্টাইল এর ছিল, লং স্কার্ট আর টপস। বান্ধবীদের সাথে ঈদের মাঠে যেতাম কদমা , বাদাম, বুট, জিলাপি, বাতাসা , পাঁপড় আরো কত মজার মজার খাবার খেতে। ঈদের মাঠে নামাজ শেষে আব্বা আর ভাইরা সহ সবাই যে কোলাকুলি করতো ওটা দেখতে আমার খুব ভালো লাগতো। তার পর বের হয়ে যেতাম বান্ধবীদের বাসায় ঘোরাঘুরি করতে , কখনো হেঁটে , কখনো বা রিকশায়। কিযে মজা পেতাম, আমার বান্ধবীরাও আসতো দল বেঁধে আমাদের বাড়িতে। খাওয়া দাওয়ার চেয়ে নতুন জামা কাপড় পরে বান্ধবীদের সাথে বেড়ানোর আনন্দটাই ছিল স্বর্গীয়। ওই দিনগুলো যদি আবার ফিরে পেতাম !
শৈশবের ঈদ ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে এবং হচ্ছে এখনো। এখন আমি কানাডা প্রবাসী , অনেক দিন থেকেই পরিবারসহ প্রবাস জীবন যাপন করছি। ঈদের দিন মা–বাবা, আত্মীয় স্বজন দের খুব মনে পড়ে, খারাপ লাগে , তবুও মানিয়ে নিয়েছি, খাপ খাইয়ে নিয়েছি নিজেদের। এখানে আমরা নারী–পুরুষ নির্বিশেষে ঈদের মাঠে বা মসজিদে নামাজ পড়তাম – দেশি লোকজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হতো, কুশল বিনিময় হতো। মন্দ কাটতো না ঈদের দিন। সারাদিন বাসায় মেহমান আসতো , আম্মার রান্না আর ইউ টিউব দেখে দেশী মজার মজার খাবার রান্না করতাম, বন্ধু বান্ধবের বাসায় বেড়াতে যেতাম, নতুন জামা কাপড় পড়তাম, বাচ্চাদের বন্ধু বান্ধবীরা আসতো, ঈদের দিনটি খুব আনন্দেই কাটতো।
কিন্তু এবারের ঈদটা কেমন হচ্ছে আমাদের, দেশে বিদেশে সবখানে? কোথাও এবারের ঈদ স্বাভাবিক ভাবে হচ্ছে না – কোনো নতুন জামা কাপড় কেনা হয় নি, ঈদের মাঠে বা মসজিদেও ঈদের নামাজ হবে না, যে যার বাড়িতে কোনোরকমে ঈদের দিন টি কাটবে, ভার্চুয়ালি একে অপরের সাথে মিটিং হবে।
কোনো কোলাকুলি হবে না, কোনো সেলামি আদান প্রদান হবে না, কারো বাসায় যাওয়া হবে না, কেউ বাসায় আসতেও পারবে না, কারো বাসায় খাবার পাঠাতে পারবো না, শুধু দেশে টাকা পাঠানো হয়েছে, কিন্তু ওরাও তো কেউ কিছু কিনছে না। কিন্তু ভালো কথা হলো জাকাত–ফিতরার টাকা দিয়ে দেশের দুস্থ মানুষদের কিছু দিতে পেরেছে প্রবাসীরা, যাদের সত্যি প্রয়োজন, তাঁদের কিছু দেয়া গেছে। তবে দিন বদলাবে নিশ্চই, আবার স্বাভাবিক ঈদ আসবে ইনশাআল্লাহ। আমরা দূরে থেকেও সবাই একসাথে এই দুর্দিন পাড়ি দিচ্ছি, সারা পৃথিবীর সব মানুষ। মন ভালো রাখছি, সুদিনের অপেক্ষায় আছি, জানি আপনারাও তাই করছেন।
এই দুর্দিনে দেশে বিদেশে সবাই ভালো থাকুন, মন ভালো রাখুন। ঈদ মোবারাক সবাইকে।
(মাহমুদা নাসরিন , আরসিআইসি & কমিশনার অফ ওৎস, শিক্ষক এবং সমাজকর্মী। , ক্যানবাংলা ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস, [email protected], টরেন্টো, কানাডা)