গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ থেকে ফোন, টেক্সট মেসেজ আর ইমেইল এর যন্ত্রনায় ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা । দেশের মানুষের ফোন, টেক্সট বা ইমেইল পেয়ে খুশি না হয়ে যন্ত্রনা কেন বলছি জানেন? প্রতিদিন রাতে আমার এবং আমার পরিবারের সবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে রাত দুপুরের ফোনে। সেল ফোন সাইলেন্ট করে রাখলেও হোম ফোন রাত দুপুরে এক নাগাড়ে বেজেই যায় , তাই ওটাও আপাততঃ বন্ধ করে রেখেছি। কেন এতো ফোন, মেসেজ আর ইমেইল জানেন তো? ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম এবং খুলনাসহ সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে কিছু লোক ক্রমাগত ভাবে বিজ্ঞাপন দিয়েই যাচ্ছে– কানাডা দশ লক্ষ বাংলাদেশী নেবে। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, বিকৃত এবং প্রতারণামূলক সংবাদ , একটি বিশেষ প্রতারক চক্র বাংলাদেশের সহজ সরল মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে এই ধরণের প্রতারণামূলক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই সংবাদে বিভ্ৰান্ত হচ্ছেন আমাদের বাংলাদেশের ভাই–বোন, আত্মীয় স্বজন আর বন্ধু বান্ধব। কোথায় পেয়েছেন তাঁরা এই খবর? খবর শুনে মনে হচ্ছে কানাডার প্রধান মন্ত্রী হয়তো তাদেরকে ফোন বা ইমেইল করে ভীষণ অনুনয় বিনয় করে বলেছেন– কোথাও কোনো লোক পাওয়া যাচ্ছে না, কোনো দেশ থেকেই কানাডায় লোক কিছুতেই আসতে চাচ্ছে না– তোমরা দয়া করে দশ লক্ষ লোক ধরে বেঁধে যেভাবেই হোক এক্ষুনি এই মুহূর্তে পাঠিয়ে দাও অন্যথায় আমাদের সব কিছু অচল হয়ে যাচ্ছে।
পশ্চিমা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ যখন তাদের দেশে অভিবাসন প্রকৃয়া বলতে গেলে একরকম বন্ধ করেই দিয়েছে সেই সময়ে কানাডার ইমিগ্রেশন মিনিস্টার আহমেদ হুসেন যিনি নিজেও এদেশে সোমালিয়া থেকে শরণার্থী হিসেবে পা রেখেছিলেন খোদ পার্লামেন্টে আগামী তিন বছরে তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার অভিবাসী আনার ঘোষণা দিয়েছেন। নিঃস্বন্দেহে এটি একটি সুসংবাদ এবং অত্যন্ত আশাব্যাঞ্জক খবর। বিবিসি, সিএনএন এবং নিউয়র্ক টাইমস সহ সকল পশ্চিমা মিডিয়ার নজর কেড়েছে এই সংবাদ। যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশ গুলো যখন তাদের অভিবাসন নীতিমালা অত্যন্ত কড়াকড়ি করেছে ঠিক সেই সময় কানাডার এই ধরণের তিনবছর মেয়াদী তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার অভিবাসী নেয়ার পরিকল্পনাকে সিএনএন বিশেষ ভাবে প্রশংসা করেছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে যেহেতু কানাডায় জন্ম হার কমে গেছে এবং বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে তাই যে কেউ আসতে চাইলেই এক্ষুনি কানাডা চলে আসতে পারবে। কানাডা আসতে চাইলে অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক, লম্বা সিলেকশন প্রসেসের মাধ্যমে যোগ্যতার প্রমান দিয়েই আসতে হবে। আসুন দেখে নি– এই মুহূর্তে কি কি ভাবে কানাডা আসা যাবে?
এক্সপ্রেস এন্ট্রি
এক্সপ্রেস এন্ট্রির মাধ্যমে প্রতি পনেরো দিনে ৩৫০০–৪০০০ স্কীলড ইমিগ্র্যান্ট হিসাবে আসার আমন্ত্রণ পাচ্ছে। কারা পাচ্ছেন এই আমন্ত্রণ? যারা অত্যন্ত অল্প বয়সেই সিএলবি ৯ অর্থাৎ আইএল্টস এ ৯ এর মধ্যে ৮.৫ পাচ্ছেন, যাঁদের জব কানাডার অকুপেশন ইন ডিমান্ড লিস্টে আছে, যাদের ফ্রেঞ্চ ল্যাঙ্গুয়েজে স্কিল আছে, যাঁদের আপন ভাই বোন কানাডায় আছে, যাদের কানাডিয়ান এডুকেশনাল ডিগ্রী বা চাকরির অভিজ্ঞতা আছে তাঁরাই পাচ্ছেন নোমিনেশন। কাজেই আইএল্টস বা ফ্রেঞ্চ ল্যাঙ্গুয়েজে টেস্ট না দিয়ে , কানাডা থেকে এডুকেশনাল ক্রেডেনশিয়াল এসেসমেন্ট না করিয়ে যে প্রক্রিয়া শুরুই হয় না, সেখানে টিকে থাকতে গেলে এই মুহূর্তে সিআরএস স্কোর ৪৪৯ দরকার। কয়জন বাংলাদেশীর আছে এই ধরণের স্কিল যা দিয়ে সমস্ত পৃথিবীর প্রতিযোগীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে?
ফ্যামিলি স্পনসরশিপ
ফ্যামিলি রেউনিফিকেশন কানাডিয়ান ইমিগ্র্যাশন এর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক। এই প্রক্রিয়ায় ২০১৯ সালে ২০ হাজার প্যারেন্টস এন্ড গ্র্যান্ডপারেন্টস আসতে পারবেন। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালে লটারী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাত্র ৫০০০ কোটা দিয়ে। আগামী ২৮শে জানুয়ারী থেকে আবেদন পত্র জমা নেয়া শুরু হবে। কিন্তু এখানেও কেবলমাত্র যোগ্য কানাডিয়ান সিটিজেন বা পার্মানেন্ট রেসিডেন্টরাই স্পন্সরশিপের আবেদন করতে পারবেন। কমপক্ষে তিন বছর সিআরএর নোটিশ অফ এসেসমেন্ট অনুযায়ী লো ইনকাম কাট অফ বা লাইকো +৩৫% মিনিমাম ইনকাম থাকলেই আবেদন করা যাবে। অর্থাৎ অত্যন্ত হাই ইনকাম না থাকলে এই আবেদন করা যাবে না।
প্রভিন্সিয়াল নোমিনেশন
প্রভিন্সিয়াল নোমিনেশন নিয়ে, আটলান্টিক ইমিগ্রেশন পাইলট প্রোগ্রামের মাধ্যমে কানাডার আটলান্টিক তীরের চারটি প্রভিন্স এবং অন্যান্য কম পরিচিত প্রভিন্সগুলোতে ইম্মিগ্রান্টরা আসতে পারছে। এক্ষেত্রে অধিকাংশ প্রভিন্স এরই প্রথম পছন্দ যারা এক্সপ্রেস এন্ট্রি পুলে ঢুকে আছেন তাঁদেরকেই। এছাড়া এইসব প্রভিন্সে যাদের আত্মীয় স্বজন আছে তাঁরাই প্রভিন্সিয়াল নোমিনেশন পাচ্ছেন, যাঁদের পেশা অকুপেশন ইন ডিমান্ড লিস্টে আছে।
ইউএসএমসিএ
নাফটা চুক্তি বদলে মেক্সিকো এবং আমেরিকার কানাডার নতুন চুক্তি ইউএসএমসিএ (ইউএসএ –মেক্সিকো –কানাডা এগ্রিমেন্ট) এর মাধ্যমে আমেরিকান এবং মেক্সিকান সিটিজেনরা ইমিগ্রেশনের কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ সুবিধা পায়।
রেফিউজি & প্রোটেক্টেড পারসন
সারা বিশ্ব থেকে যেসব নির্যাতিত মহিলা কানাডায় আশ্রয় প্রার্থনা করে তাদেরকেও অভিবাসনের সুযোগ দেয়া হবে। যেমনটি সম্প্রতি দেয়া হয়েছে সৌদি মেয়ে রাফা আল কুনুন কে।
অভিবাসীদের জন্য মেডিকেল ইনডমইসিবিলিটির আইন ও আগের চেয়ে অনেক বেশি শিথিল করা হয়েছে।
জব অফার
এবার আসি সমগ্র বিশ্বে কানাডায় আসার নামে সবচেয়ে বেশি প্রতারণা ঘটছে যে ক্ষেত্রটিতে তা হচ্ছে জব অফার। জব অফারের নামে বিভিন্ন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইএল্টস ছাড়া, কোনো শিক্ষাগত বা কাজের দক্ষতা ছাড়াই শুধুমাত্র টাকার বিনিময়ে কানাডায় পাঠানোর নাম করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। কানাডায় বসবাসরত বহু স্কীলড ইমিগ্র্যান্ট তাদের পেশার জব না পেয়ে বিভিন্ন সারভাইভাল জব করছে। কাজেই আপেল পাড়ার জন্য , রেস্টুরেন্টে কাজ করার জন্য বা সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করার জন্য খোদ কানাডিয়ান সিটিজেন, পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট বা ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের কিন্তু অভাব নেই। কানাডার টরেন্ট, ভ্যানকুভার মন্ট্রিয়ল সহ বড় বড় সব শহর গুলোতেই কিন্তু হাইলি স্কীলড ইমিগ্রান্টরাই এইসব জবের জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কাজেই কানাডিয়ান এমপ্লয়ার এবং কানাডিয়ান সরকার কেন কানাডার বাইরে থেকে লোক আনবে? কানাডার বাইরে থেকে লোক আনা হয় তখনি যখন কোনো প্রফেশনে যোগ্য লোক কানাডার মধ্যে পাওয়া যায় না। এই যেমন ধরুন গার্মেন্টসের খুব ভালো সেলাই কর্মী যারা কমার্শিয়াল সিউইং মেশিন খুব ভালো চালাতে পারেন। এইধরণের সেলাই কর্মীর কানাডাতে ভীষণ অভাব। আমি জানি এমন কর্মী বাংলাদেশে ভুরি ভুরি আছে। কিন্তু কথা হলো, যদিও এরা সেলাই কর্মী, এরা তো আসবে কানাডা কাজেই ইংলিশ বা ফ্রেঞ্চ ল্যাঙ্গুয়েজ জানতে হবে। কমপক্ষে সিএলবি ৪ অর্থাৎ আইএল্টস লিসেনিং এবং স্পিকিং এ ৪.৫, রাইটিং এ ৪ এবং রিডিং এ ৩.৫ থাকতে হবে।
আপনার মামা–চাচা কারো একজনের কানাডায় কোনো একটা রেস্টুরেন্ট আছে , বা বাংলাদেশের কোনো একটি এজেন্সী আপনাকে টাকার বিনিময়ে কানাডার একটি জব অফার দিলো, তাহলেই কি আপনি কানাডা চলে আসতে পারবেন? কখনোই না– ফরেন ওয়ার্কার রিক্রুট করার জন্য প্রত্যেক প্রভিন্সে গভর্নমেন্ট আপ্রুভড এমপ্লয়ার আছে– তারা যখন প্রমান করতে সক্ষম হয় যে তাদের প্রয়োজনীয় ওয়ার্কার কানাডায় কোনোভাবেই পাওয়া যাচ্ছে না তবেই তারা অনেক নিয়ম কানুন মেনে ফরেইন ওয়ার্কার আন্তে পারে।
টেক অনলি
এই ক্যাটেগরিতে ইনফরমেশন টেকনোলজি ফিল্ডে জব অফার নিয়ে মাত্র দশ দিনেই লোকজন কানাডা আসতে পারছে। কিন্তু কারা আসতে পারছে এভাবে? যেনতেন একটা আইটি প্রফেশনের ডিগ্রী বা কাজের অভিজ্ঞতা থাকলেই হবে না– এইসব তরুণ আইটি প্রফেশনাল রা সারা বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যে থাকে এবং তাদের ভাষাগত দক্ষতাও অনেক বেশি তাই তাঁরা সমগ্র বিশ্বের আইটি প্রফেশনালদের সঙ্গে কম্পেটিশন করেই কানাডা ঢুকতে পারছে।
শেষ কথা
কাজেই তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে মিথ্যা বিজ্ঞাপন দেখে বিভ্রান্ত হবেন না। কানাডা আসতে চাইলে পৃথিবীর সব আবেদনকারী দের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নিয়ম মাফিক ভাবে আবেদন করুন। প্রতারণার ফাঁদে কোনো ভাবেই পা দেবেন না। ঠিক মতো জেনে বুঝে, খোঁজ খবর নিয়ে সিদ্ধান্ত নিন– কি করবেন কেন করবেন। কানাডায় ইমিগ্রেশনের ব্যাপারে যদি কোনো এজেন্সির সহায়তা নিতে চান, প্রথমেই জানুন তারা কানাডা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ইমিগ্রেশন ফার্ম কি না। তারপরেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেবেন। ধন্যবাদ সবাইকে– সবাই ভালো থাকুন আর ভালো রাখুন সবাইকে।
মাহমুদা নাসরিন, ক্যানবাংলা ইমিগ্র্যাশন সার্ভিসেস, টরেন্ট, কানাডা।
Wonderful write up. Folks, who would like to come to Canada or your friends and relatives are willing to come here, please have them read it and follow what the author said.
Thanks a lot Ms. M. Nasrin.