উইলিয়াম শেক্সপিয়ার সত্যিই এক রহস্যমানব; তাকে ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যময় মানুষদের অন্যতম বললে মোটেই বাড়িয়ে বলা হয় না। আমরা এখনো শতভাগ নিশ্চিত নই যে, তার লেখা বলে যেসব নাটক পরিচিত, সেসব আদতেই তিনি লিখেছিলেন কিনা। এমনকি তার নিজের পদবিটি তিনি কীভাবে লিখতেন তা-ও আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ বা কাগজপত্রে সেটা নানান বানানে দেখা গেছে: Shackspeare, Shakspere, Shake-Speare, Shacksper, Shackspeere, Shakespea, Shagsper, Shaxberrd, Shakxpere এবং Shackespe। এ-কথা সত্যি যে, রানী এলিজাবেথের সময়কার লোকজন বানান নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামাত না। কিন্তু বিভিন্ন নাম দেখে কারো কারো মনে হয়েছে যে, সাধারণত উইলিয়াম শেক্সপিয়ার নামে পরিচিত এবং ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে স্ট্র্যাটফোর্ড আপন-এভনে জন্মগ্রহণকারী মানুষটি, আর যিনি এতগুলো অসাধারণ নাটক ও কবিতা লিখেছেন, এ দুজন একই লোক নন।
শেক্সপিয়ার-রহস্য উদ্ঘাটনেচ্ছু কোনো গোয়েন্দা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হন সেগুলোর কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হলো: তার সময়ের লোকজন শেক্সপিয়ার সম্পর্কে এত কম কথা বলেন কেন? শেক্সপিয়ারের নাম লেখা রয়েছে এমন নথি বা কাগজপত্রের সংখ্যা খুব কম, তাছাড়া নাটকগুলোর হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না। আর স্ট্র্যাটফোর্ডে একজনও কেন জানতই না যে, তিনি একজন বিখ্যাত নাট্যকার ছিলেন? শেক্সপিয়ারের নাটকে প্রায়ই ফ্রান্স আর ইতালি, প্রাচীন গ্রিস আর রোম এবং আইনের নানা সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচের উল্লেখ থাকে। স্থানীয় গ্রামার স্কুলে পড়া এক বালক, যে কোনো দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়ায়নি এবং সম্ভবত কোনো দিন বিদেশে যায়নি, সে এত কথা কী করে জানল? স্কুল ছাড়ার পর নাট্যকার হওয়ার মাঝখানের দশটা বছর তিনি কী করেছিলেন? তার সমাধিতে কেন তার নামটা পর্যন্ত নেই? আদৌ কি এটা তার সমাধি? যতই প্রশ্ন করা যায়, প্রমাণ ততই ফিকে হয়ে আসে এবং সবকিছু মিলেমিশে গিয়ে দুটো বিশাল প্রশ্নে রূপ নেয়:
স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-এভনের উইলিয়াম শেক্সপিয়ারই কি এ নাটকগুলো লিখেছিলেন? যদি না লিখে থাকেন, তাহলে কে লিখেছেন? এ-বিষয়ক বিভিন্ন তত্ত্বের দিকে তাহলে নজর দেয়া যাক ।
ফ্রান্সিস বেকন (Francis Bacon) তত্ত্ব। ভদ্রলোক ছিলেন খুবই বিজ্ঞ একজন আইনবিদ, রাজনীতিক, ঐতিহাসিক এবং লেখক। এমনই তুখোড় ছাত্র ছিলেন যে, তিনি মাত্র বারো বছর বয়েসেই ক্যামব্র্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছিল তাকে এবং কিছুদিনের মধ্যেই তিনি অভিযোগ করতে শুরু করেন যে, কেউই আর তাকে কিছু শেখাতে পারছে না! ছাত্র থাকাকালীনই তিনি তার বন্ধুদের জন্য নাটকে নির্দেশনা দিতেন এবং কিছু কিছু (যদিও খুব ভালো নয়) কবিতা লিখতেন। তবে শেক্সপিয়ার গোয়েন্দাদের কাছে যে কারণে তিনি খুব আকর্ষণীয় ছিলেন, তা হচ্ছে ক্রিপ্টোগ্রাম তৈরি করতে পছন্দ করতেন বেকন। ক্রিপ্টোগ্রাম হচ্ছে সাংকেতিক সংবাদ বা তথ্য, যেখানে শব্দগুলো বইয়ের পাতায় খুব স্বাভাবিক মনে হলেও আসলে তার ভেতর গোপন কোনো তথ্য লুকিয়ে থাকে। আর সেটা শুধু সে-ই বুঝতে পারে, যার কাছে সেই সাংকেতিক ভাষা পড়ার মতো চাবিকাঠি থাকে। রানী এলিজাবেথের সময় রাজনীতিবিদরা এসব অনেক বেশি ব্যবহার করতেন, ইংল্যান্ডের শত্রু-দেশ ফ্রান্স বা স্পেনে থাকা তাদের গুপ্তচরের কাছে গোপন খবর পাঠানোর জন্য, যখন তারা মনে করতেন তাদের চিঠিগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত কেউ মাঝপথে পড়ে দেখতে পারে।
বরাবরই নাট্যকার হওয়ার ইচ্ছা ছিল বেকনের, কিন্তু তার বাবা চেয়েছেন তিনি আইনবিদ ও রাজনীতিবিদ হন। তার মানে হচ্ছে, বেকন এত ব্যস্ত থাকতেন এবং তিনি এতই গুরুত্বপূর্ণ একজন লোক ছিলেন যে, নাটক লেখার সময় তার হতো না। তাছাড়া তার নাটকের কোনো চরিত্র বা কোনো কাহিনীর কারণে রানী বা তার কোনো মন্ত্রী যদি কুপিত হন? কারো কারো ধারণা, অভিনেতা উইলিয়াম শেক্সপিয়ারকে তিনি টাকা দিতেন, যাতে শেক্সপিয়ার বেকনের লেখা নাটকে নিজের নাম ব্যবহার করার অনুমতি দেন এবং ভান করেন যেন তিনিই বেকনের লেখা নাটকগুলো লিখেছেন। তিনিই যে শেক্সপিয়ারের নাটকগুলোর আসল লেখক তার কিছু গোপন প্রমাণ বেকন হয়তো সেসব লেখার মধ্যে রেখে গেছেন এই ধারণার বশবর্তী হয়ে শেক্সপিয়ার-গোয়েন্দারা ক্রিপ্টোগ্রামের খোঁজে নাটকগুলোয় তন্ন তন্ন করে তল্লাশি চালিয়েছেন। কিন্তু তাতে যা পাওয়া গেছে সেটা রীতিমতো হাস্যকর। একটা লাইন এ রকম: ‘Shakst spur never wrote a word of them’। এটা আবার পাওয়া গেছে বেকনের নাম যেসব অক্ষর দিয়ে গঠিত, সেসব অক্ষর দিয়ে তৈরি শব্দের পাশে অক্ষরগুলো মিলিয়ে। আরেকটি হচ্ছে Love’s Labour Lost নামে শেক্সপিয়ারের এক নাটকে পাওয়া খুব দীর্ঘ একটি অর্থহীন বা ননসেন্স শব্দ (supercalifragilisticexpialidocious–এর মতো) ‘honorificabilitudinatibus’-এর অ্যানাগ্রাম। কোনো শব্দ বা শব্দগুচ্ছের অক্ষরগুলো এদিক-ওদিক করে সাজিয়ে তৈরি করা অন্য কোনো শব্দ বা শব্দগুচ্ছকে প্রথম শব্দ বা শব্দগুচ্ছের anagram বলে। rats ও ate যেমন যথাক্রমে star আর eat-এর অ্যানাগ্রাম। তো, এক গোয়েন্দা খেয়াল করলেন যে, শব্দটির একটি অ্যানাগ্রাম হচ্ছে ‘Franiiiiii Bacon’। তা, ছ’টা ‘i ’ কেন? কারণ ‘Fransix’ শোনায় ‘Francis’-এর মতো, বিশেষ করে যদি কেউ ফরাসি হয় এবং ‘Franceez’ উচ্চারণ করে। তো, এর মানে কেন এই হবে যে বেকন-ই শেক্সপিয়ারের নাটকগুলো লিখেছেন তা আমাদের মাথায় আসে না।
অক্সফোর্ডের আর্ল এডওয়ার্ড দে ভেরে (Edward de Vere, Earl of Oxford) তত্ত্ব। এ চিন্তাটা বেরিয়েছিল আশি বছর আগে, জে টমাস লুনি নামে এক স্কুলশিক্ষকের মাথা থেকে। তার ধারণা হয়েছিল, শেক্সপিয়ারের নাটকগুলো আসলে অক্সফোর্ডের আর্ল লিখেছিলেন। বেকনের মতো তিনিও অভিজাত শ্রেণীর মানুষ ছিলেন। এবং তিনিও লেখক হিসেবে জনসমক্ষে প্রকাশিত হতে চাননি। লুনি কিছু পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটার সময় লক্ষ করেছেন যে, রানীর কাছ থেকে আর্ল প্রতি বছর ১ হাজার পাউন্ডের মতো একটা বিরাট অঙ্ক পেতেন। কিন্তু নথিপত্রে উল্লেখ নেই কেন তাকে এ অর্থ দেয়া হতো। এবং লুনির অনুমান, গোপনে টিউডর রাজবংশের সমর্থনে লেখা প্রোপাগান্ডামূলক নাটক লেখার পারিশ্রমিক হিসেবেই নিশ্চয়ই অর্থটি দেয়া হতো।
কী প্রমাণ ছিল তার হাতে? রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট নাটকের একটি লাইন: ‘আই অ্যাম আ ক্যান্ডল-হোল্ডার’। ক্যান্ডল হোল্ডারের একটি এলিজাবথীয় প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘ট্রেস্ল্’ (trestle)। অক্সফোর্ডের আর্লের দাদির নাম ছিল এলিজাবেথ ট্রেসেল। কাজেই লাইনটা হচ্ছে— ‘আমি ট্রেসেল পরিবারের একজন’ এ কথাটির সাংকেতিক রূপ। হাজার হাজার লাইনের মধ্যে মাত্র একটা লাইন? এর নাম প্রমাণ?
অক্সফোর্ডের আর্ল মারা যান ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে, শেক্সপিয়ার মারা যাওয়ার বারো বছর আগে। এমনকি এই অসঙ্গতিজনক তথ্যও লুনি সাহেবকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। তার কথা হলো, ১৬০৪-এর পর শেক্সপিয়ারের যেসব নাটক রচিত হয়েছে বলে মনে করা হয়, সেগুলো আসলে অক্সফোর্ডের আর্ল নিজের মৃত্যুর আগেই লিখে রেখে গিয়েছিলেন; তবে সেগুলো একটা ড্রয়ারে রাখা ছিল, যাতে অভিনেতারা সেসব নাটকে অভিনয় করতে পারেন! আরেকটা কথাও লুনি সাহেব বলছেন। অক্সফোর্ডের আর্লের কোট অব আর্মসের সিংহটি একটি বর্শা (Spear) ধরে আছে, এমনকি সেটা নাকি ঝাঁকাচ্ছেও। কাজেই তিনিই নিশ্চয়ই শেক্সপিয়ার। হতেই হবে, কারণ ইংরেজি Loony শব্দের মানে যে উন্মাদ।
ক্রিস্টোফার মার্লো (Christopher Marlow) তত্ত্ব। এটা বরং অনেক বেশি আকর্ষণীয়। মার্লো ছিলেন ক্যান্টারবেরির এক দরিদ্র মুচির সন্তান। জন্ম ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে, অর্থাত্ শেক্সপিয়ারের জন্মের বছরেই। আশ্চর্য রকমের চালাক-চতুর ছিলেন মার্লো, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বৃত্তিও জুটিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কোর্সের মাঝপথে হঠাত্ ইংল্যান্ড ত্যাগ করে ফ্রান্সে চলে যান। শিক্ষার্থী পাদ্রি হিসেবে থিতু হন র্যান্সে (ইংরেজিতে যে স্থানটির নাম রিম্জ্, Rheims)। আসলে ইংরেজ সরকারের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তিতে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। রানী এলিজাবেথের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে ভাবা হচ্ছিল এমন কিছু বিদ্রোহীর গতিবিধি ও ক্রিয়াকলাপের দিকে নজর রাখছিলেন তিনি!পরে তিনি লন্ডনে ফিরে যান; সেখানে একদিন রাস্তায় বিচ্ছিরি এক কলহে লিপ্ত হন, যার পরিণতিতে একজন লোক খুন হয়ে যায়। মার্লোর বরাত ভালো, খুনের অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করার মতো যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি, কাজেই পার পেয়ে যান তিনি। তার পর ১৫৮০-র দশকের শেষ দিকে— তখনো শেক্সপিয়ার ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেননি— ডক্টর ফস্টাস-এর মতো বিক্ষুব্ধ আর ভয়ঙ্কর নাটকের বিখ্যাত লেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। শেক্সপিয়ারের সঙ্গে মার্লোর কোনো দিন দেখা হয়েছিল এমন কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু একই সময়ে একই শহরে বাস করেও এমন বিখ্যাত দুই নাট্যকার একে অন্যকে জানতেন না— এমনটি ঘটা খুবই আশ্চর্যজনক।
শেক্সপিয়ার-গোয়েন্দাদের বিশ্বাস, মার্লোর দ্বিতীয় একটি জীবন ছিল; অন্ধকার অপরাধ জগতের দুষ্ট লোকজনের সঙ্গে মেলামেশার পাশাপাশি গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। ১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে একটা বড়সড় ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। রানীর সরকারের সমালোচনা এবং ঈশ্বর ও খ্রিস্ট ধর্ম সম্পর্কে এলিজাবেথীয় ইংল্যান্ডের আইনের একেবারেই পরিপন্থী মতামত প্রকাশ করে লন্ডনের আশপাশে কিছু লিফলেট বিলি হচ্ছিল। এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত কেউ ধরা পড়লে তার ভাগ্যে মৃত্যু ছিল অবধারিত, অবশ্য তার আগে বাড়তি পাওনা হিসেবে জুটত নিদারুণ অত্যাচার, দিনের পর দিন।
তো, এসব লিফলেটের রচয়িতা হিসেবে যাকে ভাবা হচ্ছিল তিনিও ছিলেন আরেক নাট্যকার, নাম টমাস কিড। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করা হলে তিনি দাবি করলেন, মার্লোই এ কাজের জন্য দায়ী (সম্ভবত ঠিকই বলেছিলেন তিনি)। মার্লোকে ডাকা হলো করাল ‘কোর্ট অব দ্য স্টার চেম্বার’-এর সামনে, কিন্তু সেই কলহের ঘটনাটির মতো এবারো তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেল না। কাজেই ছেড়ে দেয়া হলো তাকে। তার পর তার বিরুদ্ধে অন্য কিছু সাক্ষ্য পাওয়া গেল এবং তখন আরো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে গ্রেফতারের আদেশ দেয়া হলো। ক্রমেই খুব জটিল ও উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল পরিস্থিতি। যা-ই হোক, ঠিক সেদিনই তিনজন দুর্বৃত্ত ধরনের লোকের সঙ্গে দেখা হয় মার্লোর; তারা হচ্ছে নিকোলাস স্কেরেস, রবার্ট পলি আর ইংগ্রাম ফ্রিজার। সবাই মিলে বেশ কিছুক্ষণ মদ্যপান করা হয় এবং রাতের খাবারের পর, কে বিল দেবে তাই নিয়ে তাদের মধ্যে এক তুমুল ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়। শেষে, ক্রুদ্ধ মার্লো একটা ছোরা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন ফ্রিজারের ওপর। ফ্রিজার মার্লোর হাতটা ধরে ফেলে ছুরিটা সোজা চালিয়ে দেয় মার্লোর খুলির ভেতর, তার ডান চোখের ওপর। তত্ক্ষণাত্ মৃত্যু ঘটে তার। ফ্রিজারকে গ্রেফতার করা হয়, কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য সে খুন করতে বাধ্য হয়েছে এ কারণ দেখিয়ে পরে ছেড়েও দেয়া হয় তাকে। অথবা এভাবেই গল্পটা ছড়ায়।
শেক্সপিয়ার-গোয়েন্দাদের ধারণা কিন্তু অন্য রকম: মার্লোর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, নাম টমাস ওয়ালসিংহ্যাম। সিক্রেট সার্ভিস বা গুপ্তচর সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তার। কিন্তু মোটের ওপর সুবিধের লোক ছিল না সে। তার আইনবিরোধী কার্যকলাপের খবর মার্লোর জানা ছিল। অত্যাচারের মুখে মার্লো বন্ধুর দুষ্কর্মগুলোর কথা ফাঁস করে দিতে পারেন এই ভয়ে ওয়ালসিংহ্যাম ঠিক করে প্রোটেস্টান্ট ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ক্যাথলিকদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তির কাজে মার্লোকে ইউরোপে কাজে লাগানো যায়; সবাই তাকে মৃত মনে করলে তো কথাই নেই। কাজেই শেক্সপিয়ার-গোয়েন্দারা মনে করেন, ওয়ালসিংহ্যাম-ই মার্লোর মৃত্যুর এ ঘটনাটা সাজায়। নাটকের মতো পুরো ঘটনাটাই বানানো। পলি, স্কেরেস আর ফ্রিজার আসলে ওয়ালসিংহ্যামেরই লোক, তারই নানা দুষ্কর্মের সহযোগী। নিহত লোকটি মার্লো নন আদৌ, অপহূত এক হতভাগ্য লোক, যার রক্তমাখা মরদেহটি তড়িঘড়ি করে কফিনে পুরে ফেলা হয়েছিল। কেউই এ নিয়ে কোনো হইচই করেনি। সে সময়ে এসব ঘটনা ঘটানো মোটেই কোনো কঠিন কাজ ছিল না।
শেক্সপিয়ার-গোয়েন্দাদের তত্ত্ব অনুযায়ী, এই অবসরে মার্লো ইউরোপে পালিয়ে গেলেন এবং পরবর্তী বিশ বছর ছদ্মনাম ধারণ করে তার গুপ্তচরবৃত্তি ও নাট্যরচনা দুটোই চালিয়ে গেলেন, উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের নামটা ব্যবহারের জন্য ভদ্রলোককে নিয়মিত কিছু টাকা ঘুষ দিয়ে। এমনকি হয়তো শেক্সপিয়ারের কাছে নাটকের পাণ্ডুলিপিও পাঠিয়েছিলেন তিনি এবং শেক্সপিয়ারের নিজের হাতে সেগুলোর অনুলিপি তৈরি করার জন্য নগদ নারায়ণও দিয়েছিলেন তাকে। শেক্সপিয়ার কেন তার লেখালেখি বিষয়ে রহস্যময় নীরবতা বজায় রাখতেন এবং কেন তার সম্পর্কে লোকজন বিশেষ কিছু জানে না, তা এ থেকেই বোঝা যায় নিশ্চয়ই। তিনি ছিলেন মার্লোর শিখণ্ডী এবং কেউ তাকে বিষয়টা নিয়ে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর প্রশ্ন করুক, সেটা তিনি চাইতেন না। কী, বিশ্বাস হয়েছে?
বছর পঞ্চাশ আগে, কেলভিন হফম্যান নামে মার্কিন দেশের এক শেক্সপিয়ার-গোয়েন্দা কেন্টের চিজেলহার্স্ট নামে একটি স্থানের সেন্ট নিকোলাস গির্জায় ওয়ালসিংহ্যামদের পারিবারিক কবর খুলে দেখার অনুমতি পান। হফম্যান আশা করেছিলেন সেখানে সেই পাণ্ডুলিপিগুলো থাকবে, যাতে করে প্রমাণ হবে যে মার্লোই শেক্সপিয়ারের নাটকগুলোর প্রকৃত লেখক। কিন্তু রাশি রাশি বালু ছাড়া আর কিছু্ই পাননি তিনি।
সনেট। রহস্যের খনিটি এখানেই এবং শেক্সপিয়ার-গোয়েন্দারা যে এ ব্যাপারে কত শত ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
টমাস থর্প নামে একজন ব্যক্তি ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে ১৫৪টি ছোট কবিতা প্রকাশ করেন (তার মধ্যে অবশ্য একটি দীর্ঘ কবিতাও ছিল)। বইটির নাম ছিল Shake-Speares Sonnets। বেশির ভাগ মানুষই মনে করেন যে, প্রকাশের পনেরো বছর আগে শেক্সপিয়ারই কবিতাগুলো লিখেছিলেন। বইটিতে মুদ্রণ প্রমাদের এমনই ছড়াছড়ি যে, বেশির ভাগ লোকই মনে করে বইটি সম্পর্কে শেক্সপিয়ার বিন্দুবিসর্গ অবহিত ছিলেন না। সে যুগে এমনটি ঘটা মোটেই অসম্ভব ছিল না।
তো, বইটির প্রথম পৃষ্ঠায় এই অদ্ভুত কথাগুলো লেখা ছিল:
TO.THE.ONLY.BEGETTER.OF.
THESE.ENSUING.SONNETS.
Mr.W.H.ALL.HAPPINESS.
AND. THAT.ETERNITY.
PROMISED.
BY.
OUR.EVER-LIVING.POET.
WISHETH.
THE.WELL-WISHING.
ADVENTURERER. IN.
SETTING.FORTH.
1.T.
কী ছাই অর্থ এর? সহজেই বোঝা যায়, T. T. হচ্ছে টমাস থর্পের আদ্যক্ষর। কিন্তু স্বাক্ষরের মতো করে পৃষ্ঠার শেষে বসে থাকা অক্ষর দুটো কি এটা বোঝায় যে, তিনিই উপরের কথাগুলো লিখেছেন? আর প্রতিটি শব্দের পরে ফুলস্টপ দেয়াটা খুবই বিভ্রান্তিকর। ‘Wisheth the well-wishing adventurerer in setting forth’ মোটেই শুদ্ধ ইংরেজি নয়। কোনো শব্দ কি বাদ পড়েছে এখানে? অভিধান বলছে, ‘beget’ শব্দের অর্থ জন্ম দেয়া। ‘only begetter’ শব্দটি কি আসলেই যিনি সনেটগুলো লিখেছেন তাকে বোঝাচ্ছে, নাকি তাকে যিনি কবিকে সেগুলো লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন? T. T.-ই কি ‘only begetter’? আর Mr W. H.-টাই বা কে? ‘Mr W. S.’ নয় কেন? নাকি ওটা Mr W. S.-ই বোঝাচ্ছে? ‘H’-টা ভুল করে পড়ে গেছে মুদ্রাকরের ভুলে? নাকি লেখাটা Mr W. SH. হবে?
শেক্সপিয়ার-গোয়েন্দারা এটা নিয়ে দীর্ঘদিন ধন্দে থাকলেও কেউই কোনো সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছাতে পারেননি। Mr W. H.— হুম্ম্। উনি কি হেনরি রোজলি, সাদাম্পটনের আর্ল? গোপনীয়তার জন্য আদ্যক্ষর ব্যবহার করেছেন? কিন্তু কেন তিনি তার পরিচয় গোপন করতে চাইবেন? এদিকে আবার উইলিয়াম হার্বাট নামে আরেকজন আর্ল ছিলেন, পেমব্রুকের আর্ল, যাকে হয়তো শেক্সপিয়ার চিনতেন। তিনিই কি Mr W. H.? কিন্তু তিনি আর্ল হলে তাকে সাদামাটা ‘মি.’ বলে ডাকা হচ্ছে কেন? এলিজাবেথের সময় কেউ কোনো অভিজাত শ্রেণীর কাউকে কোনো বই উত্সর্গ করলে তাকে ‘মাই নোব্ল লর্ড’ বলে অভিহিত করে, নিজেকে তার অনুগত দাস ইত্যাদি বলে পরিচয় দিয়ে আরো ঢাকঢোল পিটিয়ে করতেন কাজটা। নাকি Mr W. H. হচ্ছেন রোজলির সত্ পিতা উইলিয়াম হার্ভে? নাকি শেক্সপিয়ারের শ্যালক উইলিয়াম হ্যাথাওয়ে?
এছাড়া আরো কিছু তত্ত্ব আছে। অক্সফোর্ডের আর্ল এডওয়ার্ড দে ভেরে-র পরিবারের কুলচি জ্ঞাপক ফলক বা হেরাল্ডিক শিল্ডে মূলমন্ত্র হিসেবে একটি লাতিন শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে— ‘Nil vero verius’ (সত্যের চেয়ে বড় সত্য কিছু নেই)। এটা হচ্ছে ‘OUR.EVER.LIVING’-এর অ্যানাগ্রাম (প্রায়)। কাজেই সেটার অর্থ হতে পারে আর্ল-ই সনেটগুলো লিখেছেন। যিনি এখনো বেঁচে আছেন তাকে ‘এভার লিভিং’ বলে অভিহিত করা নিশ্চয়ই বেশ অদ্ভুত, কারণ বিশেষণটা সাধারণত ব্যবহার করা হয় মৃত কারো বেলায়, যিনি স্বর্গে ‘চিরজীবী হয়ে আছেন’। অক্সফোর্ডের আর্ল মারা গিয়েছিলেন ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে, সনেটগুলো প্রকাশিত হওয়ার পাঁচ বছর আগেই। আবার একটি সনেটে (সঠিকভাবে বললে, ৭৬ নম্বর সনেটে) কিছু কথা আছে, যা রীতিমতো সন্দেহজনক।
Why write I all still one, ever the same,
And keep invention in a noted weed,
That every word doth almost tell my name.
প্রথম চরণের ‘Ever’ শব্দটি ‘Vere’ শব্দের অ্যানাগ্রাম। ‘weed’ হচ্ছে একটা ছদ্মবেশ; আর ‘every word’-এর একটা অ্যানাগ্রাম (Eyword ver) তো প্রায় ‘Edward de Vere’-এর কাছাকাছি চলে যায়। তবে শত হলেও, ‘Eyword ver’ আর ‘Edward de Vere’ হুবহু এক হলো না। যদিও তা কিছু একটা ইঙ্গিত দেয়ার মতো যথেষ্ট রহস্যময়। তবে সবচেয়ে রহস্যময় ব্যাখ্যা হলো, Mr W. H. হচ্ছে Mr William Hall, (‘Mr W.H. ALL.HAPPINESS’)— যা কিনা শেক্সপিয়ারের সাংকেতিক নাম। কিন্তু তার সাংকেতিক নাম থাকতে হবে কেন? কারণ তিনি নিজেও ছিলেন ওয়ালসিংহ্যাম আর মার্লোর মতো একজন গুপ্তচর। প্রমাণ চাই বুঝি? সরকারি নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে, ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম হল ও উইলিয়াম ওয়াইট নামের দুজনকে ১৫ পাউন্ড দেয়া হয়েছিল নেদারল্যান্ডসে কিছু গোপন সংবাদ বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আরেকটি পুরনো নথি থেকে জানা যাচ্ছে, পরের বছর উইলিয়াম ওয়াইট (একই লোক?) উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বিরুদ্ধে একটা মামলা করেছেন। চার বছর পর, উইলিয়াম হল নামের একজন লোক, সম্ভবত অন্য কোনো গোপন মিশন নিয়ে ডেনমার্ক ভ্রমণ করছেন বলে জানা যায়। তো, সেই বছরই ডেনমার্ককে পটভূমি করে কোনো নাটক লেখা হয়েছিল? শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট! নিশ্চয়ই এটা আরেকটা অদ্ভুত কাকতালীয় ব্যাপার… এবার আপনারাই ভাবতে থাকুন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার কে ছিলেন।
( রুপার্ট ক্রিস্টিয়ানসেনের ‘হু ওয়াজ উইলিয়াম শেক্সপিয়ার?’ অবলম্বনে )
[asa]B018E7HF44[/asa]