বগুড়া পি টি আই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র মোবারক আলীর প্রতি সব শিক্ষকদের একটা বিশেষ সহানুভূতি সব সময় থাকে। ছেলেটি ভয়ানক ধরনের মেধাবী, অনেক জটিল অংক নিমিষেই করে দিতে পারে। লেখালেখিতেও মারাত্মক হাত। শুধু বানানের ক্ষেত্রে সমস্যা, লিখতে গেলে অজস্র বানান ভুল হয়। একমাত্র এই সমস্যার কারণে মোবারক আলীকে প্রগ্রেস রিপোর্টে মেধা তালিকায় কখনো দেখা যায় না। অবশ্য, তা নিয়ে মোবারক আলীর মনে বিন্দুমাত্র খেদ নেই।
ক্লাসের অন্যান্য ছেলেমেয়েরা যখন বাংলা ইংরেজিতে রচনা মুখস্থ করতে করতে মুখের ছাল তুলে ফেলে তখন মোবারক আলী অনায়াসে নিজের মতো করে হড়হড় করে পুরো রচনা লিখে ফেলে। একবার বাংলা হেড পন্ডিত স্যার ক্লাসে এসে ভাবসম্প্রসারণ করতে দিলেনঃ ‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই, “কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই,
আমি থাকি……..।”
ক্লাসের বাঘা বাঘা ছাত্র-ছাত্রী হারুন, রবিন, সালমা সবাই ভিষণ বিপদে পড়ে গেল। এদের কেউই এটি মুখস্থ করা তো দুরের কথা জীবনে কখনো পড়েই দেখেনি। সবাই যখন কান, চুল ইত্যাদি চুলকানো নিয়ে অযথা সময় ক্ষেপণ করছে, তখন মোবারক আলী গটগট করে এক পাতা লিখে ফেলল। সৌভাগ্যবশতঃ স্যার খাতা দেখতে চায়নি, তাহলে অজস্র ভুল বানান দেখে স্যার নিশ্চয়ই ক্ষেপে যেতেন। স্যার বললেন, ‘ কি লিখেছিস ওখান থেকে দাঁড়িয়ে পড়।’ মোবারক আলী তার খাতা দেখে দেখে যা পড়ল তা শুনে পুরো ক্লাস একেবারে হতভম্ব। পন্ডিত স্যার মুগ্ধ হয়ে মোবারক আলীকে জড়িয়ে ধরে প্রায় কেঁদেই ফেললেন।
প্রাইমারি শেষ করে মোবারক আলী অনেক বন্ধুদের তাক লাগিয়ে বগুরা জিলা স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো। হাইস্কুলে এসেও সেই একই অবস্থা। মুখে মুখে পড়ালেখা বিষয়ে ক্লাসে স্যারদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারায় মোবারক আলী সহজেই সব স্যারদের নজর কেড়ে নিল। কিন্তু পি টি আই স্কুলের মতো এখানেও অজস্র বানান ভুলের কারণে মোবারক আলীকে মেধা তালিকা তো দূরের কথা পারীক্ষায় পাশ নিয়ে টানাটানি অবস্থা দিয়ে যেতে হচ্ছে।
বগুড়া জিলা স্কুলের নিয়ম হলো, ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষায় কেউ এক বিষয়ে ফেল করলেই ক্লাস নাইনে তাকে আর সায়েন্স দেওয়া হয় না। মোবারক আলী ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষায় অংকে একানব্বই নম্বর পেয়েও বাংলা ইংরেজিতে ফেল করায় সায়েন্সে চান্স পেলনা। অংকের শিক্ষক জনাব মজিদ স্যার হেডস্যারের কাছে যেয়ে মোবারক আলীর সায়েন্সে চান্সের ব্যাপারে অনেক তদবির করলেন। হেডস্যার, বাংলা ও ইংরেজির শিক্ষকদের ডেকে এনে মোবারক আলীর খাতা দেখতে চাইলেন। হেডস্যার খাতা দেখে আকাশ থেকে পড়লেন। যে ছেলে অংকের মত এত কঠিন বিষয়ে একানব্বই পেল, সে ছেলের খাতায় এত অজস্র বানান ভুল!!
মোবারক আলীর আর সায়েন্স পড়া হলনা। মোবারক আলীকে কমার্সে চান্স দেওয়া হলো। অংকের শিক্ষক মজিদ স্যার মোবারককে বিশেষ স্নেহ করতেন। মজিদ স্যার মোবারক আলীকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘মোবারক, জীবনটা অনেক বড়ো। সায়েন্সে চান্স না পেয়ে মন খারাপ করিস না, অংকে তোর মাথা অনেক ভালো। দেখবি কমার্সে ভাল করতে পারবি। আর, তাছাড়া তোর বাপতো ব্যবসায়ী মানুষ। কমার্স নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে বাপের ব্যবসা আরও বড়ো করতে পারবি।’
মোবারক আলীর খুব শখ ছিল ইঞ্জিনিয়ার হবে। তাই, সায়েন্সে চান্স না পেয়ে বেচারা কাঁদতে কাঁদতে বাসায় গেল। মোবারক আলীর বাবা সরফরাজ আলী মাঝারি ব্যবসায়ী। টিন পট্টিতে উট মার্কা ঢেউ টিনের পাইকারি বিক্রেতা। তার একমাত্র সন্তান মোবারক আলীর লেখা পড়ার ব্যাপারে একেবারেই আগ্রহ নেই। সরফরাজ আলীর ইচ্ছা, ছেলে কোনোমতে মেট্রিক পাশ দিলে দোকানে বসিয়ে নিজ হাতে ছেলেকে ব্যবসা করা শেখাবে। তাই, রাতের বেলা খেতে বসে সরফরাজ আলী যখন ছেলেকে দেখতে পেলনা, স্ত্রী মোসাম্মত ঝরনা বেগমকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মোবারক কই?’
লোডশেডিং এর কারণে বাসায় ইলেক্ট্রিসিটি নেই। ঝরনা বেগম হাত পাখা দিয়ে স্বামীকে বাতাস করতে করতে বুঝিয়ে বললেন, ‘সায়েন্সে চান্স না পেয়ে মোবারক ভাত না খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে।’ সরফরাজ আলী ভাত খেতে খেতে শুধুমাত্র ‘ও আচ্ছা’ বলে পরম মনোযোগ দিয়ে হ্যারিকেনের আলোয় কই মাছের কাঁটা বাছার ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
মোবারকের আরেকটা বিশেষ গুণ ছিল, সেটা হচ্ছে মোবারক সুন্দর কেরাত পড়তে পারত। ক্লাস টেনে জেলা পর্যায়ে আন্তঃস্কুল কেরাত প্রতিযোগিতায় মোবারক আলীকে জেলা স্কুল থেকে মনোনীত করা হলো। জেলাপরিষদ মিলনায়তনে বিশাল আয়োজন। মোবারক আলীকে উৎসাহ দেওয়ার জন্যে মোবারকের সাথে অংকের শিক্ষক মজিদ স্যারও এসেছেন। মজিদ স্যার নিজের পয়সায় ডাব কিনে এনে কাটা ডাবের মধ্যে স্ট্র ঢুকিয়ে হাতে ধরে মোবারকের পাশে বসে আছে। মোবারক আলীকে সাহস দেওয়ার জন্য মজিদ স্যার বললেন, ‘বাবা, কচি ডাবের পানি খেয়ে একটু গলা ভিজে নে, আর শোন, একেবারে ঘাবড়াবি না৷ নিজের মতো করে স্বাভাবিকভাবে কেরাত পড়ে যাবি। আমি নিশ্চিত, তুই ফাস্ট হবি।’
একে একে অনেকেই সুন্দর করে কেরাত পড়ল। এবার মোবারকের পালা। ঘোষণা এল, ‘এবার বগুড়া জিলা স্কুলের প্রতিযোগী তোবারক আলিকে সামনে এসে কেরাত পড়তে বলা হচ্ছে। ‘মজিদ স্যার তাৎক্ষণিক উঠে দাঁড়িয়ে বললেনঃ ‘একটু ভুল হচ্ছে। তোবারক এর জায়গায় এটি মোবারক হবে। ‘কিন্তু কে কার কথা শোনে, পরিচালনায় যারা দায়িত্বে ছিলেন কিছুতেই মানতে রাজি না। তারা স্কুল থেকে পাঠানো লিস্ট বের করে দেখালেন৷ পরিষ্কার করে লেখা আছে, তোবারক আলি, দশম শ্রেণি, বগুড়া জিলা স্কুল। বেচারা মোবারকের আর কেরাত পড়া হলনা। মজিদ স্যার রিকসা নিয়ে মোবারক আলীকে বাসায় পৌঁছে দিতে যাওয়ার সময় বললেন, ‘তোর কপালটাই আসলে খারাপ মোবারক, বানান ভুলের জন্য তোকে সায়েন্সে পড়তে দেওয়া হলো না। এবার দেখ, স্কুলের গাফেলতির জন্য তোর নামের বানান ভুল করে পাঠানোর কারণে আজ তোর কেরাতের প্রথম পুরস্কার পাওয়া হলো না।’
মোবারক আলী কপাল খারাপের এই ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে পারল না। অনেক অনেক ভালো ছাত্রদের চেয়েও ভালো করে পড়াশোনা করেও এতদিন শুধু বানান ভুলের কারণে কখনো ভালো রেজাল্ট করতে পারেনি। এমনকি, এই বানান ভুলের জন্য তার সায়েন্স না পড়ায় ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নের মৃত্যু ঘটেছে। এতদিন বহুবার তার বানান ভুলের দায় নিজের কাঁধে নিলেও আজ স্কুলের গাফিলতির জন্য তার নামের বানানের ভুলের কারণে কেরাতের প্রথম পুরস্কার হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ায় আজকের এই ভুল বানানের দায় কিছুতেই মোবারক আলী নিজের ঘাড়ে নিতে চাইল না।
তবে একটি জিনিস লাভ হয়েছে। বানান ভুল যে তার স্বপ্নের জীবনকে ক্রমাগতই এলোমেলো করে দিচ্ছে, সেটা ভেবে মোবারক আলী বাসায় এসে চোখ-মুখ শক্ত করে সিদ্ধান্ত নিল যে করেই হোক তাকে সঠিকভাবে বানানের নিয়ম-কানুন শিখতেই হবে। মোবারক আলী খাতা কলম নিয়ে বসে এক, দুই করে অনেকগুলো পদক্ষেপের তালিকা করল,
১. বাবাকে বলে বাজার থেকে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ডিকশনারি কিনতে হবে।
২. ইন্টারনেটে নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ে কঠিন শব্দগুলোকে নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী একটা আলাদা খাতায় লিখে রাখতে হবে।
৩. বই পড়ার সময় কোন শব্দের বানান জটিল মনে হলে সেগুলিকেও খাতায় লিখে রাখতে হবে।
৪.বাহিরে রাস্তা ঘাটে বের হলে সাইনবোর্ডগুলো ভালো করে পড়ে দেখবে। সন্দেহ হলে বাসায় এসে ডিকশনারির সাথে মিলিয়ে নেব।
৫. প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে বানানের খাতায় চোখ বুলিয়ে তবেই ঘুমাতে হবে। প্রয়োজনে কঠিন শব্দগুলোর নিচে লাল কালি দিয়ে দাগ দিয়ে রেখে সেগুলোর প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হবে।
মোবারক আলী আদা-জল খেয়ে সঠিকভাবে বানান লেখার ব্যাপারে একেবারে প্যালেস্টাইনি কায়দায় যুদ্ধ ঘোষণা করল। প্রায় সাত থেকে আট মাসের মধ্যে মোবারক আলী ফলাফল পেয়ে গেল। ক্লাসের বাণিজ্যিক গ্রুপে বরাবর প্রথম হতো নরেস, দ্বিতীয় হতো পলাশ। এবার স্কুলের প্রিটেস্ট পরীক্ষায় সবাইকে তাক লাগয়ে বানিজ্যিক গ্রুপে পলাশকে টপকিয়ে মোবারক আলী ২য় স্থান অধিকার করল। মজিদ স্যার, হাই স্যার, আফজাল স্যার, এমনকি রাগী হেডস্যারও মোবারক আলীকে প্রচুর উৎসাহ দিতে থাকলেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষার প্রায় মাস ছয়েক আগে টেস্ট পরীক্ষায় নরেসকে হটিয়ে মোবারক আলী কমার্স গ্রুপে একেবারে ফার্স্ট হয়ে কেলেংকারী কান্ড ঘটিয়ে ফেলল। এবার, হেডস্যার এসিস্ট্যান্ট হেডস্যারকে মোবারকের দিকে আরও নজর দেওয়ার জন্যে বিশেষ দায়িত্ব দিলেন যাতে মোবারক আলী মেট্রিক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করে। এসিস্ট্যান্ট হেডস্যার আরও কয়েকজন শিক্ষকদের নিয়ে স্কুল চত্বরে দুই ঘন্টা করে মোবারক আলীকে কোচিং করানো শুরু করে দিলেন।
প্রায় মাঝরাতে আজ বগুড়া শহরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। রিকসা থেকে নেমে মোবারকের বাসার দরজার সামনে আসতেই ছাতা মাথায় দেওয়া সত্ত্বেও হেডস্যার ও মজিদ স্যার ভিজে চুপসে একাকার। তারপরও ভেজা কাপড়ের ব্যাপারে উত্তেজনায় অনাদের কোনো হুস নেই। একটু আগে মেট্রিক পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে। মোবারক আলী কমার্স বিভাগ থেকে রাজশাহী বোর্ডে ১ম স্থান অধিকার করেছে। হেডস্যার তাই মজিদ স্যারকে নিয়ে আনন্দে উল্লসিত হয়ে নিজ মুখে খবর দেওয়ার জন্যে মোবারকের বাসায় এসেছেন। মোবারকের বাবা দরজা খুলতেই হেডস্যার চেঁচিয়ে বললেন, ‘ ভাইজান, মোবারক আলীকে একবার ডাকুন। ও আমাদের সবার মুখ উজ্জ্বল করেছে।’
মোবারক আলীকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই মজিদ স্যার মোবারক আলীকে জাপ্টে ধরে উচ্চশব্দে কেঁদে ফেললেন। হেডস্যার মোবারক আলীর বাবার দুই হাত ধরে বললেন, ‘ভাইজান, আমাকে মাফ করে দিন। আপনার ছেলেকে সায়েন্সে চান্স দেওয়া হয়নি তাতে কী! দেখেন, মোবাররক আলী আজ আমাদের সবার মুখ উজ্জ্বল করেছে। ও পুরা রাজশাহীর বোর্ডের মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে। দেখবেন, কাল সকালেই সাংবাদিকেরা আপনাদের সবার ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য আপনাদের বাসায় হাজির হবে। আপনাদের অনেক ব্যস্ততার মধ্যে কাটাতে হবে। এখন শুয়ে পড়ুন। কাল দুপুরে আপনি ভাবিজানকে নিয়ে স্কুলে প্লিজ আসবেন৷ আমরা মোবারক আলীসহ আপনাদেরকে বিশেষ সংবর্ধনার ব্যাবস্থা করেছি।’
মোবারক আলীর মা ঝরনা বেগম দরজার ওপাশ থেকে সব শুনে মুখে আঁচোল দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। মাত্র দুবছর আগে তাদের ছেলে সায়েন্সে চান্স না পেয়ে ভাত না খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। সময় মানুষকে বদলিয়ে ফেলে।
মাঝরাতে, টিনের ব্যবসায়ী জনাব সরফরাজের বাসায় কিছু মানুষের আনন্দের, সুখের কান্নার শব্দাবলি রাতের নিস্তব্ধতায় বারান্দার টিনের উপর বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দকে ছাপিয়ে পাড়ায় সবার কাছে অগোচরে থেকে গেলেও মোবারক আলীর পড়ার ঘরের টেবিল, চেয়ার, আসবাবপত্র, শোবার ঘরের বিছানা বালিশ সবকিছুসহ টেবিলে রাখা লাল মলাটে আবৃত শুদ্ধ বানানের খাতাটি অজস্র ভুল বানানের বিরুদ্ধে মোবারক আলীর যুদ্ধ -জয়ের এই ঐতিহাসিক ঘটনাটির নীরব সাক্ষী হিসাবে থেকে গেল।
————-
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন, রেজিস্টার্ড সোস্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার, টরেন্টো