‘দোস্তরা, রংপুরের খবর ভালো না। এই মাত্র শুনলাম, আবু সাঈদ নামের এক ছাত্রকে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমরা মেধা থাকা সত্ত্বেও কোটা সিস্টেমের প্যাচে পড়ে চাকরি পাবো না, এ হয় না। এই কোটা সিস্টেমের সংস্কার চাইতে যেয়ে লাশ হয়ে ঘরে ফিরলো আজ আবু সাঈদ। তোদের বগুড়াতেও শুনলাম ভালোই আন্দোলন হচ্ছে। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে পরিমল খানিকটা থেমে বললো, ‘দোস্তরা, আমরা সব ছাত্ররা একজোট হয়ে ঢাকায় আন্দোলন করছি, ঘরে বসে না থেকে তোরাও তোদের ওখানে মিছিলে যোগ দে।’
কথোপকথন চলছিল রাজন, আফতাবের এবং পরিমলের মধ্যে। রাজন, আফতাব, লিটন আর পরিমল একেবারে বাল্যকালের বন্ধু। সবারই বাড়ি বগুড়া শহরের রহমান নগর এলাকায়। প্রথমে পিটিআই প্রাইমারি স্কুল, তারপরে, বগুড়া জিলা স্কুল। কলেজে এসে ছাড়াছাড়ি। এসএসসিতে অপেক্ষাকৃত ভালো রেজাল্ট করায় লিটন আর পরিমল ভর্তি হয়েছে ঢাকা কলেজে, আর রাজন ও আফতাব ভর্তি হয়েছে বগুড়া সরকারি আযিযুল হক কলেজে। এরও পরে লিটন এইচ এস সি দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসেবে কানাডার টরেন্ট শহরে ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ডিজিটাল মিডিয়া নামের একটি আন্ডারগ্রাজুয়েট প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছে। পরিমল ভর্তি হয়েছে ঢাকা ইউনিভার্সিটির সোসিওলজি ডিপার্টমেন্টে। আর রাজন আর আফতাব আযিযুল হক কলেজে একাউন্টিংয়ে অনার্স নিয়ে পড়ছে।
ক্যারিয়ার গঠনের জন্যে চার বন্ধু পরস্পর থেকে ভৌগোলিক দূরত্বে আলাদা থাকলেও মনের দিক থেকে সেই একইরকম অবস্থাতেই আছে। এঁদের ছেলেবেলায় কেটেছে স্মার্ট ফোন হাতে নিয়ে। ঘুম ভেঙেই এঁরা অন্তত একবার TikTok, Twitter , Instagram ইত্যাদিতে ঢুঁ মারবেই। ফোনে প্রচুর সময় ব্যয় করার কারণে বাবা-মায়েরা এঁদের উপর কিছুটা বিরক্ত প্রকাশ করলেও এঁদের তেমন কিছুই যায় আসে না। এঁরা চলে ওদের বুঝ নিয়ে, ওদের মতো করে। এঁরা জেন-জি প্রজন্মের। এই প্রজন্মের যুবক পরিমল, রাজন, আফতাব, লিটন। সেদিন, পরিমল আবু সাঈদ কে নিয়ে বগুড়াতে বন্ধুদের সাথে যে কথা বলছিলো সেই মর্মান্তিক বিষয়টির কথা শোনা যাক:
বর্ষার ভরা মৌসুমে আকাশে সূর্যের দেখা পাওয়া অনেকটা বাংলাদেশী ক্রিকেট টিমের সফলতা দেখার মতো ঘটনা। বর্ষাকালের সূর্য মেঘ থেকে বেরিয়ে হঠাৎ করে উদিত হয়, ঝলমলে রোদে চারিদিকে ভাসিয়ে দেয়। ঠিক তেমনি, হঠাৎ হঠাৎ করে বাংলাদেশের ক্রিকেট টিমের সফলতা উজ্জ্বল হয়ে ঝলসে উঠে। টানা ব্যার্থতার গ্লানি টপকে জয়োৎসবের জয়গানে দেশে বিদেশে বাংলাদেশিদের আনন্দের বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়। আবার খানিক পরেই সূর্য মেঘের আড়ালে ঢেকে যায়। ঢেকে যায় টাইগারদের বীরত্ব গাঁথা। একেক সময় প্রেক্ষাপট খেলাধুলার জগৎ থেকে পাক খেয়ে রাজনীতিতে রূপান্তরিত হয়। সেই বর্ষাকালের সূর্যের মতো হঠাৎ হঠাৎ করে দেশের রাজনীতির রং বদলে যায়। বদলে যায় কিছু বাংলাদেশিদের চরিত্র। রং বদলের কারণ ও ধরণের এই লুকোচুরি খেলায় বেরসিক ক্যাপিটালিস্টিক সূর্য হয়তোবা আড়ালে থেকে খানিকটা বের হয়ে মুচ্কি হেসে আবারও মেঘের আড়ালে চলে যায়। আঁধারে ঢেকে যায় রহস্যময় এই পৃথিবী। এই মোটামুটি শ্রাবন মাসের মেঘ, রোদ্দুর, বৃষ্টির তত্ত্ব।
কিন্তু সেই তত্ত্ব আজ শ্রাবন মাসের পয়লা তারিখে ভিন্ন কথা বলছে। সেই সকাল থেকে মেঘের দেখা নেই। দাপুটে সূর্য প্রবল উৎসাহে উত্তাপ বিলি করছে। আর সেই উত্তাপে আরো ফুঁসে উঠেছে সারা দেশের ছাত্ররা। সেই আন্দোলনের ঝাপ্টা এসে পড়েছে উত্তর বঙ্গের রংপুর শহরে, বগুড়া শহরে। ২০২৪ সালের বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন কর্মী আবু সাঈদকে দেখা যাচ্ছে রংপুর শহরে বীর বিক্রমে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন একটি মিছিলে, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে। আবু সাঈদের শক্ত চোয়াল বেষ্টিত মুখ থেকে বর্ষণ হচ্ছে একেকটি জ্বালাময়ী সব স্লোগান, ‘স্বৈরিচার নিপাত যাক, আমি কে তুমি কে, রাজাকার, রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার, চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার …..।
আন্দোলনকারী ছাত্ররা নিজেদেরকে অভিমানী গলায় ব্যাঙ্গ করে যে রাজাকার বলে প্রচার করে স্লোগান দিচ্ছিলেন এর পেছনে রয়েছে আরেক ইতিহাস। জুলাই মাসের ১৪ তারিখ রবিবার বিকেলে, চীন দেশে সফর শেষে তদানীন্তন প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন :
সরকারি চাকরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে?……………মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার কে দিয়েছে? মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনলে গায়ে জ্বর আসে! মুক্তিযোদ্ধার নাতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে কোটায়। সে এখন বলে, কোটা লাগবে না। তাকে তো ভার্সিটি থেকে বের করে দেওয়া উচিত। লজ্জা থাকলে বের হয়ে তারপর বল কোটা লাগবে না।’ প্রধান মন্ত্রীর এই বক্তব্যই কাল হয়ে দাঁড়ালো।
‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’ – ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে জিন্নাহ সাহেবের সেদিনের সেই কথার প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সে সময়ের ছাত্র সমাজ। ঠিক একই ভঙ্গিতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে তাচ্ছিল্য ভরে আন্দোলনকারী ছাত্রদেরকে রাজাকার বিশোষণে যে বিশেষিত করলেন, এতে কেঁপে উঠলো ছাত্র সমাজ। সেই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে দলে দলে ছেলেমেয়েরা মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে জড়ো হতে থাকলো টিএসসিতে। স্বৈরাচার সরকারের বিপক্ষে মধ্যরাত পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা গগনবিদারী স্লোগানে স্লোগানে কাঁপিয়ে তুললো বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। এরই মাঝে পরের দিনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের উস্কানিমূলক বক্তব্য দিলেন:
“গতরাতে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছে, তার জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত।” এতে করে আন্দোলনের আগুনে যেন আরো বিস্ফোরণ হয়ে ফাটল। যে আওমীলীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল, সেই আওমীলীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ছেলেরা তাদের নেতার বক্তব্যে সাড়া দিয়ে লাঠি, বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো কোটা অন্দোলনকারী ছেলেমেয়েদের উপর। ঝাঁপিয়ে পড়লো সরকারি পুলিশবাহিনী। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে তাল মিলিয়ে সুর মিলিয়ে চাটুকর মন্ত্রী-এমপি, আওয়ামী পন্থী নেতা কর্মীগণ আন্দোলনকারী ছাত্রসমাজকে ‘রাজাকার’ বলে সম্বোধন শুরু করলেন। ফলাফল হতে থাকলো সম্পূর্ণ উল্টো। এবার আন্দোলনরত ছাত্রদেরকে সমর্থন দিয়ে এগিয়ে এলেন দেশের সুশীল সমাজ। দেশে বিদেশে স্বরাচারী সরকারের বিপক্ষে লু হাওয়া বইতে শুরু হলো। ঠিক এখান শুরু হলো এক নতুন ইতিহাস। নতুন বাংলাদেশ গড়ার ইতিহাস।
তারপরেই সেই পয়লা শ্রাবন, মঙ্গলবার, ১৬ই জুলাই, ২০২৪ সাল। আবু সাঈদ মিছিলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার সময় এক পর্যায়ে বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানী খানসেনাদের ভঙ্গিতে নিজ দেশের, স্বাধীন দেশের এক পুলিশের বর্বরোচিত পর পর কয়েকটি গুলিতে বুক ঝাঝড়া হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ২০২৪ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ ‘আবু সাঈদ’।
টেলিফোনে পরিমলের কথার পরপরেই রাজন, আফতাব কালবিলম্ব না করে সাইকেলে চেপে সাথ মাথার দিকে রওনা হলো। ততক্ষনে, বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাথ মাথা যেন মিছিলে মিছিলে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। মিছিলের সাথে সাথে এগিয়ে চলেছে খাকি পোশাকের পুলিশবাহিনী। রাজন আর আফতাব দ্রুত মিছিলে ছাত্রদের মাঝে মিশে যেয়ে স্লোগান দিতে থাকলো, ‘আবু সাঈদ মরলো কেন খুনি সরকার জবাব চাই!!! সময়ের সাথে সাথে রাজন-আফতাবদের মিছিলের ধৈর্ঘ্য ক্রমশঃ বাড়তে থাকলো। সেই সাথে সাথে বাড়তে থাকলো স্বৈরাচারী নির্যাতন। সরকারি পুলিশ, মিলিটারি প্রভৃতি বাহিনীর সাথে একাত্মতা হয়ে তদানীন্তন সরকারি মদদপুষ্ট ‘তৃতীয় বাহিনী’ সেই আন্দোলনের মিছিলে নেকড়ে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো।
এভাবে মৃত্য নিশ্চিন্ত জেনেও সমগ্র দেশের মেধাবী ছাত্রদের দাবিদাওয়ার লক্ষে পুলিশের সামনে বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়ে মৃত্যুবরণ করার উদাহরণ এই পৃথিবীর আর কোনো দেশে ঘটেছে বলে জানা নেই। ঠিক একইভাবে, মাতৃভাষার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৃথিবীর কোনো দেশে রক্তপাত ঘটেছে বলে তাও জানা নেই। বঙ্গোপসাগরের কোলে ছোট্ট ‘ব’ দ্বীপের এই দেশটিতে এভাবে মাঝে মাঝে অদ্ভুত কিছু ঘটনা বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দেয়। ভিনদেশে থাকা প্রবাসীরা পুলকিত হয়ে বিশ্বমানচিত্রে এই অতিক্ষুদ্র দেশটিকে দেখিয়ে গর্ব করে বলে ‘এই দেশ, আমার দেশ, সোনার বাংলা দেশ।’
(চলবে )
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
টরেন্ট, সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৪