আফসার আলী যথারীতি রাত তিনটায় ঘুম থেকে উঠে কেটলিতে চায়ের জন্যে পানি গরম করতে দিয়ে গোসলে যান। মিনিট সাতেকের মধ্যে গোসলখানা থেকে বের হয়ে দ্রুত গা মুছতে মুছতে কেটলির ঢাকনি খুলে উঁকি দিয়ে দেখেন পানি ফুটেছে কি না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি দেখতে পান, পানি টগবগ করে ফুটছে। এসময়ে তিনি ফুটন্ত পানিতে একসাথে দুধ ও চায়ের পাতা দিয়ে কেটলির ঢাকনা খুলে রাখেন এবং গ্যাসের চুলার আঁচ কিছুটা কমিয়ে রাখেন। এর পরে আফসার আলী পাজামা, পাঞ্জাবি পরে, গায়ে আতর মেখে, চোখে সুরমা দিয়ে চার রাকাত তাহাজ্জতের নামাজ আদায় করেন।
তাহাজ্জতের নামাজ শেষে আফসার আলী চায়ের কাপ হাতে নিয়ে একা আয়েশি ভঙ্গিতে বারান্দায় রাখা ইজি চেয়ারে বসে চুক চুক করে চা খান আর অতি প্রত্যুষের আলো আঁধারের শিফট এক্সচেঞ্জ উপভোগ করেন। প্রকৃতি পৃথিবী নামক গ্রহের সমস্ত মানুষের মনের কষ্ট ও দুঃখগুলোকে রাতের আঁধারের চাদর দিয়ে ঢেকে রাখে। ভোর রাতের দিকে সেই চাদরকে ঝুপ করে উঠিয়ে নিয়ে শ্বেত -শুভ্র ভোরের আগমন ঘটাতে থাকে । তারপর, রাতের আঁধার মানুষের তাবৎ কষ্ট ও দুঃখ বহন করে চলে যায় পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের রাজ্যগুলোর দিকে । আবার সেসব রাজ্য থেকে কর্মমুখর মানুষের কর্মউদ্দীপনাকে বহন করে নিয়ে আসে আমাদের রাজ্যে। আশা আকাঙ্খার প্রদীপ হাতে তেজি দীপ্তমান সূর্য সোনালীরূপালী আলোকছটার পালংকে এসে উপস্থিত হয়ে আমাদের মুগ্ধ করে । কিন্তু, এই মুগ্ধতাকে স্পর্শ করে না অধিকাংশ মানুষকে। সেসব বোকা মানুষেরা অঘোরে ঘুমিয়ে কাটিয়ে এই বিরল অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত রাখে।
আফসার আলীর ভোরের এই নিয়ম চালু হয়েছে গত সাত /আটমাস আগে স্ত্রী রাহেলা খাতুনের প্যারালাইসিস রোগে বিছানায় যাওয়ার পরে থেকে। রহস্যময় প্রকৃতির এক অদ্ভুত নিয়ম হচ্ছে প্রতিটি মন্দ কাজের পেছনেই একেকটি ভালো কাজের নমুনা দিয়ে দেন। স্ত্রীর অসুস্থতা আফসার আলীকে প্রভাতের প্রতিভা দেখার সুযোগ করে দিয়েছে, এবং সেই সাথে চা বানাতে পারদর্শী করে তুলেছে। রাহেলা খাতুন সুস্থ থাকলে চায়ের ব্যাপারটি থাকতো পুরোপুরিভাবে রাহেলার অধীনে । তাহাজ্জতের নামাজ শেষে আফসার আলী সালাম ফিরে দেখতেন এক কাপ চা আর পিরিচে টোষ্ট বিস্কুট নিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে রাহেলা খাতুন দাঁড়িয়ে আছেন। আফসার আলী স্ত্রী সেবায় অভিভূত হয়ে আনন্দচিত্তে চা কাপ হাতে নিয়ে কাপে আলতো করে চুমুক দিয়ে বলতেন, ‘একেবারে ফাটাফাটি চা হয়েছে।’ এই সামান্য প্রশংসায় রাহেলা খাতুন লজ্জায় লাল হয়ে যেতেন। মাঝে মাঝে আফসার আলী স্ত্রী প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতেই রাহেলা দ্রুত সরে যেয়ে বলে উঠতেন,’কি করেন, ছেলে মেয়ে বড়ো হয়েছে, দেখে ফেলবে।’ স্ত্রীর কথায় মজা পেয়ে আফসার আলী আরও উৎসাহ পেতেন!
গতকাল শুক্রবারে আফসার আলী নিজ পাড়ার কানছগাড়ী জামে মসজিদে জুম্মা নামাজ শেষে পুরোনো বন্ধু দেলোয়ার, ময়েজ উদ্দিনের সাথে দেখা হলো। এখানে, উল্লেখ করা যেতে পারে, আমি, দেলোয়ার, ময়েজ, সতীষ, নগেন একেবারে বাল্যকালের বন্ধু। আমি এগ্রিকালচার নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে লেখাপড়া শেষে এনজিও লাইনে কাজ করে অনেক বছর ধরে কানাডার টরন্টো শহরে থাকি। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে যেমন চমৎকার সম্পর্ক্য তেমনি আমাদের বন্ধুদের ছেলেমেয়েদের মাঝেও চমৎকার বন্ধুত্ব। দেলোয়ারের ছেলে রাজন, ময়েজের ছেলে আফতাব, আফসারের ছেলে লিটন, নগেনের ছেলে পরিমল আর আমার ছেলের নাম অর্ণব। বন্ধুদের মধ্যে আমিই কেবল অনেক আগে বিয়ে করায় আমার বড়ো ছেলে অর্ণবের বয়স আমার বন্ধুদের বাচ্চাদের বয়সের তুলনায় কিছুটা বেশি। অর্ণবের জন্মের বছর ১৯৯৬ হওয়ায় নিজেকে Millennials জেনারেশন বলে দাবি করে। আর আমার বাকি বন্ধুদের ছেলেমেয়েরা হচ্ছে জেন জি। তাতে কি, আমাদের এই বাচ্চারা সবাই সবার সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখে, নিজেদের মধ্যে ক্যারিয়ার নিয়ে, দেশ নিয়ে আলাপ আলোচনা করে। এদের কথা কিছুটা আগেই বলেছি। আপাততঃ আমাদের জেনারেশনের দিকে তাকানো যাক । আমি অনেক বছর বাইরে থাকলেও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ মেইনটেইন করে চলি। তবে, দেশে যারা থাকে ওদের একে অন্যের সাথে আগের মতোই বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আমাদের মধ্যে এই যে বন্ধুত্বের মধ্যে হঠাৎ করে মাত্র কিছুদিন হলো কেমন যেন একটু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সতীশ ও নগেন আমাদের বাকি বন্ধুদের কেমন যেন এড়িয়ে চলছে। প্রিয় পাঠক, এই এড়িয়ে চলার রহস্যে এবং তার বিশ্লেষণ আমার পুরো লেখা জুড়েই থাকবে। আসুন, ধৈর্য ধরে এই ধারাবাহিকের শেষ পাতা পর্যন্ত চোখ রাখি।
ময়েজ উদ্দিন বগুড়া শহরের রহমান নগরে অবস্থিত ফুড অফিসের হেড ক্লার্ক। আর দেলোয়ার থানা রোডের পাশে তরফদার মার্কেটে একটি বইয়ের দোকানে চাকরি করে। নামাজের পরে মসজিদের ফটকের সামনে বন্ধুদের সাথে খানিক্ষন আড্ডা দেয়া আফসার আলীর অনেক দিনের পুরোনো অভ্যাস। এই আড্ডায় কখনো ইজরাইল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আমেরিকার নির্বাচন এমন কি বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নতি অবনতি নিয়েও কথা হয়, তর্ক হয়। তবে আজ আর কোনো আড্ডা হলো না। সবার মুখ থমথমে। সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলছে আর সরকার পক্ষ নির্বিচারে গুলি করে স্বাধীন দেশের মানুষজনকে মেরে ফেলছে। সরকারের এই ফ্যাসিস্ট নীতির বিপক্ষে সবার মধ্যে ক্ষোভ এবং সেই সাথে একটি চাপা আতঙ্ক। এই বুঝি কাউকে আবার ধরে নিয়ে যায়। লোকজন ফিসফিস করে কথা বলছে। দেলোয়ার বললো,
‘বন্ধু, তোরা যে যাই বলিস, আমেরিকার হেল্প ছাড়া এই সরকারকে কিছুতেই নামানো যাবে না।’ দেলোয়ারের কথা বাকি বন্ধুরা কেউ তেমন আমলে নিলো না। তবে, দেলোয়ারের কথা কিন্তু একেবারে ফেলনাও না। বাংলাদেশের জন্মের শুরু থেকেই আমেরিকার ভূমিকা বেশ রহস্যজনক। ১৯৭১ সালে আমেরিকা পাকিস্তানকে সহযোগিতা করতে ৭ম নৌবহর, বাংলাদেশকে নিয়ে আমেরিকার ডিপ্লোমেট হেনরি কিসিঞ্জারের সেই বিখ্যাত তলা বিহীন বাস্কেটের সাথে তুলনা, প্রতিশ্রুতি দিয়েও হঠাৎ করে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের পদ্মা সেতুর ফান্ডিং থেকে সটকে পড়া ইত্যাদি বিষয়গুলি মানুষের মনে উত্তরোত্তর সন্দেহের উদ্রেক মহীরুহ হয়ে ক্রমশ অনেক ডালপালা ছড়াচ্ছে। সর্বশেষে, বাংলাদেশের কিছু মানুষ ৫ই আগষ্টের পটপরিবর্তনে আমেরিকার ডেমোক্র্যাটদের সাথে নোবেল জয়ী প্রফেসর ইউনুস সাহেবের বন্ধুত্ব সম্পর্ককে দায়ী করে থাকেন । আমরা লেখক, আমরা রাজনীতির জটিলতা বুঝি না। নীতির উপর দাঁড়িয়ে, বিভিন্ন মতের , দলের, মানুষের বিশ্বাসকে, মানুষের বিশ্বাসকে, ইতিহাসের পাতা থেকে ধার নিয়ে রং তুলিতে ফুটিয়ে সাহিত্যে তুলে ধরার চেষ্টা করি। সাহিত্য ও সংস্কৃতি মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ তৈরিতে সাহায্য করে। বিবেকবান জাতি তৈরিতে সাহায্য করে। আর একটি বিবেকবান জাতি গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে সঠিক নেতা-নেত্রী নির্বাচন করেন। এই রাজনীতিবিদ লিডারারদের মধ্য থেকেই দেশ শাসনের ভার দেয়া হয়। রহস্যজনক কারণে সে সমস্ত রাজনৈনিক লিডারগণ ক্ষমতায় যেয়ে রাতারাতি গিরিগিটির মতো রং পরিবর্তন করে ফেলেন। তাই এক ভিন্নধর্মী সংস্কারের দিকে এগিয়ে চলছে ‘নতুন বাংলাদেশ’।
কাল রাতে দেশের দুশ্চিন্তায় আফসার আলীর তেমন ভালো ঘুম হয়নি। রাতে এশার নামাজের সময় তিনি কয়েকজনকে বলতে শুনেছেন যেকোন মুহূর্তে রাস্তায় আর্মি নামবে, বাড়ি বাড়ি যেয়ে উঠতি বয়সের ছেলেদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাবে। কে একজন আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, ‘ভাই, আজ ঢাকাত এডা করুন ব্যাপার ঘটিছে, মাত্র ১১ বছরের এডা চ্যাঙরা জানলা বন্ধ করবার যায় গুলি খায়া সাথে সাথেই ওটিই মরে গেছে।’ ভদ্র লোক যে খবরটি বলতে চেয়েছিলেন পরের দিন পত্রিকা থেকে তা সরাসরি এখানে তুলে ধরা হলো :
“জানালায় দাঁড়াতেই গুলি এসে কেড়ে নিল শিশুটিকে
জানালার পাশেই সামিরের পড়ার টেবিল। পড়ার বই, প্লাস্টিকের খেলনা, ঘরের মেঝেতে এখনো ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। গত শুক্রবার জানালা দিয়ে আসা একটি বুলেট সামিরের চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার খুলি ভেদ করে বেরিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ১১ বছরের সাফকাত সামির।” ওই দিন (১৯ জুলাই) কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে মিরপুরে কাফরুল থানার সামনের সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া ঢুকছিল সামিরের ঘরে। জানালা বন্ধ করতে গেলে বাইরে থেকে গুলি এসে বিদ্ধ করে শিশুটিকে। গুলিটি তার চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়।” আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৪, ০৪: ২৭ (প্রথম আলো)
আফসার আলীর দুশ্চিন্তা তার মেঝো ছেলে টগরের জন্যে। টগর এবার বগুড়া জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিবে। আফসার আলী দেখেছে তার সেই ছেলে স্কুল ড্রেস পরে বন্ধুদের নিয়ে মিছিল করছে, স্লোগান দিচ্ছে। আফসার আলী ছেলেকে দেখেও না দেখার ভান করেছে। কারণ, ছেলেমেয়েদের এই বৈষম্যবিরোধী বা সরকারবিরোধী আন্দোলনে আফসার আলীর নীরব সমর্থন রয়েছে। আফসার আলী মনে মনে তার দুই ছেলের জন্যই গর্ব করে। তার বড়ো ছেলে কানাডায় পড়তে গেলও আফসার আলী শুনেছেন তার সেই ছেলে সেখানেও এই জালিম সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল মিটিং করছে। এটি খুবই ভালো কথা। আমাদের নবী করিম সা. বালক বয়সে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে ‘হিলফ উল ফুজুল’ সংগঠনে যোগদান করেছিলেন, অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, দুস্থ মানুষদের সেবা করেছেন।
কানাডায় টরন্টো শহরে তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে। লিটন ও শম্পা ইউনিভার্সিটির ক্লাস শেষ করে হেঁটে হেঁটে গল্প করতে করতে একটি পিজ্জার দোকানের দিকে এগুচ্ছে। আজ শুক্রবার। কাল-পরশু কোনো ক্লাস নেই। তবে, লিটনের কাজ আছে। গ্যাস স্টেশনের কাজটি শুরু হবে রাত নয়টা থেকে ওভার নাইট। লিটনের প্ল্যান হচ্ছে, শম্পাকে নিয়ে একসাথে ডিনার করে তারপরে, সরাসরি কাজে যাবে। লিটন মিডিয়াম সাইজের একটি পিজ্জার অর্ডার দিল, টপিং রেড পেপার-গ্রিন পেপার, ব্ল্যাক অলিভ এবং মাশরুম। অর্ডার দেয়ার পরে প্রায় পনের/ বিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। লিটন শম্পাকে বললো, ‘শম্পা, পাঁচ মিনিট, আমি একটু দেশে বাবাকে ফোন দিচ্ছি, একটু জরুরি কথা আছে। বাবা-ছেলের জরুরি কথায় থাকতে নেই ভেবে শম্পা উঠতে উদ্দত হয়ে বললো, ‘তোমরা কথা বলো, আমি বাইরে হাঁটাহাঁটি করে আসছি। লিটন খপ করে শম্পার হাত ধরে বললো, ‘বাইরে যেতে হবে না, এখানেই বসো, সেরকম কোনো কিছু না। লিটনের হাতের স্পর্শে শম্পার শরীরে হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহ হতে লাগলো।
আফসার আলী দেশের সার্বিক বিষয়ে দুশ্চিন্তা নিয়ে কেটলি থেকে চা নামাতে যেয়ে ভুলে খালি হাতে গরম কেটলির হেন্ডেল ধরতেই বিরাট ছ্যাঁকা খেলেন। তিনি দ্রুত ট্যাপ ছেড়ে ঠান্ডা পানিতে হাত কিছুক্ষন ভিজিয়ে রাখলেন। মনে হয় না ফোস্কা পড়েছে। তবুও সাবধানের মার নেই। আফসার আলী ফ্রিজ থেকে বরফের টুকরা নিয়ে কিছুক্ষন নাড়াচাড়া করলেন। জ্বালা ভাব কমে এলে সাবধানে কাপে চা ঢেলে চা আর টোস্ট বিস্কুট নিয়ে বারান্দায় বসলেন । তিনি ঘড়ির দিকে দেখলেন ভোর সাড়ে তিনটা বাজে। কানাডার টরেন্টোর সময় তার মানে এখন বাজে বিকেল সাড়ে পাঁচটা। ফজরের জামাত শুরু হবে সোয়া চারটায়। তার মানে পয়তাল্লিশ মিনিট সময় আছে। আফসার আলী বড়ো ছেলে লিটনকে ফোন দিতেই হাযার হাযার মাইল দূরে থেকে লিটনের গলা শোনা গেল।
‘বাবা, তুমি ফোন করেছো, ভালোই করেছো, আমি কেবলি ভাবছিলাম তোমাকে ফোন দিব।’
‘কেন ? তুই তো কখনো এ সময়ে ফোন দিস না , ফোন দেয়ার কথা ভাবলি কেন ?’
‘আমি জানি বাবা, তুমি ভোরে ঘুম থেকে উঠে মসজিদে ফজর নামাজ পড়তে যাবে, আজ আর বাসা থেকে বের হয় না বাবা’
আফসার আলী উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন ,’কেন রে, ওভাবে বলছিস কেন? কি হয়েছে ?
বাবা , সারা দেশে আজ রাত বারোটা থেকে কারফিউ জারি করেছে। মিলিটারি রাস্তায় টহল দিচ্ছে, তুমি ঘুমাচ্ছিলে তো তাই, এসব খবর শুনতে পায়নি না, আমি এইমাত্র ইন্টারনেটে এসব খবর শুনে ভাবলাম তোমাকে জানাই, তুমি ফজর নামাজ পড়ার জন্যে মসজিদে যাওয়ার চেষ্টা করলে মিলিটারির পাল্লায় পড়বে।
টরেন্ট শহর থেকে লিটন তার বাবাকে যে ফোন করেছিল সেই তারিখ হচ্ছে জুলাই মাসের ২০ তারিখ, শনিবার, সকাল সাড়ে তিনটা। গত রাত ১২টা থেকে সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। আজ দুপুর ১২টার পড়ে ২ ঘণ্টা বিরতি দিয়ে ২টা থেকে পরদিন সকাল ১০টা দ্বিতীয় দফায় আবার কারফিউ চলবে।
আফসার আলী ছেলের সাথে ফোনে যখন কথা বলছেন এক পর্যায়ে স্ত্রী রাহেলাও উঠে পড়েছেন। রাহেলা চেঁচিয়ে বলছে, এই যে শুনছেন, কার সাথে কথা বলছেন, বড়ো খোকা? খোকা কেমন আছে ? ওখানেও ওরা নাকি আমাদের সরকার নিয়ে মিছিল মিটিং করছে , ওকে এসবে থাকতে মানা করেন।’
বড়ো খোকা অর্থাৎ লিটনের মা ছেলেকে মিছিলে যেতে নিষেধ করলেও এবারের ২০২৪ সালের এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অনেক মহিলাদেরকে দেখা গিয়েছে ওনারাও ছেলেমেয়েদের সাথে রাস্তায় নেমেছেন, কোনো কোনো মা বাসা থেকে খাবার নিয়ে রাস্তায় আন্দোলনরত ছেলেমেয়েদের খাওয়াচ্ছেন, শহীদ মুগ্ধ’র মতো পানি সরবরাহ করছেন অথবা ছেলেমেয়েদেরকে আন্দোলনে যোগ দিতে উৎসাহ দিচ্ছেন। দেশ মাতা অভিভূত হয়ে দেখলেন তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে মহিলা, পুরুষ, শিক্ষক, অভিভাবক , কৃষক, শ্রমিক সকলে এক কাতারে বৈষম্য দূর করার ডাক দিয়েছে, স্বৈরাচার সরকার পতনের ডাক দিয়েছে। শুধু অভিভূত হতে পারলেন না এক বিশেষ গোষ্ঠী যাদের টাকা ও সম্পদ স্বৈরাচার সরকারের আশীর্বাদে ফুলে ফেঁপে কলাগাছ হয়ে উঠছে।
আফসার আলী রাহেলার একনাগাড়ে করা এতগুলো প্রশ্নের উত্তর শুধু এক কথায় দিলেন , ‘ হ্যা খোকার সাথেই কথা হচ্ছিলো, খোকা ভালো আছে। এই বলে তিনি জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে উদাস ভাবে তাকিয়ে থাকলেন । ততক্ষনে বাইরে আকাশে সুবহে সাদিক এর আবির্ভাব ঘটেছে। কিছু ভোরের পাখি কামিনীর ঝোপে কিচিরমিচির করে গুঞ্জন শুরু করেছে। উঠোনের রান্না ঘরের পাশের মাটি দিয়ে বানানো মুরগির ঘরে বয়সী লাল মোরগটি অস্থির হয়ে ডাকাডাকি শুরু করেছে। কানছগাড়ী জামে মসজিদের মুয়াজ্জেন মোন্তাজ উদ্দিন সুর করে ফজরের আজান শুরু করেছেন। আফসার আলীর মন খারাপ হয়ে গেল। তিনি আজ কারফিউয়ের কারণে জামাতে ফজর নামাজ পড়তে পারলেন না।
আফসার আলী এক ওজুতেই তাহাজ্জত ও ফজরের নামাজ পড়ে থাকেন। আজ তিনি ছেলের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে যেয়ে ওযুর কথা ভুলে গিয়েছেন । সম্ভবতঃ তিনি ছোট বাথরুমও করেছেন । তিনি আবারও বাথরুমে যেয়ে ওযু করলেন। ফজর নামাজ শেষে কোরান তেলোয়াত করলেন। আজ তিনি পবিত্র কোরানের সূরা আ’রাফ পড়ছিলেন। ২০৬ নং আয়াত পড়া শেষে তিনি আল্লাহু আকবার বলে সেজদায় চলে গেলেন। পবিত্র কোরানশরীফে মোট ১৪ টি আয়াত রয়েছে যেখানে আয়াত পাঠ শেষে সেজদাহ করতে হয়। আজ আফসার আলী যে সূরাটি পড়ে সেজদাহ করছেন এটি পবিত্র কোরানের প্রথম আয়াত যেটি পড়তে যেয়ে সেজদাহ করতে হয়। আফসার আলী সূরা আ’রাফ এর যে আয়াতটি পড়লেন তার বাংলা মানে হচ্ছে , “নিশ্চয়ই যারা তোমার পরওয়ারদেগারের সান্নিধ্যে রয়েছেন, তারা তাঁর বন্দেগীর ব্যাপারে অহঙ্কার করেন না এবং স্মরণ করেন তাঁর পবিত্র সত্তাকে; আর তাঁকেই সেজদা করেন।” [সূরা আ’রাফ: 206]
সেজদাহ থেকে উঠে আফসার আলী লম্বা দোয়া করতে বসলেন, ‘হে আল্লাহ, হে পরওয়ারদেগার, আপনি সর্বশক্তিমান, আপনি মুসা নবীকে ফেরাউনের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন, আপনি ঈসা নবীকে অত্যাচারী জনগণের হাত থেকে আসমানে উঠিয়ে নিয়ে সুরক্ষা দিয়েছিলেন, আপনি বাদশাহ বাদশাহ আবরাহা’র বিশাল হস্তী বাহিনীর উপর আবাবিল পাখি পাঠিয়েছিলেন, আপনি ইউনুস নবীকে মাছের পেট থেকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন, হে দয়াবান, হে দোজাহানের মালিক, আপনি, এই জালিম সরকারের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করুন, এই জালিম সরকার ও তার সাগরেদ দেশের সমস্ত সম্পদ লুটপাট করছে, মাসুম বাচ্চাদের গুলি করে মেরে ফেলছে, এদের শরীরে কোনো দয়ামায়া নেই, এদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করুন !! আমিন।
নামাজ পড়ে দোয়া করার সময় স্কুল কলেজের বাচ্চা ছেলেদের মৃত মুখের কথা ভেবে আফসার আলী হুহু করে কেঁদে ফেললেন। কান্নার তোড়ে আফসার আলীর শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। ভোররাতের আফসার আলীর সেই কান্নার শব্দ ঘুমের ঘোরে পরিবারের কেউ শুনতে না পেলেও ইথারে ইথারে ভাসতে ভাসতে সেই কান্নার শব্দ তরঙ্গ মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে ঠিকই নির্বিগ্নে পৌঁছাল।
আগের পর্বগুলি –
পর্ব ১-পর্ব ১
পর্ব ২-পর্ব ২
পর্ব ৩-পর্ব ৩
পর্ব ৪-পর্ব ৪
পর্ব ৫-পর্ব ৫
পর্ব ৬-পর্ব ৬
——–
(চলবে)