আমাদের উপমহাদেশে ধর্ম এবং সংস্কৃতি পাশাপাশি অথবা হাতধরাধরি করে চললেও মাঝে মাঝে পরস্পরের সাথে সংঘাত হতে দেখা যায়। আমি ধর্ম এবং সংস্কৃতি এই দুই বিষয়েই বিশেষজ্ঞ নই। তবুও আমার ধারাবাহিক গল্পে আমার দৃষ্টিতে যতটুকু প্রাসঙ্গিক মনে করছি তাই পাঠকদের তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমার কাছে মনে হয়েছে অতি সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং আন্দোলন পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি দিন দিন আমাদের নতুন বাংলাদেশে জি জেন ছেলেমেয়েরা বন্দে মাতরম’ এবং ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ এই দুই ধারার বাংলাদেশিদেরকে মুখোমুখি এনে দাঁড় করছে। এই দিকটা একটু গোড়া থেকে দেখা যাক।

ধর্মপ্রান, ধর্মভীরু এক কথা, আর ধর্মান্ধতা আলাদা কথা। মুসলিম প্রধান আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ ধর্মপ্রাণ হলেও ধর্মান্ধ মানুষও দেখতে পাওয়া যায়। আমার মনে আছে বগুড়া অঞ্চলে কিছু ধর্মান্ধ মানুষেরা আকাশে চাঁদের মধ্যে দেলোয়ার হোসেন সাঈদের মুখ দেখতে পেয়েছিলেন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীরা আমাদের দেশে অনেক ভালো ভালো কথা বললেও আমাদের দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষদের ধারণা এসব বিপ্লবীরা নাস্তিক প্রকৃতির, তাই তাঁরা কখনই সমাজতান্ত্রিক ভাবদর্শনকে ভালো জেনেও গ্রহণ করতে পারেননি।

আমাদের দেশে পরিবারগুলোতে ছেলেমেয়েদের নামকরণের মধ্যে দিয়ে আমাদের গড়পড়তা সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। আমাদের দেশে দুটি করে নামের চল দেখা যায়, ডাক নাম ও ভালো নাম। ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারে সৃষ্টিকর্তার করুনা লাভের আশায় ছেলেমেয়েদের ভালো নাম অর্থাৎ পুরো নাম রাখার ক্ষেত্রে রাখেন মেয়েদের নাম আয়শা, খাদিজা, ফাতেমা, ইত্যাদি। আর পুরুষদের ক্ষেত্রে রহিম, করিম, মালেক, সালাম, বক্কর, সিদ্দিক ইত্যাদি ভালো নাম রেখে শুরুতে বা মাঝখানে মোহাম্মদ রাখা হয় এবং শেষ হয় আহম্মেদ, হাসান, হোসেন ইত্যাদি দিয়ে। নিন্মবিত্ত পরিবারগুলোতে এসব ভালো নামে ডাকা হলেও মধ্যবিত্ত বা উচ্চ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে এ সমস্ত নামগুলো থাকে সার্টিফিকেট বা কাগজে কলমে। আর ডাক নামের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় চমৎকার চমৎকার সব বাহারি নাম, যেমনঃ মেয়েদের ক্ষেত্রে ত্রপা, রুপা, তিথি, মিথিলা, নীলা রাত্রি, তৃনা, অদিতি, বৃষ্টি, অহনা আর ছেলেদের ক্ষেত্রে অর্ক, অয়ন, আবির, শুভ্র, অন্তু ইত্যাদি। আমি নিজেও এর ব্যাতিক্রম না। আমার ছেলের ক্ষেত্রে আমরা শখ করে নাম রাখলাম, অর্ণব যার মানে সমুদ্র। আমার পরিবার থেকে আপত্তি এলো। বলা হলো এই নাম রাখা যাবে না, কারণ এর মাঝে হিন্দুত্ব গন্ধ আছে। আমি ধর্ম ও সংস্কৃতির সাথে তাল মিলিয়ে বুদ্ধি করে ছেলের নাম রাখলাম রেজোয়ান ময়ীন অর্ণব। আরবি ভাষায় রেজোয়ান মানে সম্ভবত ‘বেহেস্তের চাবি’। নামের ক্ষেত্রে যে জাতি এতো সচেতন সে জাতি যদি শান্তির ধর্ম ইসলামের ভাবাদর্শন দৈনিন্দন জীবনে সব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতেন সত্যই আমাদের এই পৃথিবীতে স্বর্গ সুখ নেমে আসতো’।

আমাদের অর্থাৎ ‘এক্স’ জেনেরেশনে বিশেষকরে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে স্কুলের পড়ালেখার পাশাপাশি আমাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে বাবা মায়েরা বাসায় ‘ওস্তাদজি’ নিয়োগ করে আমাদেরকে আরবি পড়িয়েছেন। আমাদের শৈশবে আমরা সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে বড়ো হয়েছি। আমাদের সময় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে ‘হ্যাপি বার্থডে’ পালন করে কেক কাটার চল তেমন একটা ছিল না। এই কালচার এসেছে আরেকটু এলিট শ্রেণী থেকে। আমাদের একেবারে শিশু অবস্থায় অর্থ্যাৎ ৫/৬ বয়স পর্যন্ত সময় আমরা তখন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী। সবেমাত্র স্কুলে ঢুকেছি। স্কুলের এসেম্বিলিতে ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ এর কথা এখনও মনে আছে। আমরা সেই সময়ে রংপুর শহরে আলম নগর এলাকায় থাকতাম। আশেপাশে প্রচুর বিহারী জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। অবাক হয়ে বিহারীদের জাকজমকপূর্ণভাবে ‘মহরম’ পালন উৎসব দেখেছি। শবেবরাতের রাতে ঘরে ঘরে হালুয়ারুটি, মিলাদ পড়ানো ইত্যাদি দেখে শৈশব পার করেছি। আমাদের পরীক্ষার সময় মায়েদের রোজা রাখতে দেখেছি। আমাদের জেনেরেশনে হিন্দু-মুসলিম বড়ো ধরণের কোন্দল দেখেনি, তবে বড়ো হয়ে বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা আমাদের যুবক মনে দাগ কেটেছিল। যতদূর মনে পড়ে ইতিহাস ঘেঁটে জেনেছিলাম রামের জন্মভূমি অযোধ্যায় একসময়ে ষোড়শ শতাব্দীতে রাম মন্দির ধ্বংস করে বাবরি মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল । পরে, হিন্দু জনতা ১৯৯২ সালে মসজিদটি ভেঙ্গে দিয়েছিল। তারপরে সারা দেশে শুরু হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মারা গিয়েছিলেন প্রায় দুই হাজার মানুষ। (তথ্য : বিবিসি নিউজ ২২ জানুয়ারি ২০২৪ )

আমাদের প্রজন্ম অর্থাৎ ‘X Generation’ এর এই আমরা দেশের স্বাধীনতার সময় আমরা তখন ৬/৭ বছরের শিশু। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বলতে আমাদের শিশুমনে কেবল মনে আছে বোমারু বিমানের ভয়ে দৌড়ে মাটির সুড়ঙ্গে লুকিয়ে থেকে আতংকে নীল হয়ে বসে থাকা, বন্ধ জানালার ফুটো দিয়ে বাইরের টহলরত পাকহানাদার বাহিনীর জলপাই রঙের জীপ দেখা ইত্যাদি। স্বাধীনতার পরে, আমরা বেড়ে উঠেছি’ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি ‘ জাতীয় সংগীত গেয়ে’ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার বাংলাদেশের মাটি, ‘ মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, ‘ এক নদি রক্ত পেরিয়ে বাংলা স্বাধীনতা অন্য যারা ….’ ইত্যাদি গানগুলো আমাদের মনোজগতকে দেশীয় আবেগে আচ্ছন্ন করে রাখতো। আমরা ছোট ছিলাম বলে তখনও তেমন বুঝিনি, এসব চেতনা সৃষ্টির মধ্যদিয়ে আমরা ধীরে ধীরে ভারতের বলয়ের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি।

সময়ের স্রোতে, প্রযুক্তির উন্নতিতে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীতেও ধর্মীয় জ্ঞানের পরিবর্তন ঘটেছে। এখন বড়ো হয়ে দেখেছি মিলাদ পড়ানো, মৃত্যবার্ষিকী উজ্জাপন করা, শবেবরাতের হালুয়ারুটি খাবার চল তেমন একটি নেই। তবে, মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইদানিং দেখেছি আমাদের গোষ্ঠীর একটি অংশ সামাজিকভাবে জন্মদিন, বিবাহদিন, ইত্যাদি পালন করতে অসম্মতি জানালেও নিজেদেরকে গোপনে বাচ্চাদের জন্মদিনে পায়েস রেঁধে খাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে আরো উগ্রবাদীরা অর্থাৎ ধর্মান্ধরা বাংলা ভাষায় শনি, মঙ্গোল ব্যবহারকে ‘হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি’ নামে অবিহিত করেন। ঠিক এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে উস্কে দিয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতি প্রেমিক কিছু বাংলাদেশী গোষ্ঠী। এনারা আওয়ামী সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যে দক্ষতার সাথে ভারতীয় সংস্কৃতির বীজের আমদানি ঘটিয়ে সেটিকে বাংলাদেশীয় সংস্কৃতিহিসেবে লেবেল দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে ভারতীয় সিরিয়াল নাটকগুলোকে জনপ্রিয় করে বাংলাদেশিদেরকে ভারতীয় সংস্কৃতিতে মোহাচ্ছন্ন করে রাখছে। শহীদমিনারে বেদিতে ফুল দেয়া থেকে শুরু করে পয়লা বৈশাখে হিন্দুদের আদলে মঙ্গোল শোভাযাত্রার আবির্ভাব ঘটিয়ে ধর্ম ও সংস্কৃতিকে আরোও জটিল করে ফেলা হচ্ছে ।

মুসলমান ছাড়াও মুসলিম প্রধান বাংলাদেশের জনগণের কিছু অংশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান রয়েছে। ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাঙালি কৃষক জনতা, ছাত্র সমাজ তৎকালীন পাকিস্তানে কর্মরত দক্ষ বাংলা সেনা অফিসারদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলে ভারত সরকারের সাহায্যপুষ্ট হয়ে মুক্তি সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। এই স্বাধীনতা কোনো ব্যাক্তির অথবা কোনো বিশেষ পার্টির একক প্রাপ্তি না। এই স্বাধীনতায় রয়েছে পুরা জাতির অবদান। সেই সময়ের স্বাধীনতা চলাকালীন সময়ে যুদ্ধরত সেনা অফিসারদের সাথে অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার এবং মুজীব-বাহিনীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা গিয়েছিল। এই অসন্তুষ্টি স্বাধীনতার পরেও সেনা সদস্যদের মাঝে লক্ষ্য করা গিয়েছে যা অব্যাহত থেকে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে দূরত্ব ক্রমশঃ বেড়েই চলেছিল । জাতি হতবাক হয়ে দেখেছে ৭৫ ট্রাজেডি। স্বাধীনতার পরে, আওয়ামী লীগ সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন করলেন। বাংলাদেশ বেতারের দৈনন্দিন কর্মসূচির শুরুতেই বেতারে কেরাত, বেদ, ত্রিপিটক ও বাইবেলের পাঠের নিয়ম করলেন। রুশ-ভারতকে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করতে যেয়ে সংবিধানে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রকে একসাথে মিশ্রিত করে পৃথিবীতে নতুন মুজিববাদী মতবাদ চালু করা হলো । এতে দেশে হিন্দু সম্প্রদায় নিজেদের নিরাপদ মনে করলেন। কিন্তু খুশি হলেন না বেশ কিছু ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা।

১৯৭২ থেকে ৭৫ এর ১৫ই আগষ্টের আগপর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগের একচেটিয়া দাপট দেখেছে । প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, দুর্ভিক্ষ সেই সাথে আওয়ামী চরম দুর্নীতিতে ফুঁসে উঠেছে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারক আসম রব ও মেজর জলিলের জাসদ। বামপন্থী রাজনীতিবিদদের শায়েস্তা করতে প্রচলিত সেনাবাহিনীর উপর আস্থা হারিয়ে শেখ মুজিব সরকার রক্ষীবাহিনী গঠন করলেন। এই রক্ষীবাহিনী অত্যাচারে বাংলার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে থাকলো। দেশপ্রেমিক সিরাজ শিকদারকে হত্যা করা হলো। রেডক্রসের চেয়ারম্যান কম্বল চোর গাজী গোলাম মোস্তফা, ও শেখ পরিবারের দুর্নীতির কথা বাংলাদেশিদের মধ্যে ক্ষোভের দানা বাঁধতে লাগলো। একদিকে যখন অনাহারে পথেঘাটে লোক মারা যাচ্ছে, বাসন্তীকে মাছ ধরার জাল গায়ে দিয়ে লজ্জা ঢাকতে হচ্ছে, সেই সময়ে শেখ পরিবারে চললো সোনার মুকুট মাথায় দিয়ে শেখ জামাল ও শেখ কামালের জোড়া বিয়ের উৎসব। আরেক বিয়ের উৎসবে গাজী গোলামের ছেলেদের দ্বারা লাঞ্চিত হলো মেজর ডালিম পরিবার। ছোট ছোট বিদ্রোহের স্ফটিকগুলো এক সুতায় দানা বাঁধতে শুরু করলো।

বহুদলীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ সরকার শেখ মুজিবুর রহমান রুশ-ভারতের প্ররোচনায় একদলীয় শাসন ব্যাবস্থা ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠা করলেন। আগুনে বাতাস প্রাপ্ত হলে সেই আগুনের কলেবর আরও বৃদ্ধি পায়। আগুনের লেলিহান শিখা দ্রুততার সাথে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলতে তাঁকে। সেই আগুনের দংশনেই দংশিত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিছু জুনিয়র সেনা অফিসারদের দ্বারা এক সামরিক অভ্যুত্থানে স্বপরিবারে নিহত হলেন বাকশালের জনক শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ শাসনের ভারপ্রাপ্ত হলেন মেজর ডালিম, কর্নেল ফারুক, রশিদের মনোনীত খন্দকার মোস্তাকের আওয়ামী লীগ সরকার। মুক্তি যুদ্ধের সময়ের ‘জেড’ ফোর্সের অধিনায়ক জিয়াউর রহমানকে চিফ-অফ-আর্মি স্টাফ পদ থেকে সরিয়ে বন্দি করা হয়। এর পরপরেই আরেক দেশ প্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরের গণবাহিনীর বিপ্লবে কারামুক্ত হয়ে ক্ষমতায় বসলেন জিয়াউর রহমান। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরে ফেলা হলো সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে যিনি ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন জিয়াউর রহমানকে।  এ যেন গল্প উপন্যাসের কোনো উপখ্যান।

বীর মুক্তি যোদ্ধা যিনি স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন বলে দাবি করা হয়, তাঁরই শাসনামলে অদ্ভুতভাবে কিছু বিস্ময়কর পরিবর্তন দেখা গেল। একদিকে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যেমন ভারতের প্রভুত্ব থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের জনগণকে ভিন্ন মাত্রার মুক্তির স্বাদ উপহার দিলেন, আরেকদিকে মুসলিম প্রধান বাংলাদেশিদের মুসলিম চেতনাতে উজ্জীবিত করে গোলাম আজমসহ ৭১ এর স্বাধীনতাবিরোধী চক্রকে পুনর্বাসিত করলেন। কেন্টনমেন্টে অনেক সামরিক অফিসারকে ফাঁসিতে ঝুলানো হলো। রাজনীতির কি এক অদ্ভুত খেলা। বীর মুক্তি যোদ্ধা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রধানমন্ত্রী পদে বসালেন স্বাধীনতার সময়ে স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত শাহ আজিজুর রহমানকে। কুখ্যাত রাজাকার জয়পুরহাটের আব্দুল আলিমকে বানালেন যোগাযোগ মন্ত্রী। সানগ্লাসের আড়ালে দুচোখ ঢেকে রহস্যময় ভঙ্গিতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঘোষণা দিলেন : ‘I will make politics difficult for the politicians.’ এইসময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেকেই ‘বন্দে মাতরম থেকে ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ এর প্রভাব লক্ষ্য করলেন। সংবিধানে সংযোজিত হলো ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’। স্বাধীনতার সময়ের জনপ্রিয় ‘জয়বাংলা’ স্লোগানকে বদলিয়ে ‘জিন্দাবাদ’ স্লোগান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। এতে বাংলাদেশিদের এক বিরাট অংশ যারা ভারতের আগ্রাসন বিরোধী, তাঁরা পুলকিত বোধ করলেন।

ক্যাটনমেন্টের গোলকধাঁধাঁয় আটকে পড়লো বাংলাদেশ। ক্ষমতার মোহে অথবা নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেশ উদ্ধারের সংকল্পে হতভাগিনী বাংলা মায়ের কোল খালি করে মাত্র কয়েক বছরের মাথায় নিহত হলেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ২ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার এবং ‘কে-ফোর্স’-এর সর্বাধিনায়ক বীর উত্তম পদক প্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, ১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার এবং ‘জেড’ ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান; ১১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের, বীর উত্তম; জিওসি মনজুর, বীর উত্তম। ক্ষমতায় বসলেন আরেক ক্ষমতালিপ্সু সেনা অফিসার প্রেসিডেন্ট এরশাদ। বাংলাদেশের জাগ্রত ছাত্রজনতা অনেকটাই ২০২৪ সালের আদলে উৎখাত করলেন এই প্রায় দশ বছরের স্বৈরাচার শাসনকর্তা প্রেসিডেন্ট এরশাদ সরকারকে। ৯১ এর ইলেকশনে জয়ী হয়ে আবারও ক্ষমতায় বসলেন বিএনপি প্রেসিডেন্ট প্রয়াত জিয়াউর রহমানের স্ত্রী আপোষহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিত খালেদা জিয়া। কিন্তু, দুঃখিনী বাংলাদেশ আবারও দেখতে পেল যত্রতত্র দুর্নীতি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আর কোনো বিকল্প খুঁজে না পেয়ে বাংলাদেশিরা সঙ্গত কারণেই নির্বাচিত করলেন ১৯৭৫ সাল হতে ক্ষমতা থেকে দূরে থাকা আওয়ামী লীগ মনোনীত শেখ হাসিনাকে।

৯৬ এর নির্বাচনে বিএনপির তুলনায় বেশি আসন পেয়ে জাতীয় পার্টির সমর্থণ নিয়ে ২১ বছর পরে শেখ হাসিনার হাত ধরে ক্ষমতায় যখন অধিঠিত হলো ওয়ামী লীগ সরকার, আমাদের আজকের জি জেন ছেলেমেয়েরা তখনও এই পৃথিবীর মুক্ত আলো বাতাস দেখার সুযোগ পাননি। তবে আমরা দেখলাম ইতিহাসের এই অংশটুকু থেকে আবারোও বাংলাদেশে ‘বন্দে মাতরম ‘ এর বাতাস বইছে। মেনে নিলেন না সাহসী বাংলাদেশিরা। ২০০১ এর নির্বাচনে দ্বিতীয় টার্মে ক্ষমতায় বসালেন খালেদা জিয়া সরকারকে। হাওয়া ভবনের আকাশচুম্বী দুর্নীতির সময়গুলোতে জি যেন ছেলেমেয়েরা তখন ৫/৬ বছরের শিশু হলেও ২০০৯ থেকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের শাসনের সময় থেকে এই ছেলেয়ের ততক্ষনে হাইস্কুলে উঠেছে । কৈশোরের তারুণ্যে এঁরা দুচোখ ভোরে দেখতে শুরু করেছে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনামল। নির্বিকারভাবে ক্রমশঃ দেখেছে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের আয়না ঘরে ঢুকিয়ে নির্যাতন করছে, অথচ খবরের কাগজে  টেলিভিশনে এসবের কোনো প্রচার নেই (যা জনগণ ক্রমান্বয়ে জানতে পারে ৫ই আগষ্টের পরে)। এই তরুণেরা দেখেছে ভারতীয় নীল নকশা বাস্তবায়নের পথে কীভাবে ঢাকা পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হলো। এই তরুণেরা বুকের ভিতর পুষে রেখেছিলেন সেসব তুষের আগুন।

আওয়ামী শাসনামলে বিশেষকরে হাসিনা সরকারের শাসনামলে ধর্মীয় মৌলবাদ গোষ্ঠীকে ‘রাজাকার’ বিশেষণে বিশেষিত করে বিশেষ নিপীড়ণের শিকার হতে হয় । মেধাবী ছাত্র আবরারকে ‘জামাতশিবির কর্মী’ অবিহিত করে সারারাতভর ঠান্ডা মাথায় পিটিয়ে সকালে নাস্তার টেবিলে বসেন ছাত্রলীগের দামাল ছেলেরা। এর আগে এই ছেলেরা হিন্দু জেনেও দর্জি বিশ্বজিৎকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে মেরে ফেলে। আর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় এই সোনার ছেলেদের কীর্তির কথা কে না জানে! পাপ, বাবাকেও ছেড়ে কথা বলে না। এসব কাহিনী নিয়েই এই ধারাবাহিক তথা উপন্যাস সাজানো হয়েছে। সবটুকু বললেই এখানেই সব শেষ হয়ে যায়। পাঠকদের জন্য এই পর্যায়ে বৈজ্ঞানিক নিউটনের সাথে সুর মিলিয়ে শুধু এতটুকু বলা যাতে পারে: In every action there is an equal and opposite reaction.

এসব হচ্ছে দুঃখিনী বাংলা মায়ের ইতিহাস। এই ইতিহাসে নাগরদোলার বিশাল ঘূর্ণি চাকার শীর্ষে একেকজন ক্ষমতায় বসেছেন আবার কিছু সময় পরেই চাকার তলদেশে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। আর যারা একেবারে চাকার তলায় ছিলেন তাঁরাই ক্ষমতায় বসেছেন। আমাদের ‘এক্স’ জেনারেশনের এই আমরা এবং আমাদের আগের জেনেরেশনদের এসব ইতিহাস একেবারে নখদর্পণে। এরশাদ ভেকেশনের সেশন জোটের জ্বালা এই জি-জেন ছেলেমেয়েদের দেখার কথা না । তবে আওয়ামী শাসনামলের যেসব অত্যাচার কাহিনী এঁরা দেখেছে, সেটিই বা কম কিসে? চাকুরীতে নিজেদের কোটা আদায়ের ন্যায্য দাবি জানাতে গিয়ে এঁরা পুরোনো ইতিহাসের এতো তথ্য জানার আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছে।

স্বৈরাচার সরকারের পাহাড় সমান দুর্নীতি আর জুলাইয়ের ১৬ তারিখের পর থেকে প্রতিদিন পথে ঘাটে আন্দোলনরত ছাত্রজনতার লক্ষ্য করে অতিদানৱীয় কায়দায় পাখির মতো গুলি করে মেরে ফেলা ছাত্র-জনতার লাশ দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে জি-জেন ছেলেমেয়েরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এজেন্ডাকে এক দফায় কেন্দ্রীভূত করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের কোলে চারিদিকে ভারত বেষ্টিত বাংলাদেশ নামক ছোট্ট এক ‘ব’ দ্বীপ ভূখণ্ডে জি জেন ছেলে-মেয়েরা বাংলাদেশিদেরকে ‘বন্দে মাতরম’ এবং ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ এই দুই মতবাদকে মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে !!! সেদিকে তাকানোর সময় নেই এঁদের।  সামনে লক্ষ্য একটাই। স্বৈরাচারের শাসনের অবসান।
ইতিহাস বলে দিবে কোন পথে চলছে স্বদেশ !!!

আগের পর্বগুলি –
পর্ব ১ –পর্ব ১
পর্ব ২ –পর্ব ২
পর্ব ৩ –পর্ব ৩
পর্ব ৪ –পর্ব ৪
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“জেন-জি”: এ জার্নি ফ্রম এক্স টু জেড- পর্ব ৪
পরবর্তী নিবন্ধহালচাল : নভেম্বর ০৫ ,২০২৪
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন