গত কয়েকটা দিন ধরেই অফিসের কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে নিশুর । তার উপর ডাইরেক্টর ঠিক করেছেন এবারের জার্মানের ইন্টারন্যশনাল কনফারেন্সটায় নিশু প্রতিনিধিত্ব করবে। তার জন্যও তাকে ভিসা পাসপোর্টের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে দম ফেলার সময়ও যেন পাচ্ছে না সে। এবার নিয়ে তার চতুর্থ বারের মত জার্মান যাওয়া হচ্ছে তার। প্রতিবারের মত এবারও তার জন্য একই হোটেল বুকিং দেয়া হয়েছে ফ্রাঙ্কফুটের হোটেল আডলারে। আর তার সাথে যাচ্ছে তারই কলিগ কান্তা । এজন্য তার দুশ্চিন্তা যেন একটু কম।
নিশু বৃদ্ধা মাকে সাথে করে তাদের উত্তরার বাড়িতে থাকে। চাকুরী করে হোহেন্সটেইন টেক্সটাইল টেস্টিং ইন্সটিটিউশনে ডিজিএম হিসাবে। অফিসে এমডির পরেই তার অবস্থানটি । তাই এমডি সাহেবের অবর্তমানে অফিসের অনেক ধকলই তাকে পোহাতে হয়। কখনো কখনো অফিস ছুটির পরে বাসায় বসে রাত জেগে তাকে রিপোর্ট করতে হয়। তাদের অফিসের যত বড় বড় কনফারেন্স হয় তার পুরো আয়োজনই নিশুকে দক্ষ হাতে সামাল দিতে হয়। তার দায়িত্ববোধ আর কাজের প্রতি একাগ্রতা দেখে এমডি সাহেব বেশ নিশ্চিন্তবোধ করেন । তাই মাঝে মাঝেই দেশের বাইরের কনফারেন্সগুলোতে তিনি না গিয়ে নিশুকে পাঠান তার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য । আর নিশুও সংসারের কোন ঝামেলা না থাকায় একাজটি করে মনের আনন্দে । এপর্যন্ত তার ইংল্যান্ড, আমেরিকা , কানাডাসহ ঘোরা হয়েছে অনেকগুলো দেশ। হংকং আর থাইল্যান্ড তো তার কাছে এখন শপিং মলে যাওয়ার মতো ব্যাপার । কিন্তু জার্মান ভ্রমনের প্রথমবারের অভিজ্ঞতার কথা মনে হলে এখনো সে আঁতকে উঠে। তার সামনে দিয়ে ভেসে যায় স্মৃতির সেলুলয়েড ফিতা বাংলাদেশ থেকে ১৭ ঘন্টা জার্নি করে যখন নিশু পৌঁছলো ফ্রাঙ্কফুট এয়ারপোর্টে তখন রাত প্রায় আটটা বাজে। এয়ারপোর্টের ফরমালিটিজ শেষ করে সে লাউঞ্জে এসে দাঁড়াতে দেখে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক প্ল্যাকার্ডে তার নাম লিখে দাঁড়িয়ে আছেন । নিশু কাছে যেতেই তিনি জানালেন অফিস থেকে তাকে পাঠানো হয়েছে তাকে হোটেলে পৌছে দেয়ার জন্য।
গাড়ীতে উঠেই মনটা সত্যি ভরে গেল এক অজানা আনন্দে। শহর থেকে বেরিয়ে গিয়ে গাড়ী উঠে গেল হাইওয়েতে। রাস্তা আর বাইরের প্রকৃতি সাজিয়ে উন্নত করে গড়ে তোলা জার্মানভূমি দেখে অভিভূত নিশু। পাহাড় আর সমতলের নানামাত্রিক ভূমি অতিক্রম করে পাড়ি দিচ্ছে মাইলের পর মাইল। বিশেষ করে পাহাড়ি উপত্যকায় অবারিত শস্যখেত আর সাজানো বাড়ি-ঘর ও শিল্প কারখানাগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভদ্রলোক চেষ্টা করছেন জায়গাগুলোর বর্ণনা দেয়ার । তিনি কথা বলছেন জার্মানি আর ইংলিশ মিশিয়ে। এ জন্য তার সাথে তাল মিলাতে নিশুর হিমশিম খেতে হচ্ছে । সেতো আর জার্মান ভাষা বুঝে না। সে বুঝতে পারছে জার্মান ভাষা না জানার জন্য তাকে কতটা ধকল পোহাতে হবে। এখানে বেশির লোকই ইংলিশ বুঝে না । এভাবে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে আর সাত পাঁচ চিন্তা করে প্রায় ২ ঘন্টা পার করে গাড়ী থামলো হোটেল আডলারে । গাড়ী থেকে নামার পরেই ভদ্রলোক তাকে একটি প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন হাতে। নিশু জানতে চাইলো এটার মধ্যে কি?তিনি বললেন ফুড । কেননা শনি রবিবারে এ হোটেলে কোন খাবার পাওয়া যায় না। ভাগ্যিস নিশু রবিবার রাতে পৌছেছে। সে বাক্স পেট্রা সাথে নিয়ে হোটেলের দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী দরজা খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু ডোর কোড কিছুতেই কাজ করছে না। সে রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখে তাকে পৌঁছে দেয়া ভদ্রলোক গাড়ী থেকে বের হয়ে আসছেন। নিশু যেন একটু ভরসা পেল। তিনিও চেষ্টা করলেন দরজা খুলতে। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। উপায়ন্তর না দেখে তিনি ফোন করলেন হোটেল রিসিভশনে। তিনি জার্মানিতে কথা বলে ডোর খোলার নিয়ম জেনে নিলেন। তার সহায়তায় অবশেষে নিশু রুমে পৌঁছতে সক্ষম হয় । এত দীর্ঘ সময়ের জার্নির ধকলে প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে তার । তাই রুমে ঢুকার সময়ে সে আসে পাশের রুমগুলোর দিকে তাকাতেও পারেনি। তাই রুমে পৌঁছে কোন রকমে লাগেজ ব্যাগ নামিয়েই সে ঢুকে ওয়াশরুমে । সেখান থেকে নিজেকে একটু গুছিয়ে সোজা চলে যায় বেডে। কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যে সে আবিস্কার করে রুমের একটা জানালা খোলা থাকায় বাইরে থেকে হুহু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে । সে অনেক চেষ্টা করেও সেটা বন্ধ করতে পারছে না। কিন্তু রুমে কোন ফোন না থাকায় সে ইন্টারকমেও ফোন দিতে পারছে না। তাই বাধ্য হয়ে সে রুম থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু সারা হোটেলে কোন রুমেই আলো না দেখতে পেয়ে আর রিসিপশন খুঁজে না পেয়ে মন খারাপ করে রুমে চলে আসে। রাতটা কম্বলের মধ্যে গুটিসুটি মেরে কাটিয়ে দেয়। সকাল বেলা তার ঘুম ভাঙ্গে এক কলিগের ফোনে। নিশু তার কলিগকে রাতের দুরবস্থার কথা জানাতেই সে বলে “কাল রাতে এই হোটেলে তুমি একা ছিলে। কোন রুমেই কোন গেস্ট ছিল না । শনি রবি বারে ওদের রিসিপশন , ডাইনিং সব বন্ধ থাকে।“ একথা শুনে তো নিশুর সেইন্সলেস হওয়ার মত অবস্থা । সে কোন রকমে জিজ্ঞেস করে “ তাহলে আমাকে আগে জানাওনি কেন?” তার কলিগটি খুব সরলভাবে স্বীকার করে “ এ তথ্যগুলো দিলে তুমি এ সফরে আসতে না। এখন মন খারাপ না করে রেডি হয়ে নাও আমি আসছি তোমাকে শহরটা ঘুরিয়ে দেখাতে।“
নিশু আচ্ছা বলে ফোনটা রেখে দেয়।