দীর্ঘ কবিতা
জাদুঘর থেকে বলছি
অনিরুদ্ধ আলম
পর্ব ১১।।
ভারি চশমার অকপট স্বীকারোক্তিকে পুঁজি করে আত্মবিশ্বাসী বৃদ্ধ ভুলে থাকে একটি সুঠাম ছড়ির অভাব। নকল নেকাবের মতো জীর্ণ কুয়াশা সদ্যজাত রোদের নখে ছিন্নভিন্ন হতে বাকি। সারাবেলা আমাকে পথে ঘাটে মাঠে তাড়া করে বেড়াল তেলনুনের কামনার্ত সংশ্লেষে জন্ম-নেয়া একটা হুলুস্থুল শীৎকার ।
পেশাদার শৃগাল তো নিরীহ শিকার ভেবে খরগোশকে তাড়া করবেই। আঙুল-ফুলে ধর্মান্তরিত কলাগাছের বিভিন্ন প্রজাতির নাম সন্ধান করতে গিয়ে মনে হল– আমার প্ড়ার ঘরটা সুপ্রাচীনকালে লয়প্রাপ্ত ভূগর্ভস্থ কোনো সভ্যতার নিদর্শন। মটরশুঁটির পাতা থেকে কাঁপনের ক্ষরণ চুয়ে পড়লেই বাঁশির সুরে হরণ ডানা মেলে লু হাওয়ার আল্লাদে। ত্রিজগৎ বয়ে-বেড়ানো উটের নিষ্কণ্টক কুঁজের তরঙ্গ খুলে কে গুণবে তৃষ্ণার সুবিবেচনা? এক-চিবুক ক্রোধ নিয়ে লাল মোরগটা আজো প্রতিবাদ করল– কেন ইশকুলে পড়ানো হয় না পাখিদের শ্লোক! অভিবাদন তুলতুলে মিষ্টি কোনো কাঠবেড়ালি? গঙ্গাহৃদিজুড়ে পাঁচডোরা কাঠবিড়ালির বিনম্র পরিক্রমা? ওরকম চনমনে সাগ্রহ প্রত্যাশা কে-না পোষে বিস্মরণ-দগ্ধ চিন্তনে!
খনার বচন থেকে উঠে-আসা আনচান আওড়াতে-আওড়াতে কনিষ্ঠ বর্ষা কুমারপাড়া হয়ে ভুবনডাঙা স্টেশনের দিকে বাঁক নিল। একেকটি কদম লাবণ্য হয়ে ফুটেছে। এর মধ্যে নাইওর এসে হাজির কামনাদের বাড়ি। আঁশহীন আশ্বাসবাণী চিতল-অভিপ্রায়ে চেতনার নিতল সরসীতে খেলা করে। আশার প্রদীপ সুহৃদ ছবির মতো দীর্ঘায়ু হলেও, নানান জাতের রাজপথে বেড়ে-ওঠা ধুলোরা জানতে পারে না চিত্রার পাড়ে গোধূলি-উৎসব কত স্বর্গীয়!
সক্রিয় দরবেশের ঝুলির এককোণে পড়ে-থাকা রুটির অস্তিত্ব ক্ষীয়মাণ হতেহতে বটের দয়ার্দ্র ছায়া তীক্ষ্ণধার বধ্যভূমি। একটি আংটির অভিনয়ে কেটে গেল পাহাড়ে ঘর বাঁধার আকাঙ্ক্ষাময় দিনগুলো। কালো কালির স্বাক্ষর থেকে আধেক অক্ষর খোয়া গেলে খরার জমিতে ফসলহীনতা না-ও দেখা দিতে পারে। ঈগলের নখে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার চেয়ে কিছু রোদ ভেবেছিল– চলনবিলের ধারে ব’সে বড়শি পেতে মাছধরা অনেক ভালো। পরিণতিতে প্রতিশোধের স্পৃহায় আহত হল মাছরা। ঋষি দুর্বাসার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে বর চাইল, যেন তারা কোনো একদিন ঈগলের ঠোঁট হতে পারে। তারপর ঠুকরে খণ্ডবিখণ্ড করে খাবে উচ্ছৃঙ্খল রোদের নির্ঘুম হিংস্রতা।
নিয়ত নিজ্ঝুম কুহকে স্রোতস্বিনী জোছনার ঐকান্তিক তীরে নিরুত্তর জনপদ মুণ্ডহীন বনগরুর প্রশান্তিতে জাগ্রত। কারো কি ধীমান উন্নাসিকতা আজব জিরাফের গ্রীবার মতো ঝুঁকে প’ড়ে আমার ব্যক্তিগত বাগানে আত্মমগ্নের ফলাফলে হানা দেয়? চোখের মণিতে রাখা কণ্বজ শুশ্রূষা মাকড়সার জাল হয়ে নিশিথসূর্যের উপাসনালয় ঘুরে আসে। মুমূর্ষু মোহরের বড়ো পছন্দ বলিষ্ঠ মুঠির হস্তক্ষেপ। মানস সরোবর থেকে উড়ে আসা অপ্সরার মোহে চাঁদনী রাতগুলো কেটেছে বিনিদ্র। কবে, কোথায়, প্রথম নীলনীল চুলের মায়াবিনীরা অপরাজিতার সৌষ্ঠবে সোনালি আলোর তাঁতে বুনেছিল গৃহহীন আকাশ? নির্জনতার দেয়ালহীন দ্রষ্টব্যজুড়ে দখিনা দহে তান্ত্রিক কুমির বেড়াতে এলে, একেকটা যান্ত্রিক শেয়াল বনে পাঠশালা খুলে বসে।
চুলবুলে খইয়ের স্পর্শহীন শুভ্রতা নিয়ে দাম্ভিক রাজহাঁস হেঁটে চলে সকাল পেরিয়ে অনুপুঙ্খ মধ্যাহ্নের দিকে।
স্পর্ধা কি জ্বালাময়ী বল্লমের পরিভাষা? অবহেলিত কোনো দাম্ভিক মন্ত্র বিড়বিড় স্বরে খুচরো কচুরিপানাদের কণ্ঠে বেজে উঠেছিল জলের জ্বলন্ত তাগিদে। সমরখন্দের উচ্ছ্বাসে-আঁকা একটি বিকেল ঝুপ করে নেমে এসেছে বলেই, কদবেল-বৃক্ষের ক্রন্দন থেকে অমসৃণ বেদনাটা নারকেল পাতাদের থুতনি ছুঁয়ে দ্বীপান্তরিত হল। মঙ্গলকাব্যের নাব্য মগ্নতায় সনির্বন্ধ কে কাকে বলে ম্যাজিকওয়ালা? দিনমান নাগরদোলার দ্যোতনাতে চেপে বদলে যায় দোরের ঘর, ঘরের বাড়ি, বাড়ির জন, জনের মুখে বিচ্ছুরিত আবহাওয়া-পূর্বাভাস।
দীর্ঘশ্বাস-উছলানো জামবাটির মতো খাঁখাঁ দিঘি ঝুম বৃষ্টির অপেক্ষা করছে পরিপূর্ণতা পাওয়ার আশায়। গাঁয়ে ডাকাত-পড়ার আতঙ্কে আগের মতো ঘনীভূত হয় না রাত। আঁধার পোহালেও কাকলীরা সুরেলা শিসে কুলুপ এঁটে নীড়ে শীতঘুম দেবে? কলস থেকে ছলকে-পড়া জলে আচমন করতে গিয়ে দেখি– তোমার হাতে মগ্ন এক রুমাল; তাতে লেখা, ‘ভুলো না আমায়!’
বেলা-অবেলায় গঙ্গা থেকে ভ্লগার দূরত্বে প্রবাল হয়ে-যাওয়া ইতিহাসগুলো আজ প্রবল উল্লাসে রাতের বাতাসে তারা হয়ে উড়ে গেল কিছুটা সময়ের জন্যে। ভাঁটফুলের লোপাট হয়ে-যাওয়া খানিক কমনীয়তা খুঁজে পাওয়া যাবেই অনুজ ফড়িঙের নিপাট ডানায়। কে সেই জন– ঝড়ো হাওয়ার সংকেত পেতেই মুহ্যমান শুঁড়িখানার বাগান থেকে সকল চন্দ্রমল্লিকা চুরি করে নিয়ে গেছে? ভাতঘুমের বৈশিষ্ট্যে আপ্লুত জলপোকাদের বিস্তীর্ণ চোখে চলনবিলের চঞ্চলতা আঁকে না উচ্ছন্নে যাওয়ার নিষ্পাপ প্রেম। লজ্জাবতী গাছের মতো বইমেলার ভিড় অসময়ের টুপটাপ বৃষ্টিতে চুপসে যায়। দেবালয়ের আদলে একটি স্বপ্ন পবিত্র হতেহতে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতেই পারে। গত বছরের ধারাবাহিকতায়, সারা রাজ্যে ঢাকঢোল পিটিয়ে পাওয়া গেল না এমন লোক যে কিনা মিছেমিছি অসুর বলিদান উৎসবে অসুরের চরিত্রে অভিনয় করবে। তাকে পেলে জিজ্ঞেস করো – শুধু সকালের দেয়ালে ভালোলাগার শত জানালা গড়লেই চলবে?
ধূ ধূ নৈরাশ্যের দেবতারা জুয়াখেলাতে আসক্ত হয়ে তাদের ডান পায়ের জুতোটা পর্যন্ত বাজিতে খুইয়ে ফেলল। কিন্তু অনেক দিন যে বাঁ-পায়ে হাঁটার অভ্যেস নেই! তাহলে বাড়ি ফেরা? আশার দেবীর পুজোঅর্চনা করতে উঠেপড়ে লেগে গেল তারা। এভাবে এসে গেল ভূত-উৎসব। এবার পাড়ার ছেলেছোঁকড়ারা আগের থেকেই বেশিবেশি করে ভয়ঙ্কর মুখোশগুলো কিনে রেখেছিল। কী আর করা! রাত হলে মানুষের মুখোশ পরে প্রেতাত্মারা গাঁয়েগাঁয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। দক্ষ রসে টইটুম্বুর দ্রাক্ষারা উটপাখির ডিমের মতো স্বপ্ন দেখতে শেখে। সরাইখানাফেরত মাতালটার কাছে অন্তত সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে। তা না হলে সাতটি ঘোড়ার রথে চড়ে সূর্য বোধ করি নিস্পন্দ পশ্চিমর দ্বিধান্বিত দিগন্তেই উঁকি দিত আজ!
সলাজ বিভীষণের খোঁজে সকল সমাজকর্মী শহরতলীর প্রতিটি দেয়ালে নিখোঁজ-সংবাদ সাঁটিয়ে দিল। কিন্তু তাদের মনকে হয়ত মহামতি নিউটনের সেই আপ্ত বাণীটি পর্যাপ্তভাবে প্রাভাবিত করে নি, ‘প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছ।‘ স্বভাবতই প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন করার কথা মনে আসে নি। ফলে যা হবার তা-ই হয়েছে। অদৃশ্য কিছু শত্রু মুখমণ্ডলের উজ্জ্বলতা-বৃদ্ধিকারক পণ্যের ঢাউস বিজ্ঞাপন নিখোঁজ-বিজ্ঞপ্তির সেই পোস্টারগুলোর ওপর রাতারাতি চাপিয়ে দিয়ে সটকে পড়ল।
মেটে বিলম্বের ফটকে একেকটি নীল বৃত্তকে গেছো মেয়ের মনস্তত্ত্ব নিয়ে সোনালি ব্যাসার্ধগুলো গ্রাস করলে, আকাশ হয়ে ওঠে সাগরিকা। ক্ষুধাতুর কষ্ট তো ভিখারি শকুনের বেশে একেকটি পাঁড় মরুভূমি। আকছার জলজ্যান্ত সুখগুলোকে খুবলে খায় বন্ধুসুল্ভ জিঘাংসায়। জোছনা বিষয়ক কয়েক প্রকার সফল জরিপ শেষে যষ্ঠী মধুর কৃপণতায় নামযশহীন হুতুম পেঁচা স্পষ্ট গাছের মগজে জবর স্মৃতিকথাগুলো ফেলে রাখতে ভুলে গিয়েছিল।
খবরের কাগজের স্যাঁতস্যাঁতে সংবাদে ইদানীং শ্যাওলা জমে বড্ড তাড়াতাড়ি। উদ্ভিদ-বিজ্ঞানের শিক্ষক নিয়াজ করমচা বিষয়ক যে হাইকুগুলো লিখেছিল সেগুলো এখন বোটানিক্যাল গার্ডেনের পরিচর্যা বিষয়ক পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত। মুখরা রমণীদের মুখেমুখে ফিরতে লাগল, ‘ফেসবুকে এখন বিনেপয়সায় মিলছে কচুরিপাতা হতে আচার তৈরির দারুণ রেসিপি।‘ আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর নির্লজ্জ দাপটে কানাকড়ির যাবতীয় স্বত্ব সম্প্রতি টাকার কুমিরদের দখলে।
জরাসন্ধ-ভূমিকায় অবতীর্ণ না-হতে পেরে নিন্দুক সকলে বলে, মাছিদের মর্মর ছাঁচে গড়ে ওঠে মোহ, মোহের মহুয়াবাগান। বাগানের চারদিকে ঘিরে থাকে অদৃশ্য বাঘদের ফেলে-যাওয়া পায়ের দগদগে দাগ। এসব প্রয়োজনীয় কথা যখন গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে তখন মিছরির মাছরা ঢেউদের শিরা-উপশিরা ছিঁড়ে জলের অবতলে ভেসে উঠবে। মেঘদেরকে ভেঙচি কেটে বলবে, ‘হ্যাঁ গো, এ তল্লাটে তোমরা নতুন বুঝি? তাই হয়ত সেলাম দিতে ভুলে গেছ!’ (চলবে…)