কোরবানি ঈদের দিনে বেলা প্রায় সাড়ে বারোটার দিকে রাহেলা বেগমকে দেখা গেলো একটি স্টিলের তৈরী বেঞ্চিতে বসে নিশ্চুপ হয়ে সামনেই থাকা বিশাল জলরাশির দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছেন। তাঁর ছেলে সিরাজ উদ্দিন তাঁর সাত/আট টি বন্ধুদের ফ্যামিলি নিয়ে টরন্টো শহর থেকে উত্তর দিকে একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামের কাছে একটি প্রকান্ড লেকের ধারের পাশে ফার্মে এবারের কোরবানি ঈদ উজ্জাপন করতে এসেছেন। সবাই যে কোরবানি করতে এসেছেন, তা না, দুই/তিনটি পরিবার এসেছে সঙ্গ দিতে, বেড়াতে। প্রায় দশ/বারো বছর এ দেশে থাকলেও এভাবে সরাসরি ফার্মে কোরবানি করার অভিজ্ঞতা সিরাজ উদ্দিনের এবারেই প্রথম। আইডিয়াটা অবশ্য সিরাজ উদ্দিনের এক বন্ধুর। যদিও এখানে করোনা ভাইরাসের দাপট কিছুটা কমে এসেছে, তবুও এখনো কারো বাসায় দল বেঁধে বেড়াতে যাওয়া তেমন শুরু হয় নি। তাই, বুদ্ধি করে ঠিক করা হয়েছে এবারের কোরবানির ঈদ একটু অন্যরকম করে যেন উজ্জাপন করা হয়। বন্ধুদের নিয়ে স্বপরিবারে একসাথে গল্প গুজব করে বেড়ানোও হলো আবার সরাসরি কোরবানি দেওয়াও হলো।কোরবানির গরুর দাম পড়েছে দুই হাজার ডলার। পাঁচ ভাগে একেকজনের জন্য চার শত ডলার করে । যেহেতু গরুতে সাত ভাগ পর্যন্ত দেয়া যায়, আরো দুই বন্ধুকে যোগ করা যেতে পারতো কিন্তু পাছে একেকজনের মাংসের ভাগ আবার কমে যায় এই চিন্তা করে মূল উদ্যোগকারীর বন্ধুর আপত্তির মুখে যোগ করা হয় নি।
দুপুরের খাবার, বিকালের স্নাক্স প্রভিতি সাথে করে নিয়ে এখানে সকাল সকাল সবাই চলে এসেছে। খুব ভোরে না এলে, ফার্মে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তাই দুই বন্ধু কাছে পিঠে কোথাও ঈদের নামাজ আদায় করে আগেভাগে এসে কোরবানি সম্পন্ন করেছেন। পরে, অন্যান্য বন্ধুরা প্রায় সাড়ে এগারোটা /বারোটার মধ্যে স্বপরিবারে এখানে চলে এসেছে।
লকডাউনের পরে বেশ কিছু বীচ, পার্ক বিশেষ ব্যাবস্থায় খুলে দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে এটি একটি । প্রবাসের কর্মমুখর যান্ত্রিক জীবনে শহরের কোলাহল থেকে দূরে এভাবে ঈদ উজ্জাপনের আইডিয়াটা একেবারে মন্দ হয় নি। সিরাজ উদ্দিনের বন্ধুরা সবাই মিলে একেবারে দেশীয় স্টাইলে মাঠে মাদুর পেতে কোরবানির মাংস কাটাকাটি করছে। মহিলারা বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। অনেকদিন পর একসাথে ভাবীদের পেয়ে খোশ গল্পে মশগুল। বাচ্চাদের জন্য এ এক অভিনব দৃশ্য। এভাবে আস্ত জবাই করা গরুর মাংস কাটাকাটি দেখার অভিজ্ঞতা এখানে বেড়ে উঠা বাচ্চাদের জন্য এই প্রথম।
এদেশের লেকগুলি যেন একেকটি সমুদ্রের মতো। পার্থক্য শুধু সমুদ্রের মতো অত গর্জন নেই, অত বড় ঢেউ নেই। ঢেউ যে একেবারেই হয় না তা না, দুই একটি স্পিডবোট পানি কেটে যাওয়ার সময় ছোট ছোট ঢেউগুলো ফেনার মতো করে পাড়ে আছড়ে পরে। একটু বাতাসের দিন হলে ঢেউগুলি আকারে কিছুটা বড় হয়। পাড়ে থাকা পাথর খন্ডের উপর বসে খালি পায়ে পানিতে পা ডুবে বসে থাকলে এই হালকা ঢেউগুলি পায়ের কাছে শির শির করে এবং এক অদ্ভুৎ অনুভূতি লাগে যা রাহেলা বেগমের বেশ ভালো লাগে। ছেলের পরিবারের সাথে রাহেলা বেগম প্রতি বছর সামার এলেই অনেকবার বিভিন্ন লেকের বীচে, পার্কে বেড়াতে যায়। রেহেলা বেগমের মেঝো সন্তান মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন যে শখ করে আজকাল তার মা কে নিয়ে এসব জায়গায় ঘুড়ে বেড়ান ঠিক আক্ষরিক অর্থে তা না, অনেকটা বেকায়দায় পরে। সেই বেকায়দা পরার রহস্য হলো সিরাজ উদ্দিনের পরিবারের এখনকার নিয়ম হচ্ছে স্ত্রী রুবিনার আদেশ মোতাবেক মাকে বাসায় একা রেখে কিছুতেই সবাই একসাথে বাহিরে বেড়ানো যাবে না,মা, রাহেলা বেগমের নাকি হাত টানের স্বভাব আছে।
প্রায় বছর সাতেক আগে সিরাজ উদ্দিন যখন তার মাকে এদেশে স্পনসর করে নিয়ে এলেন, শুরুর দিকে প্রায় বছর দুয়েক এবাড়িতে রাহেলা বেগমের প্রচুর কদর ছিল। রাহেলা বেগম যা খেতে পছন্দ করতো বাংলাদেশী গ্রোসারি থেকে দ্রুত নিয়ে এসে রান্না করে মা কে খাওয়ানো হতো। মা কে নিয়ে বন্ধুদের বাসায় বিভিন্ন দাওয়াত পার্টি, নায়াগ্রা ফলস , অটোয়া, প্রভৃতি জায়গায় ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি প্রবল বেগে চলছিল । তখন সিরাজ উদ্দিনের বড় ছেলে পিয়ালের বয়স ছিল প্রায় নয় বছর, ছোট মেয়ে পলিনের বয়স মাত্র সাত বছর । তাই বেবিসিটিং এর জন্য সঙ্গত কারণেই মা রাহেলা বেগমের প্রতি যত্ন আত্তির মাত্রা ছিল চোখে পড়ার মতো।
মেঘে মেঘে বেলা হলো। প্রবাসে সিরাজ পরিবারের বাচ্চারা বড় হলো। রাহেলা বেগমের কদর যেন ইকোনোমিক্স এর ক্রম হ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধির মতো নিম্নগামী হলো। গত কয়েক বছর ধরে রাহেলা বেগম দেশে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হলেও ছেলে বিভিন্ন টালবাহানার পাল্লায় পড়ে আর যাওয়া হলো না। এখকার পরিস্থিতি অবশ্য আলাদা। এই মহামারীর সময় দেশে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। রাহেলা বেগম একদিকে যেমন দেশে রেখে আসা নাতি নাতনিদের জন্য ছটফট করছিলেন, অন্য দিকে এই প্রবাসে ছেলে সিরাজ উদ্দিনের সংসারে ক্রমাগত অবহেলার শিকার হতে লাগলেন । সিরাজ উদ্দিনের ছেলে/মেয়েরা এখন বড় হয়েছে, নিজেরা সব সময় ইংরেজিতে টকটক করে কথা বলে, দাদি-নাতি/নাতনিদের সাথে সক্ষতা নাই বললেই চলে । ছেলে সিরাজ উদ্দিন ও বৌমা দুইজনেই সাত দিনই চাকরি করে প্রানপনে চেষ্টা করছে টাকা জমিয়ে একটি ছোটমোটো বাড়ি কিনতে, রাহেলা বেগমের সাথে তাদের খুব সামান্যই কথা/বার্তা হয়।
গত বছর রাহেলা বেগমকে ছেলের সংসারে প্রথমবারের মতো কিছুটা লজ্জাজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হলো। রাহেলা বেগম প্রায় সপ্তাহ দুয়েক হলো খেয়াল করেছিলেন একটি পাম্প ছাড়া বাস্কেট বল এপার্টমেন্টের বারান্দায় এক কোনায় পরে আছে। রাহেলা বেগম ভেবেছিলেন, বলটি বোধ হয় এরা ফেলেই দিবে তাই বলটিকে দেশে নিয়ে পাম্প/টাম করে তার ছোট নাতি রিফাত কে খেলার জন্য দিবেন। তাই বলটি সুটকেসের মধ্যে কাপড়ের মধ্যে রেখে দিয়েছিলেন। এদিকে একদিন হুট্ করে বলটির খোঁজ পড়লো। রাহেলা বেগম ছিলেন বাথরুমে। তিনি ভেবে রেখে ছিলেন, বাথরুম থেকে বের হয়ে বলটি সুটকেস থেকে বের করে ওদের দিয়ে দিবেন। এরই মধ্যে সিরাজ উদ্দিনের ছোট ছেলে পিয়াল দাদির সুটকেস থেকে বল বের করে এনে মায়ের হাতে দিতেই একেবারে এলাহী কান্ড। সেদিন রাহেলা বেগম প্রবাসে ছেলের সংসারে এসে এতবেশি লজ্জা পেয়ে ছিলেন যে পরে ছেলেকে ডেকে আর ক্লিয়ার করে ঘটনা টি বলতে পারেননি। তবে, অনেক রাতে পাশের ঘর থেকে ছেলে ও বৌমার কথপোকথনের খানিকটা কানে আসায় অনেক রাত পর্যন্ত নিঃশব্দে একা একা কাঁদলেন মৃত জালাল উদ্দিনের স্ত্রী তিন সন্তানের জননী রাহেলা বেগম ।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ছিল আরো মামুলি। শীতকালে, এদেশে ঘর গরম করার জন্যে হিটিং চালু রাখতে হয়। হিটিং এর কারণে গায়ের চামড়া অনেকটা চটচটে হয়, তাই ময়শ্চারাইজিঙ ক্রিম হাতে /মুখে দিলে ভাল হয়। রাহেলা বেগম বাথরুমের বেসিনের পাশে রাখা ময়শ্চারাইজিঙ ক্রিম হাতে দিতে দিতে নিজের বেড রুমে গেলেন। ক্রিমটি হাতে মুখে ভালো করে ডোলে ঘরেই রাখা ছিল, বাথরুমে আর রাখা হয় নি। একদিন বাহিরে যাবার সময় কি মনেকরে ক্রিমটি হাতে দিতে দিতে রাহেলা বেগম পার্স এর মধ্যে রেখে দিয়েছিলেন। সেই অবধি ক্রিমটি ওখানেই ছিল। একদিন নাস্তার টেবিলে সবাই নাস্তা করছে। গৃহকর্তী রুবিনা কাজে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে । হটাৎ রুবিনা চেচামেচি শুরু করলেন:
-‘ময়েশ্চারাইজিং ক্রিম কোথায় গেলো? এখানেইতো ছিল!’
রাহেলা বেগম সরল মনে বললেন ‘বৌমা, ওটা বোধ হয় আমার পার্সেই আছে, আমি ব্যাবহার করার পরে বাথরুমে রাখতে ভুলে গিয়েছিলাম। বৌমা ছেলের সামনেই ঝাঝিয়ে উঠলেন :
-‘মা, না বলে কোনো কিছু লুকিয়ে রাখা কি ঠিক! সেদিন, পিয়ালের বল আপনার সুটকেস থেকে পাওয়া গেলো, আজ ক্রিম পার্স এর ভিতর কাউকে না বলে রেখে দিয়েছেন, এসব কি! আপনার নাতি.নাতনিরা আপনার কাছ থেকে কি শিখবে বলেন ?’
ছেলে সিরাজ উদ্দিন নাস্তা শেষে চা কাপে দুধ ঢেলে চামচ নিয়ে নাড়ছিলেন। পরম যত্নে সেই কাজটি করতে করতে মায়ের দিকে সরাসরি না তাকিয়ে মিন মিন করে বললেন:
‘মা, তোমার কিছু লাগলে আমাকে বলবে, না বলে কোনো কিছু নিবে না মা। আমার আর এসব ভালো লাগে না।’
রাহেলা বেগম সবজি দিয়ে হাতে বানানো রুটি খাচ্ছিলেন। একটি রুটি খাওয়া শেষ হয়ে বাকি অর্ধেকটা প্রায় শেষ হওয়ার পথে ছিল। শেষটা বোধ হয় আর গলা দিয়ে নামলো না । তিনি অপলক দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
এতোসব ঘটনার পরে সিরাজ উদ্দিনের পরিবারে যা ঘটলো তা হচ্ছে সিরাজ উদ্দিন বা তাঁর স্ত্রী যখন দুই জন এক সাথে বাহিরে বের হন বাচ্চাদেরকে তাদের দাদির উপর নজরদারি করার জন্য ব্যাপক নির্বাহী ক্ষমতা দেয়া শুরু হলো। আর সবাইকে যখন একসাথে কোথাও শপিংয়ে বা দাওয়াত খেতে যেতে হয় তখন সাথে করে রাহেলা বেগমকেও অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিতে হয়। আজ যেমনটি হয়েছে।
গতমাসে সিরাজ উদ্দিন ঠান্ডা বেঁধে প্রায় ফেঁসেই গিয়েছিলেন। গলার মধ্যে খুশ খুশে ভাব, একটু একটু গলা ব্যাথা, একটু পর পর হাচ্চি, গায়ে হালকা জ্বর, প্রভৃতি লক্ষণ দেখা দেয়ায় স্ত্রীর প্রবল চাপা চাপির মুখে করোনা ভাইরাসের টেস্ট করতে হলো। কপাল গুনে, টেষ্টের রেজাল্ট নেগেটিভ হওয়ায় সিরাজ উদ্দিন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু, স্ত্রীর নির্দেশে সাবধানতা অবলম্বন করে সিরাজি উদ্দিনকে টানা দুই সপ্তাহ আলাদা ঘরে কোয়ারেন্টাইন মেইনটেইন করে থাকার ব্যাবস্থার মধ্যে থাকতে হলো । এই দুই সপ্তাহে জালাল উদ্দিনকে অনেকটাই স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে বিহীন অবস্থায় থাকতে হলো । মা, রাহেলা বেগমের অপরিসীম সহযোগিতায় আদা, কাঁচা হলুদ, গুলি মরিচ পানিতে গুলিয়ে সময় মতো ভ্যাপার নেয়া, একটু পর পর গরম পানি দিয়ে ছেলেকে গাৰ্গেলিং করানো, আদা চা খাওয়ানো ইত্যাদির প্রভাবে নিমিষেই সিরাজি উদ্দিন সুস্থ হয়ে উঠলেন। এই জগৎ সংসারের এ একদ্ভুত খেলা, নিজ স্ত্রী, ছেলে/মেয়ে যখন চরম দুর্দিনে কাছে থাকে না, সেই দুর্দিনে পাশে থাকে যে মানুষটি, সেই জননীকে আমরা কত তুচ্ছ কারণেই না অবজ্ঞা করি, অবহেলা করি, অপমান করি !!
শহরের অদূরে লেকের ধারের আজকের এই ঈদ আনন্দ উজ্জাপনের আয়োজন পুরো দস্তুরমতো চলছে। বেলা গড়িয়ে সূর্য কিছুটা পশ্চিম আকাশের দিকে হেলে পড়েছে। কোরবানির মাংসের কাটাকুটি প্রায় শেষের দিকে। দুপুরের খাবারের জন্য সাময়িক বিরতি চলছে। দুপুরের খাবারের আগে দিয়ে বাচ্চাদের খেলাধুলার একটি প্রতিযোগিতামূলক আয়োজন হয়ে গেলো । বিকালে কালচারাল ইভেন্টের পরে পুরস্কার দেয়া হবে। এখন দুপুরের খাবার দাবার পর্বের প্রস্তুতি চলছে। রাহেলা বেগম মহিলাদের আড্ডাস্থল থেকে কাছে পিঠে একটি গাছের ছায়ায় চেয়ারের উপর বসে থেকে জোহর নামাজ আদায় করলেন। বাথরুমে যাওয়া দরকার, কিন্তু বৌমা গল্পের আসরে ব্যাস্ত। রাহেলা বেগম মনে মনে ভাবছিলেন ছেলেকে ডেকে বাথরুমে যাওয়া যেতে পারে । কিন্তু ছেলে সিরাজ উদ্দিন একনাগাড়ে বন্ধুদের সাথে সমানে বক বক করেই চলেছে। এরই মাঝে, মেঘ না চাইতেই জল চাওয়ার মতো গল্পের আসর থেকে এক ভাবি এগিয়ে এসে রাহেলা বেগম কে ছালাম দিয়ে কথা বলা শুরু করলেন :
-‘খালাম্মা, আপনাকে দেখে আমার ছোট খালার কথা মনে হলো, হুবহু আপনার মতো দেখতে, এই দুই সপ্তাহ আগে করোনা ভাইরাসের কারণে মারা গেছেন, আগে থেকে এজমা ছিল। খালাম্মা, দেখলাম অনেক্ষন আপনি লেকের পাশে বেঞ্চিতে একা একা চুপচাপ বসে আছেন। ভাবছিলাম আপনার পাশে বসে কিছুক্ষন গল্প করি, পাছে আপনে কি মনে করেন তাই আসা হয় নি। এখন আবার দেখলাম নামাজ পড়ছেন, তাই ডিস্টার্ব করিনি কিছুক্ষন কথা বলি, খাল্লামা?’
-অবস্যই মা , আমাকে একটু বাথরুমে নিয়ে যাবে মা? বাথরুম থেকে এসে গল্প করা যাবে ।
-‘কি নাম তোমার?’
-খালাম্মা, আমার নাম কোহিনুর। জন্মের সময় আমার গায়ের রং কালো কুচকুচে হওয়ায় আম্মাকে খুশি করার জন্য আব্বা আমার নাম মূল্যবান হীরক খন্ডের সাথে মিল রেখে রাখলেন কোহিনূর, দেখেন দেখি, কি অদ্ভুত কান্ড। এই বলে, মহিলাটি খিল খিল করে হাসতে লাগলো। মহিলাটির অমায়িক হাসিতে রাহেলা বেগম কিছুটা উচ্ছসিত হলেন। একটি মহিলার প্রাণ খুলে কথাবলার ধরণ দেখে রাহেলা বেগমেরও বেশ ভালোও লাগলো, অনেক দিন এই প্রবাসে পরিবারের বাইরের কেউ তাঁর সাথে সাবলীলভাবে কথা বলছে।
– ‘এইখানেই শেষ না, খালাম্মা, আমার কালো রং নিয়ে আরো কাহিনী আছে । কলেজ জীবনে দুষ্ট সহপাঠীরা নববর্ষে আমার নাম রাখলো ‘মা কালী, আমাকে দেখলেই পুরোটা না বললেও শুধু মা বলতো, আর আমি ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলতাম। আমাকে কাঁদতে দেখে ওদের সে কি উল্লাস হতো। প্রায় দিন কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরতাম। বাবা অলক্ষে বোধ হয় সব বুঝতেন। একদিন রাতের বেলা, আমার দরিদ্র বাবা আমার রুমে এসে দরজা বন্ধ করে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটি ফেয়ার এন্ড লাভলী ক্রিম বের করে আমার হাতে দিয়ে আমার হাত ধরে অনেক্ষন কাঁদলেন। আমাদের পরিবারের দারিদ্রতার পাশাপাশি আমার গায়ের কালো রং নিয়ে পরিবারে একটি উটকো ঝামেলা তৈরি হলো। অথচ, খালাম্মা দেখেন, এই রহস্যময় পৃধিবীতে কত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, এই কালো মেয়েকেই এক ধনীর দুলাল বিয়ে করে একেবারে কানাডাতে নিয়ে এলো। এতদিন পরে ফেস বুকের মাধ্যমে আমার ও বরের কানাডার সুন্দর সুন্দর সব জায়গায় সুন্দর সুন্দর সব ছবি দেখে কলেজের সেই ছেলেদের একেবারে আক্কেল গুড়ুম অবস্থা।’
মহিলাটি, আবারো হাসছে, এবং অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, হাসতে হাসতে মহিলাটির চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। রাহেলা বেগমকে সম্পূর্ণ অবাক করে, কোহিনুর নামের মহিলাটি রাহেলা বেগমকে জড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। মহিলাটিকে সান্তনা দেয়ার জন্য রাহেলা বেগম মহিলাটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকলেন:
-‘মা রে, আমাদের বিশেষ করে মায়েদের জীবনের প্রত্যেকেরই বেশ কষ্টের, আঁধারের কিছু দিক থাকে, এসব ভুলে যেয়ে আমাদের মানে মায়েদেরকে অনেক কিছু মানিয়ে নিয়ে চলতে হয় । আমাদেরকে বাঁচতে হয় বর্তমান নিয়ে। বর্তমান সুখ ই হচ্ছে আসল সুখ রে মা। আমার কথা শোনো, আজ তো কোরবানির ঈদ তোমাকে আমার এক কোরবানির গল্পের কথা শুনাই:
-‘আমি সিরাজের বাবার সাথে বিয়ে করে উনাদের যৌথ পরিবারে মেঝো বউ হয়ে এসেছি। প্রথম সন্তান জন্মের সাত দিনের মধ্যে আতুর ঘরেই নাড়ি কাটার সময় ধাত্রী মহিলার অসাবধানতার কারণে টিটেনাস হয়ে মারা গেলো। বছর দুয়েক পরে, সিরাজ জন্মের বছরেই আমার শশুর মারা গেলেন। বড় ভাসুর একটি পত্রিকা অফিসের বিনা বেতনে এডিটরের সহকারী হিসাবে কাজ করেন। সিরাজের বাবা বেকার মানুষ, পাড়ায় একটি গ্যাস সিলিন্ডারের দোকান দেয়ার জন্যে এক বন্ধুকে কিছু টাকা দিয়ে ছিলেন, কিন্তু টাকা নিয়ে সেই বন্ধু উধাও। শাশুড়ি মা প্যারালাইসিসের রুগী। বড় ‘জা’ অর্থ্যাৎ বাড়ির বড় বউ ফ্যামিলি প্লানিং অফিসে চাকরি করে। উনার টাকা দিয়েই মূলত সংসার চলে। সংসারে, সিরাজের বাবার ছোট ছোট ছয় ভাই/বোন । রান্না ঘরের দায়িত্ব মূলত আমার উপরই ভার দেয়া ছিল। সেবার কোরবানির ঈদের আগে কি কারনে যেন সেই ‘জা’ এর অফিসে কি ঝামেলা হওয়ায় বেতনের টাকা আটকে পড়লো। সিরাজের বাবা যাদের সাথে সাত ভাগে একটি গরু কোরবানির কথা ঠিক করে রেখেছিলো তারা সবাই টাকা দিয়েছে শুধু আমরাই দেয়নি । কোরবানী দেয়া হবে না , এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পাচ্ছিলাম না । কানের দুল খুলে সিরাজের বাবার হাতে দিয়ে বললাম, এটা বন্ধক রেখে শ্বাশুড়ি মার নামে এক ভাগ কোরবানি দিন। সিরাজের বাবা চোখ বড় বড় করে বললেন, -‘আল্লাহ কি বলেছে গা থেকে গয়না খুলে বন্ধক দিয়ে কোরবানি দিতে হবে? যাহোক, সেবার আর কোরবানি দেয়া হলো না । ঈদের আগের দিন বড় ‘জা’ তাঁর দেবর অর্থাৎ সিরাজের বাবার হাত পঞ্চাশ টাকার একটি নোট দিয়ে বললেন ছোট সাইজের একটি ইলিশ মাছ কিনে আনতে। বেচারার বাজার করার তেমন অভ্যাস ছিল না। একটি পচা মাঝারি সাইজের ইলিশ মাছ কিনে এনে আমার হাতে দিলেন। আমি ঈদের দিন লেবুর পাতা মিশিয়ে নারকেল দিয়ে বেশ যত্ন করে ইলিশ মাছটি রান্না করলাম। সিরাজ উদ্দিনের সব ভাই/বোন বড়’জা’, শাশুড়ি সবাই মিলে খুব মজা করে চেটেপুটে খেলেন। খাবার শেষে শাশুড়ি মা আমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন:
-‘মা, আজ কোরবানির ঈদের দিনে তুমি যে সুন্দর করে রেঁধে আমাদের ইলিশ মাছ খাওয়ালে, তোমাকে অনেক দোয়া দিচ্ছি রে মা, আল্লাহ তোমাকে সুখী করবেন। কথা বলতে বলতে রাহেলা বেগমের গলা কিছুটা ধরে এলো। মা রে, দেখো, আমরা আজ কত সুখে আছি। আলহামদুলিল্লাহ বলো মা। আমাদের এই জননীদের আল্লাহ আজ কত সুখে রেখেছেন।’
এই বলে, রাহেলা বেগম আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন। কোহিনুর বেগম ও চোখের পানি আটকিয়ে রাখতে পারলেন না। দুই জন একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। শোঁ শোঁ শব্দ করে একটি স্পিডবোর্ড লেকের পানিতে এগিয়ে চলছে। ছোট ছোট পানির ঢেউ মৃদু শব্দ তুলে পাড়ে আছড়ে পড়ছে। লেকের ধারে, কিছু স্থানীয় সাদা বাচ্চারা বালি দিয়ে খেলছে। ওদের বাবা-মারা ছাতির নিচে অর্ধ উলঙ্গ হয়ে উবু হয়ে শুয়ে থেকে সান-বাথ করছে । ঈদ উজ্জাপন করতে আসা এই প্রবাসী কিছু মানুষদের আনন্দ মুখর মুহূর্তগুলির মাঝে সবার অলক্ষে এই দুই রমণীর নিঃশব্দ কান্না বড্ড বেশি বেমানান মনে হচ্ছে।
ওদিকে খাওয়া দাবার আয়োজন শেষ পর্যায়ে। প্রত্যেক ফ্যামিলির জন্য আলাদা আলাদা মাদুরে মোটামুটি সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং মেনে চলে প্লেটে খাবার দেয়া হয়েছে। মায়েরা তাদের বাচ্চাদের প্লেটে খাবার দিয়ে নিজেরাও খেতে বসে গেছেন। সিরাজ উদ্দিন সহ অন্যান্য বন্ধুরা মাংসের ভাগ বাটোয়ারা শেষে খেতে বসেছেন। রাহেলা বেগমকে সঙ্গ দিতে কোহিনুর নামের সেই ভাবীটি দুজনে একটি গাছের ছায়ায় চেয়ারে বসে খেতে খেতে গল্প করছেন। আরো চোখে রাহেলা বেগম খেয়াল করলেন, তাঁর ছেলে সিরাজি উদ্দিন প্রবল ভাবে একনাগাড়ে বক বক করেই চলেছে, নিজের খাবারের দিকে কোনো খেয়াল নেই।
কিছু বাঙ্গালী মানুষজন একসাথে হলে কিভাবে কিভাবে যেন আড্ডার বিষয়বস্তু রাজনীতির দিকে চলে যায়, সে আড্ডা বাংলাদেশের কোনো শহরতলীর চা ষ্টল হোক, বা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি এস সি চত্বর হোক, এমন কি প্রবাসে কোনো দাওয়াতী অনুষ্ঠান হোক , ঘুরে ফিরে সহ আলাপ ওই রাজ্নীতি। আজকের আলাপের বিষয়টি কি মনেকরে ব্যাচারা সিরাজ উদ্দিন গণ স্বাস্থ্যের ডঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাহেবের কথা তুলে ছিলেন, আর সবাই অমনি হামলে পড়লেন ।মাননীয় স্বাস্থ মন্ত্রী সহ একে একে অনেকের কথাই উঠলো । এই মুহূর্তে সিরাজি উদ্দীনদের আড্ডায় কিছুটা চড়া গলা শোনা যাচ্ছে আলাপের বিষয় দ্রুত ডাঃ সাবরিনা হয়ে চলে এসেছে ঢাকার রিজেন্ট হাসপাতাল প্রতারণা ও জালিয়াতির মামলায় প্রধান আসামি এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. সাহেদ এর কাছে। মোটামুটি সবার খাবার প্রায় শেষ বললেই চলে, এক মাত্র সিরাজ উদ্দিনের প্লেটের খাবার একেবারে ওরকমই আছে, এক দলা ভাত পেটে পড়েছে কিনা সন্দেহ । হটাৎ করে, রাহেলা বেগম চেয়ার ছেড়ে ওদের কাছে চলে এলেন।
-‘বাবারা, তোমরা এখানে এসেছো সবাই মিলে ঈদের দিনে আনন্দ করবে, এখানে দেশের রাজনীতির আলাপ কি না করলেই না। এদেশে থাকো, এদেশের কথা ভাবো, এদেশ নিয়ে কথা বলো। নিজেদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে কথা বলো। বাংলাদেশ নিয়ে যদি এতোই ভাবো, তবে ওদেশের হতদরিদ্র মানুষদের নিয়ে কথা বলো। যতদূর শুনেছি, একে তো করোনা ভাইরাস তার মধ্যে আবার বন্যা র পানি বেড়েই চলেছে, দেশ নিয়ে যদি এতোই ভাবো, তবে এভাবে নিজেদের মধ্যে জগড়া ফ্যাসাদ না করে সবাই মিলে ওদের আর্থিক সাহায্য করো। চারিদিকে সুন সান নিরাবতা। রাহেলা বেগম এক ঝটকায় ছেলে সিরাজি উদ্দিনের হাত ধরে ওর খবর প্লেট নিয়ে হেটে যেয়ে নিজের চেয়ারে সিরাজ উদ্দিনকে কে বসিয়ে বললেন:
-‘এই, আমি তোমার মা বলছি, তুমি এখানে বসে খাওয়া শেষ কর, তারপর, বাকি কথা।
সিরাজ উদ্দিন তাঁর মায়ের এই চেহেরা শেষ কবে দেখেছিলেন কিছুতেই মনে করতে পারলেননা। সবাই, চুপ করে রাহেলা বেগমের কান্ড কারখানা দেখছে। অনেকে সেলফোনে ক্রমাগত মা ও ছেলের ছবি তুলছে। একজন মা একটি তর্কের আসর থেকে ছেলেকে তুলে এনে ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়াচ্ছে। আহা!! লেকের পাশে এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। হয়তো যারা ছবি তুলছেন তাদের মধ্যে কেউ কোনো এক মা দিবসে আজকের মা/ছেলের এই ছবি রাহেলা বেগমের বীরত্ব গাঁথা সহ ফেস বুকে পোষ্ট করবেন। অমনি, হুমড়ি খেয়ে প্রবাসে মাতৃহারা সন্তানেরা নিজ নিজ মৃত মায়ের কথা ভেবে ভেবে গদ গদ হয়ে সেই পোষ্টে রং বেরঙের শব্দ প্রয়োগ করে বাহারি কমেন্ট করবেন।
এভাবেই রাহেলা বেগম রা কখনো কবিতা, গল্প বা উপন্যাসের সাবজেক্ট হয়ে বছরের পর বছর
লেখকের লেখার কাটতি বাড়ান, লেখকের ফেসবুকের পেজে চমকে দেয়া কিছু পোষ্ট পোড়ে কিছু মানুষকে আন্দোলিত করেন। আর ওদিকে সিরাজ উদ্দীনরা সংসারের অমোঘ নিয়মে নিজনিজ সন্তান, স্ত্রী, পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভাবতে যেয়ে রাহেলা বেগমদের এক নিরাপত্তাহীন অসম্মানজনক পরিবেশে নিক্ষিপ্ত করেন । এর মাঝেও, কিছু বিদুষী রমণী, স্ত্রী তথা জননীদের সংস্পর্শে এই ধরিত্রী সূচি হয়, আধমরাদের জাগিয়ে তোলে। ড্রয়িং রুমের এক কোনায় দেয়ালে টাঙানো ফ্রেমের মধ্যে রাহেলা বেগমদের ছবির পাদদেশে ধ্রুবতারা মতো যুগের পর যুগ জ্বলজ্বল করতে থাকে মাত্র তিনটি বর্ণ নিয়ে গঠিত ছোট্ট অথচ কত ভয়ঙ্কর পাওয়ারফুল একটি শব্দ ‘জননী’ ।
তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।
যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো,
আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা ॥
তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
তব মুখ সদা মনে জাগিতেছে সংগোপনে,
তিলেক অন্তর হলে না হেরি কূল-কিনারা।
কখনো বিপথে যদি ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি
অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা।
তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।