“ভাইসব, জাতির পিতা ইব্রাহিম, শেখ মুজিব ঘোড়ার ডিম, ভাইসব, হুশিয়ার, ভারত কিন্তু আমাদের দেশে এটম বোমা ফেলতে আচ্তিছে, সাধু সাবধান, আমার দেশ-তোমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ, জাগো বাংলাদেশ জাগো।  বিশ্বাস করেন, আমার ছেলে হিন্ধু ঘরে জন্ম নিলেও ছাত্রলীগ করে নাই ভাই, হি ইজ এন অনেস্ট পার্সন, আমার ছেলে দেশের ভালোর জন্যে আন্দোলন করেছে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, দেশ আবার স্বাধীন হইছে ভাই, আমার ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছি না ভাই, আমার ছেলে আন্দোলন করছিলো ভাই,  আমার ছেলেকে হারামজাদারা ধরে নিয়ে গেছে ভাই, জয়বাংলার গুষ্টি মারি, ভাইসব, আমার ছেলেকে ফিরায় দেন, ইনকিলাব জিন্দাবাদ…।” কথাগুলো গুলিস্তান এলাকায় একজন দিগম্বর ভারসাম্যহীন মানুষের কণ্ঠ থেকে শোনা যাচ্ছে। তিনি আমাদের উপন্যাসের নগেন বাবু। ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই তারিখে ঢাকা হাইকোর্ট চত্বর থেকে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালনরত মিছিল থেকে এনার ছেলে পরিমলকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে  ছেলেকে খুঁজেতে খুঁজতে নগেন বাবু পাগল হয়ে গেছেন।

পাগল যে শুধু নগেন বাবুই হয়েছেন এমন না, আগস্ট ৫ এর পরে ২০২৪ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন সময়ে মাত্র ৩৬ দিনে সহস্রাধিক পিতামাতাকে  শোকতপ্ত পাগলের প্রলাপে আহাজারি করতে দেখা গেছে।  ইতোমধ্যে  সরকারবিহীন বাংলাদেশে প্রফেসর ইউনুস সাহেবকে প্রধান উপদেষ্টা করে ২৪ সদস্যের একটি উপদেষ্টামণ্ডলীর সরকার গঠন করা হয়েছে, যার মধ্যে তিনজন বৈষম্যবিরোধী  আন্দোলনের তিনজন প্রধান সমন্বয়ক রয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া হয়েছে। সারা বাংলাদেশে ছাত্রসমাজের কিছু অংশ শেখ মুজিবুর রহমানের স্থাপনা ভেঙে চুরমার করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা দেশাত্মবোধক গান গেয়ে গেয়ে দেয়ালে দেয়ালে শহীদ আবু সাঈদ, মুগ্ধদের রঙিন রঙিন  সব মর্মান্তিক ছবি, বিগত সরকারের ছত্রছায়ায় পুলিশ, মিলিটারিদের ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্রের গ্রাফিতি দিয়ে ছেয়ে ফেলেছে। সারাদেশের ট্রাফিক কন্ট্রোল নিজ কাঁধে নিয়ে অবশেষে ক্লাস পরীক্ষায় ফিরে যাচ্ছে। এরই মধ্যে কে বা কারা  সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে ছাত্রজনতার আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করার প্রানান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এসবের মধ্যেই সীমান্ত পথ দিয়ে বানের পানি হুহু করে ঢুকে দেশে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করেছে। ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কদের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করে যাচ্ছেন। ঢাকাশহরের বিবেকবান মানুষেরা সহযোগিতার হাতে প্রসারিত করে অর্থ ও ত্রাণের  সামগ্রী নিয়ে গাড়িতে করে এসে এসে ছাত্রদের হাতে সেসব দিয়ে যাচ্ছেন। যে দেশের মানুষ এতদিন ত্রাণের সম্পদ আত্মসাৎ করতে দেখে এসেছেন, সেই সেদেশের মানুষ হতবাক হয়ে দেখছেন কীভাবে সৎ নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে ঢাকা শহরের বহু মানুষ দানখয়রাত নিয়ে টিএসসি তে এসেছেলেমেয়েদের হাতে সেসব জমা দিয়ে যাচ্ছেন। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ইউনুস সাহেবের উপদেষ্টামণ্ডলীর সরকার যখন বন্যাসহ নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে যেয়ে হিমশিম খাচ্ছেন সে সময়ে হঠাৎ করে শুরু হলো আনসার বিদ্রোহ। আবারও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কগণ দৃঢতার সাথে সেসব মোকাবেলা করে সবার বাহবা কুড়াতে লাগলেন।

শ্যামলী বান্ধবীদের নিয়ে ক্লাসের দিকে যাচ্ছিলো। আজ রফিক স্যারের সোশ্যাল স্টার্টিফিকেশনের ক্লাস।  রাস্তায় জটলার জন্যে রিকশা তেমন এগুতে পারছে না। এখান থেকে শ্যামলীদের ক্লাস খুব একটা দূরে না। শ্যামলী রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে সেই জটলার দিকে তাকাতেই দেখতে পেল নগেন কাকা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে ছেলের ছবি হাতে করে উঁচিয়ে ধরে প্রলাপ বকছে আর কিছু উৎসাহী ছেলেরা তামাশা দেখছে। শ্যামলী হতবিহব্বল হয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকল, হাতে থেকে ছিটকে পড়লো ক্লাসের বইপত্র। শ্যামলীর সাথে থাকা মেয়েটি কিছুই বুঝতে না পেরে শ্যামলীর গায়ে মৃদু ঝাকুনি দিয়ে বললো, ‘শ্যামলী, এই শ্যামলী কি হলো ? কথা বলছিস না কেন?  শ্যামলী সেই দিগম্বর মানুষটির দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে অস্ফূট গলায় বললো, ‘আমাদের নগেন কাকা’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সব কাজেই প্রবল উৎসাহ। ভাষা আন্দোলন, সরকার পতন আন্দোলন  হোক, অথবা পাগল উদ্ধার কর্মকান্ড হোক সব কাজেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা ভীষণ পারদর্শী। হয়তো সেকারণেই, শ্যামলীর সঙ্গিনী সেই মেয়েটির অনুরোধে কিছু ছাত্ররা উৎসাহী হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল। কেউ গায়ের জামা খুলে নগেন কাকার লজ্জাস্থান ঢেকে দিচ্ছে, কেউ কলা, পাউরুটি নিয়ে এসে নগেন কাকাকে খেতে দিচ্ছে। হঠাৎ একটি ছেলে নগেন কাকার হাতে ধরা ওনার ছেলের ছবি দেখে চিৎকার করে উঠলো। ছেলেটি বললো  গতকালের খবরের কাগজে আয়না ঘর নিয়ে নিউজ করা হয়েছে।  আয়নাঘরে আটককৃত সকল ব্যক্তিদের মুক্তি দেয়া হয়েছে।  যে সমস্ত ব্যাক্তিকে আত্মীয়স্বজনরা এখনো নিতে আসেননি তাদেরকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। পত্রিকার লিষ্টের একজনের ছবির সাথে এই নগেন কাকার ছেলের ছবির প্রচুর মিল রয়েছে। একজন উৎসাহী ছাত্র কোত্থেকে গতকালের খবরের কাগজ নিয়ে এসে ছবির পাশে রেখে চিৎকার করে বললো, ‘পেয়েছি, এই সেই ছেলে’ । খুশিতে আত্মহারা হয়ে শ্যামলী দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করলো। একটি ব্যাবিটেক্সি ডেকে শ্যমলী আর নগেন কাকাকে ব্যাবিটেক্সিতে তুলে দেয়া হলো। ভোঁ ভোঁ শব্দ করে ধুঁয়া ছাড়তে ছাড়তে শ্যামলীদের ব্যাবিটেক্সিটি খবরের  কাগজে দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী সেই হাসপাতালের দিকে রওনা হলো। আরেকটি ব্যাবিট্যাক্সীতে কিছু উৎসাহী ছাত্র ঝটপট উঠে পড়লো।  ব্যাবিট্যাক্সী দুটো ছুঁটে চলছে  খবরের কাগজে দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী সেই হাসপাতালের দিকে। চোখের সামনে এতকিছু ঘটে যাচ্ছে মানসিক ভারসাম্যহীন নগেন কাকা কিছুই তেমন বুঝতে পারছেন না। তিনি ফ্যালফ্যাল করে বাইরের দিকে উদাসভাবে তাকিয়ে  আছেন।

ইতোমধ্যে শ্রাবন মাসের টিপ্ টিপ্ গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। শ্যামলী বসেছে জানালার ধারে। তাঁর পাশেই নগেন কাকা। নগেন কাকা যেন ছুঁটে না চলে যায় সেজন্য আরও দুজন ছাত্র নগেন কাকার আরেক পাশে চাপাচাপি করে বসেছে। ব্যাবিবিট্যাক্সীর ছোট্ট জানালার পর্দা নামিয়ে দেয়া হয়েছে, কিন্তু তবুও  বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে শ্যামলীর চোখেমুখে। বৃষ্টি আসায় শ্যামলীর সুবিধাই হয়েছে।  বৃষ্টির ছাট আর শ্যামলীর কান্না মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। নগেন কাকা বাইরের বৃষ্টির দিকে উদাসভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শিশুদের মতো ছড়া কাটছেন, ‘আয় বৃষ্টি ঝেপে, ধান দিব মেপে……… ।’

পাঠক, আমরা যে আয়না ঘরের কথা বলছি আগস্ট মাসের ৫ তারিখের আগপর্যন্ত এই ঘরের অস্তিত্বের কথা সাধারণ বাংলাদেশী জনগণ কেউই জানতেন না।  স্বৈরসরকার পতনের পরপরই   বিগত সরকারের গোপন তথ্যসমূহ  হুরমুর করে প্রকাশিত হতে থাকে। এসব প্রকাশিত তথ্যের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্যকর একটি তথ্য, ‘আয়না ঘর’। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাউন্টার-টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) দ্বারা পরিচালিত একটি গোপন আটক কেন্দ্রের নাম আয়নাঘর। ধারণা করা হয়, এখানে কমপক্ষে ১৬টি কক্ষ রয়েছে, যেখানে একসঙ্গে ৩০ বন্দি রাখার সক্ষমতা রয়েছে। আয়নাঘরটি বাংলাদেশের ঢাকা সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত বলে ধারণা করা হয়।

আজবদেশ বাংলাদেশে আবহাওয়া এবং জলবায়ুতে যেমন বৈচিত্রতা আছে তেমনি এই দেশের মানুষের চরিত্রের মধ্যেও বেশ বৈচিত্রতা পাওয়া যায়। এদেশের কিছু মানুষ কোন এক বিচিত্র কারণে  পাগলদের নিয়ে হাসিতামাশা করে, ঠাট্টা বিদ্রুপ করে। ছোটছোট ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে পাগলদের ধাওয়া করে ঢিল ছুড়তে থাকে। আবার, এসবের মধ্যেও কিছু বিবেকবান মানুষের  মনুষ্যত্ববোধ আমাদেরকে আপ্লুত করে। এই যেমন আজ কিছু ছেলেপেলে নগেন কাকাকে মানসম্মানের সাথে ব্যাবিটেক্সিতে তুলে দিয়ে ছুটছে নগেন কাকার ছেলের সন্ধানে। মানব চরিত্রে পজিটিভ ও নেগেটিভ দুটি সত্তা সর্বদা বিরাজ করে চরিত্রে ভারসাম্য বজায় রাখে। উপযুক্ত পরিবেশে বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে একটি সত্তা প্রকট ও আরেকটি প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে। সেই পরিবেশ তৈরী করার দায়িত্ব সমাজের সকল সচেতণ মানুষের। অতি সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ছাত্রদের  মহতী উদ্যোগগুলো  তাঁদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে আরও উজ্জ্বলতর করলেও  কিছু ছাত্রের কুৎসিত কর্মকান্ড সমগ্র ছাত্র সম্প্রদায়ের উজ্জুল ইতিহাসকে কদর্য করছে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন সময়ে  বিদেশী ভাষার বিভিন্ন নিত্য  নতুন ভোকাবুলারির সাথে বাংলাদশীরা পরিচিত হয়েছিলেন , যেমনঃ বাংলা ব্লকেড, কমপ্লিট শাট  ডাউন, মার্চ ফর জাস্টিস ইত্যাদি। এই ধারা আগস্ট ৫ এর পরেও অব্যাহত থাকল। এবার নতুন করে বাংলাদেশিদের নতুন আরেকটি বিদেশী শব্দের সাথে পরিচয় ঘটল, ‘মব জাস্টিস’ যার মানে উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার। এই জনতার বিচারে স্কুলের প্রধান শিক্ষক, বিগত সরকারের সমর্থক নেতা-কর্মীসহ অনেকেই সাজা পেলেন। ডেথ পেনাল্টিতে সাজা পেলেন মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জল। এভাবেই কিছু বিপথগামী তরুণেরা যেন শকুনের মতো খামচে  ধরে ২০২৪ এর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাফল্যকে ম্লান করার জন্য একের পর এক মরিয়া হয়ে উঠে পড়ে লেগেছে।

সেপ্টেম্বর মাসের ২০ তারিখের তোফাজ্জলের সেই মর্মান্তিক  খবরে আঁতকে উঠলো সারা দেশের জনগণ। আমি দেশের বাইরে থেকে নিয়মিত অনলাইন ভিত্তিক সব খবরের কাগজ পড়ে থাকি। এরম একটি অনলাইনের খবরের কাগজের হেডিং আর সবার মতো আমিও দেখে চমকে উঠলাম। খবরটির শিরোনাম করা হয়েছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে এ কেমন ‘নির্মমতা’: শিউরে উঠছে মানুষ’ । আমি এক নিঃশ্বাসে দ্রুত খবরটি পড়ে ফেললাম। খবরটিতে শুরুতেই লিখেছে একই দিনে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দল বেঁধে  নির্মমভাবে হত্যা করেছে এবং সেসব হত্যার  ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয়েছে। খবরের প্রথম অংশে লেখা হয়েছে, সেদিন কিছু ছাত্রের মোবাইল ফোন চুরি হয়েছিল।  সন্ধ্যার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের গেটে তোফাজ্জল হোসেন নামের এক মানসিক ভারসাম্যহীন যুবককে কথাবার্তার অসঙ্গতি দেখে চোর সন্দেহে  গেস্ট রুমে নিয়ে যেয়ে  চলে এলোপাতাড়ি চড়-থাপ্পড় ও কিলঘুষি চালায়। এমন কি এক পর্যায়ে সেসব শিক্ষার্থীরা তাকে হলের ক্যান্টিনে নিয়ে খাবার খাওয়ায়। পরে  জানালার সঙ্গে হাত বেঁধে স্ট্যাম্প, হকিস্টিক ও লাঠি দিয়ে বেধরক মারধর করা হয়। পাগল জেনেই ঠান্ডা মাথায় মেরে ফেলা হলো তোফাজ্জল হোসেনকে। খবরের দ্বিতীয় অংশে লেখা হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ ওরফে মোল্লা শামীমকে ফটক থেকে ধরে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও নিশৃংস হত্যাকাণ্ডের ভিডিও মাসমিডিয়াতে ভাইরাল হয়েছে।(বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম 20 Sep 2024, 02:01 AM)

এসব ঘটনা বিগত পনেরো বছরে হরহামেশা দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ। হিন্দু ধর্মাবলম্বী দর্জি বিশ্বজিতের লোমহর্ষক কুপিয়ে মারার দৃশ্য বাংলাদেশিদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়নি। কিন্তু যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা সমাজের বৈষম্য দূর করার জন্যে আন্দোলন করে স্বৈরাচারী সরকারকে হঁটিয়েছে সেই জি জেনদের সরকার, নোবেলজয়ী ইউনুস সাহেবের উপদেষ্টামণ্ডলীর সরকারের অধীনে মব জাস্টিসের শিকার মানুষদের ভয়াবহ পরিণতিতে   আপামরজনতা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে স্তম্ভিত হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট টিমের অস্থিতিশীল পারফর্ম্যান্সের  মতোই বাংলাদেশে ছাত্রদের ভাবমূর্তি নতুন  বাংলাদেশে  ওঠানামা করার খেলায় যেন পেয়ে বসেছে।

মাত্র কিছুদিন আগে জনগণের বাহবা কুড়ানো সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে এই তোফাজ্জলকে নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলার সাথে গুলিয়ে ফেললেন অনেকেই। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বুয়েটের সেই মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যার কথা মনে করে মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলের হত্যার সাথে জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখক বিপথগামী উচ্ছৃঙ্খল এই ছাত্রদের ধিক্কার জানাতে থাকলেন বাংলাদেশের জনগণ । সেই সাথে যারা উনুস সরকারের অসাফল্যকে বড়ো করে দেখতে চান সেই গোষ্ঠীদের আনন্দিত হতে দেখা যাচ্ছে। হয় রে বাংলাদেশ !! কোন এক পক্ষ যেন দেশে ও বাইরে মরিয়া হয়ে উঠেছে কীভাবে ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পাহাড়সমান অর্জনকে খাটো করা যায়। আমি প্রবাসে বসে এই শ্রেণীর অনেক মানুষের সাহচর্যে এসেছি। এঁরা পান থেকে চুন খসলেই ফেসবুকে বিবৃতি দিয়ে থাকেন, ‘সবে তো শুরু, উচ্ছৃঙ্খল ছেলেপেলেদের দিয়ে দেশ চালালে তো এরকমই হবে।’ আমি ফেসবুকে এঁদের পোষ্টে কোন কমেন্ট লিখি না। শুধু এঁদের বিষয়ে সজাগ থাকি, সতর্ক থাকি। এরা ফ্যাসিস্টবাদী সরকারপন্থী।

এই ফ্যাসিস্টবাদী সমর্থকগোষ্ঠীদের আরও একটি মারণাস্ত্র হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পুরো কৃতিত্বকে জামাত-শিবিরের আন্দোলন হিসেবে অবিহিত করে আন্দোলনের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করার চেষ্টা করা। এরই অংশ হিসেবে লাল-সবুজের জাতীয়পতাকা জামাতিপন্থী শাসক গোষ্ঠীরা পরিবর্তন করে ফেলছে অথবা হিন্দু কবি রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয়সংগীত উঠে দেয়া হচ্ছে এসব ধুঁয়া তুলে একের পর এক ইস্যু বানিয়ে ইউনুস সরকারকে বিব্রত করার চেষ্টা করছে। এরকম পরিস্থিতে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীরা যখন ছাত্রদের রাজনীতি থেকে বিরত রাখার কথা ভাবছে সেরকম সময়ে দেশের আরেকটি খবরে চমকে উঠলাম। ছোটছোট দাড়িমুখে এক যুবকের ছবি ছাপিয়ে খবরের শিরোনাম করা হয়েছে, ‘ঢাবিতে হঠাৎ প্রকাশ্যে ছাত্রশিবির, যা বলছেন সমন্বয়ক সোহেল’। আমি দ্রুত খবরটি পড়ে যা জানতে পেলাম সেটি হচ্ছে সোহেল নামের এই যুবক ছিলেন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের একজন অন্যতম সমন্বয়ক। তিনি প্রকাশ্যে এসে ঘোষণা দিলেন তিনি জামাতে ইসলামের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশবিদ্যালয় শাখার সভাপতি। (যুগান্তর ডেস্ক, প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:১৭ পিএম)

আমার এই উপন্যাসে বিভিন্ন অধ্যায়ে আমি পরিষ্কার করে বলার চেষ্টা করেছি ইসলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ  বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানপন্থী জামাতে ইসলাম পার্টি আমাদের মুক্তি যোদ্ধাদের ভারতের দালাল অবিহিত করে বিচ্ছিন্নতাবাদী সাজিয়ে পাকসেনাদের হাতে তুলে দিয়েছিলো। শুধু তাই না, দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে পাকসেনাদের হাতে আমাদের মা-বোনদের তুলে দিয়েছিলো। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে জামাতে ইসলাম পার্টি কিন্তু সমগ্র বাংলাদেশের ইসলামী ভাবাপণ্য ভাবধারাকে প্রতিনিধিত্ব করে না। আমাদের দেশে অনেক মুসলিম  ভাবাদর্শের মানুষজন জামাতে ইসলামের কর্মকান্ডকে  যেমন পছন্দ করেন না তেমনি যারা একটিমাত্র ব্যাক্তি এবং একটিমাত্র পার্টি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ এনে দিয়েছে বলে বছরের পর বছর একটি ন্যারেটিভ তৈরী করে আসছে, বছরের পর বছর ভারত তোষামুদে নীতির পক্ষে সাফাই গেছে  তাদেরও জেন জি ছেলেমেয়েরা পছন্দ করেন না। এঁদের কাছে খনি মনে হয় না মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারটি অনেক বিরাট এক অর্জন হলেও সেই অর্জনের কৃতিত্ব কেবল একটি ব্যাক্তি ও তাঁর দোল নয়, তাঁর কৃতিত্ব সমগ্র বাংলাদেশের সাহস জনগণ!!

২০২৪ সালের আপমর ছাত্রজনতার উপহার দেয়া ‘নতুন বাংলাদেশ’ হয়ে উঠুক সাম্প্রদায়িক মুক্ত ভারত বা পাকিস্তানি দালালমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, নব্যসন্ত্রাস ও ডাকাতি মুক্ত বৈষম্যহীন এক সম্পূর্ণ নতুন এক দেশ, ‘বাংলাদেশ’!!!

চলবে ….

পর্ব ১-পর্ব ১
পর্ব ২-পর্ব ২
পর্ব ৩-পর্ব ৩
পর্ব ৪-পর্ব ৪
পর্ব ৫-পর্ব ৫
পর্ব ৬-পর্ব ৬
পর্ব ৭-পর্ব ৭
পর্ব ৮-পর্ব ৮ 
পর্ব ৯-পর্ব ৯

পর্ব ১০-পর্ব ১০
পর্ব ১১-পর্ব ১১ 

পর্ব ১২-পর্ব ১২

পর্ব ১৩-পর্ব ১৩

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্বের গণতন্ত্রের হালচাল
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন