শাহাব আহমেদ, ফ্লোরিডা থেকে:-
তুমি প্রকৃতই ছিলে না, আমি তোমাকে সৃষ্টি করেছি। জিউস যেমন মেঘ থেকে নেফেলিকে সৃষ্টি করেছিলেন, আমি তেমনি কল্পনার রং তুলি দিয়ে এঁকেছি তোমাকে। তার পরে তোমার ঠোঁটে চুম্বন দিয়ে জাগিয়ে তুলেছি।
যেমন জেগে উঠেছিল গালাতেয়া কোন এক শিল্পীর ভালোবাসা থেকে।
সে কাহিনী জানা নেই তোমার?
পিগম্যালিয়ন ছিল সুদূর সাইপ্রাসের একজন কল্পনাপ্রবণ ভাস্কর। যারা কল্পনায় হৃদ্ধ তারা বাস্তবতায় বামন।ব্যথা পায় বেশী, কষ্ট পায় অতি সামান্যে। ভালোবাসার কষ্ট তাদের কাছে জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট।
পিগম্যালিয়ন কস্ট পেয়েছিল, ভীষন কস্ট। আশেপাশের নারী-প্রজাতির প্রতি এতবেশী বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল যে, প্রতিজ্ঞা করেছিল জীবনে আর ভালোবাসবে না।
সে নিজেকে জীবনের কোলাহল থেকে সরিয়ে নিয়েছিল নির্জনে। নিমগ্ন হয়েছিল সৃষ্টিতে। এবং মর্মর পাথর দিয়ে সৃষ্টি করেছল এক মূর্তি, নারী মূর্তি। বাস্তবে সে যে ত্রুটিগুলো দেখেছে নারীর মধ্যে, তার মনপ্রাণ ঢেলে সৃষ্টিকে করেছে সেই সব ত্রুটি থেকে মুক্ত, নিখুঁত, নিটুট ও বিশুদ্ধ। তার কল্পনার এই নারী সৌন্দর্যে অতিক্রম করে গিয়েছিল পার্থিব যে কোন নারীকে।
এবং সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।
অসুখ -যাকে মায়াকোভস্কী বলেছিলেন “পঝার ছেরদ্ছা” বা “হৃদয়ের অগ্নোৎসব”, তা-ই। সে প্রেমে পড়েছিল তারই সৃষ্টির। এখানেই সে হয় ঈশ্বরের থেকে ব্যতিক্রম ।
সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে গালাতেয়ার দিকে। তার সাথে কথা বলে, আদরে চুম্বনে ভরিয়ে দেয় কঠিন ও শীতল প্রতিমা দেহ। ফুল এনে রাখে পায়ের বেদীতে, সমুদ্র-তীর থেকে খুঁজে আনে সুন্দর ঝিনুক, খাঁচায় গানের পাখী এনে পাশে রাখে।
সেই পাখী গান গায়। প্রেমিকের হৃদয় আর খাঁচার পাখী একাত্ম চিরকাল।
সে গালাতেয়ার দেহ ঢেকে দেয় সুন্দর আভরণে, গলায় পরায় বৈভবের মণিহার, আঙুলে আংটি আর কানে দুল। এভাবেই যায় তার দিন, যায় তার রাত।
রক্ত-মাংসের নারীর থেকে মুখ ফিরিয়ে সে মাথা খুইয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে প্রতিমার পায়ের কাছে, অথচ প্রতিমার প্রত্যুত্তর দেবার ক্ষমতা নেই। সে কথা কয় না। নৈশব্দের মার্বেল স্থির চোখ।
শ্বাস নি:শ্বাসে দোল খায় না বুক। অথবা দুই হাত তুলে খোঁপা বাঁধতে গিয়ে বাতাস কেঁপে ওঠে না তার স্তনের আন্দোলনে।
অথচ প্রেম চায় উত্তর।
চিরকাল চেয়েছে।
চেয়েছে চাহনির উত্তরে চাহনি, চিঠির উত্তরে চিঠি। আলিঙ্গনের উত্তরে চেয়েছে আলিঙ্গন আর চুম্বন-রতি- নমিত নীল-পদ্ম সরোবর।
পাতা ঝির ঝির করে বাতাসে। বৃষ্টি ঝরে হৃদয়ের রক্তক্ষরণের মত। ঢেউ কেঁদে কেঁদে আছড়ে পড়ে তীরে। শুভ্র কেশর কাশ দোলে উন্মন।
মেঘ ছুটে যায় উদভ্রান্তের মত আকাশের এক আঙ্গিনা থেকে অন্য আঙ্গিনায়।
শিল্পী ডুবে থাকে শিল্পের মুগ্ধ বলয়ে।
দিনের দ্রাঘিমায় দিন হাঁটে, রাতের যোনিতে মুখ থুবড়ে থাকে রাত। বিরহ বিষন্নতার আদ্যান্ত জড়াজড়ি করে থাকে পাইথন কুন্ডলির মত।
অবশেষ একদিন সে আর পারে না। যায় আফ্রোদিতির মন্দিরে পুজার নৈবেদ্য নিয়ে। চিরভাস্বর প্রেমের দেবী বুঝতে পারে তার হৃদয়ের আকুলতা।
দেবী বলে, “যা রে মধু, ঘরে ফিরে যা, পাবি তুই অবিনশ্বরের চুম্বন।”
সে বুঝতে পারে না দেবীর কথা।
দীর্ঘ পথ হাঁটে নিজস্ব চিন্তার আলো আঁধারি করিডোরে ধীর পা ফেলে।
ঘরে ফিরে সে সচরাচরের মত ছুটে যায় প্রিয়তমার কাছে। আলিঙ্গন করে সংসক্তির তৃষ্ণা নিয়ে, কিন্তু মনে হয় উষ্ণ ও নরম তার দেহ, মর্মরের কাঠিন্য আর নেই।
মনে হয় ঠোঁটের রং জীবন্ত নারীর ঠোঁটের মত।
সে তাকে চুম্বন করতে যায় !
তার চেয়েও বেশী প্যাশন নিয়ে গ্রহণ করে গালাতিয়ার ঠোঁট।
নরম ও উত্তপ্ত।
উদগ্র কামনার প্যানডোরা দাহ।
গায়ে তার জীবন্ত নারীর ঘ্রাণ, চোখে মহাবিশ্বের উল্টা জগত থেকে আসা দ্যুতির রশ্মি।
পিগম্যালিয়ন বিস্ময়ে পিছিয়ে যায়।
মনে হয় তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। হ্যালুসিনেশনের কেটলিতে গলে পচে গেছে মগজ।
সে আবার এগিয়ে আসে।
আলিঙ্গনে বাঁধা পড়ে নারী, স্বপ্নের নারী, গালাতেয়া। নিখুঁত, নিটুট ও বিশুদ্ধ।
তারই কল্পনা দিয়ে সৃষ্ট।
আমি তোমাকে সৃষ্টি করেছিলাম।
আমি শিল্পী নই স্বপ্নচারী। অনুভূতি পাগল।
ভুল রং, ভুল ক্যানভাস, ভুল তুলি আমার।
তুমি তাই তুমি- গালাতেয়া নও, বস্তু-মানবী।
আমি নই পিগম্যালিয়ন, অবিনশ্বরতার চুম্বন আমার ঠোঁট স্পর্শ করে নি।
(ছবি:-সৈজন্যে Pygmalion & Galatea | Gallery )
সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৮