আজ একটু বেশি ভোরেই ঘুম ভেঙ্গেছে জহুরা বেগমের। তিনি খাট থেকে নেমেই হাতড়ে লাইটটা জ্বালান। তাঁর চোখ পড়ে দেয়ালে ঝুলানো ক্যালেন্ডারটার উপড় । তিনি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষন সেটার দিকে। তিনি আস্তে আস্তে পা বাড়ান বাথরুমের দিকে। ওজু করে এসে নামাজ পড়ে কোরআন নিয়ে বসেন জায়নামাজে । তার চোখ পড়ে পাশের খাটে ঘুমানো শমীর দিকে। কি মিষ্টি দেখতে হয়েছে মেয়েটা। মুখটা দেখলেই বুকটা জুড়িয়ে যায় তাঁর । তার একমাত্র নাতনী ।শমী এবার ক্লাশ টেনে উঠেছে । স্কুলের বাইরে তার একমাত্র বন্ধু দাদু। দাদুকে তার সবকথা বলতে হয়। তার যেকোন সমস্যা , সুখ আনন্দ সে দাদুকে না বলা পর্যন্ত স্বস্তি পায় না। শমীর মা খুব খুশি এই দুই অসম বয়সী বন্ধুর বন্ধুত্ব দেখে। জহুরা বেগম ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে মনোযোগ দেন কোরআন পাঠে। তাঁর সুরেলা কণ্ঠের কোরআন পাঠে চোখ মেলে শমী । দাদুকে কিছু না বলে ধীর পায়ে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। কিছুক্ষন পর নামাজ পড়ে পাশে এসে বসে দাদুর। ততক্ষন জহুরা বেগমের কোরআন পাঠ শেষ হয়েছে। শমী জড়িয়ে ধরে তাকে ।“ দাদু আজ হাটতে যাবে না? দেরী হয়ে যাচ্ছে তো। রোদ উঠে গেলে আর হাটতে যেতে ভাল লাগেনা।“ জহুরা বেগম বলেন “ এই তো বের হচ্ছি। তুই রেডি হয়েছিস?দাঁড়া একটা শাল জড়িয়ে নেই গায়ে। বাইরে গেলে ঠাণ্ডা লাগে।“ সে শাল জড়াতে জড়াতে চটি স্যান্ডেলটাও পড়ে নেন। শমী এসে দাদুর হাত ধরে। সকালের শান্ত সমীরণ হাল্কা পরশ বুলিয়ে দেয় তাদের। চারদিকের সুনসান নিরবতায় যেন ছড়িয়ে পড়ে স্নিগ্ধ আবেশ। জোহুরা বেগম নাতনীর হাত ধরে হাটতে হাটতে একটা বকুল তলায় এসে দাঁড়ান । বকুল গাছটার নীচে ফুল পড়ে বিছিয়ে আছে। মন মাতাল করা ঘ্রাণ সেখানে। তিনি আস্তে আস্তে নাতনীকে বলেন “ শমী একটা বড় মালা বানিয়ে দিবি আমায়?” শমী হাসতে হাসতে বলে “ মালা দিয়ে তুমি কি করবে দাদু? দাদাভাই তো নাই। “ জহুরা বেগম লজ্জা পেয়ে যান নাতনীর কথায়। তারপর বলেন “ মানুষটা খুব পছন্দ করতো বকুল ফুল। বিয়ের রাতে সে তার পাঞ্জাবীর পকেটে করে এনেছিল বকুল ফুলের মালা। সেই মালাটা আমার খোপায় পড়িয়ে দিয়েছিল খুব যতন করে। সেই মালাটার ঘ্রান আমি এখনো পাই।“ বলতে বলতে তার চোখ পানিতে ভরে উঠে। শমী দাদুকে জড়িয়ে ধরে বলে “দাদু আমি জানি দাদাভাই তোমাকে কতটা ভালবাসতেন । তুমি মন খারাপ করো না দাদু । আমি এখনি অনেক বড় একটা মালা বানাচ্ছি তোমাদের জন্য। জহুরা বেগম নিজের শাড়ীর পাড় থেকে সুতো বের করে নাতনীর হাতে দেন।
বছর পাঁচেক হলো জহুরা বেগমের স্বামী ফয়েজ সাহেব ইন্তেকাল করেছেন। তিনি সরকারী চাকুরী করতেন। তাঁর ছিল বদলীর চাকুরী। সেই সুবাদে স্বামীর সাথে সাথে ছেলেকে নিয়ে তাকেও ঘুরতে হয়েছে শহর থেকে শহরে। সন্তান আর সংসার সামলানো ছিল তাঁর কাজ। একবার ছেলের পরীক্ষার জন্য স্বামীর সাথে তার নতুন কাজের জায়গায় যাওয়া হয়নি । তখন তো আর ফোন ছিল না। প্রতি সপ্তাহে তিনি চিঠি লিখতেন স্ত্রীকে। সেই চিঠিগুলো যে কি আবেগ দিয়ে লিখতেন তিনি, পড়তে গিয়ে জহুরা বেগমের চোখে পানি চলে আসতো। বাজার করার সময়ও ফয়েজ সাহেব বেছে বেছে যে জিনিষগুলো সে পছন্দ করে সেগুলো কিনে আনতেন । একবার রান্না করতে গিয়ে তাঁর হাত পুড়ে গিয়েছিল । সেটা দেখতে পেয়ে তিনি কি যে কষ্ট পেয়েছিলেন! সেই রান্না করা খাবার খেতে পারলেন না । — সেই মানুষটা বলা নেই কয়া নেই তাকে ছেড়ে একরাতে ঘুমের মধ্যে এভাবে চলে যেতে পারে! জহুরা বেগম আর চিন্তা করতে পারেন না। তার দু’চোখ বেয়ে নামে শ্রাবণ ধারা।
শমী বড় একটা মালা গেথে দাদুর হাতে দিয়ে বলে “ চল দাদী বাসায় যাই। মা নাস্তা রেডি করে অপেক্ষা করছেন। আমাকে স্কুলে যেতে হবে। “
শমীর স্কুলে ব্যস্ততার মধ্যেও দাদুর মুখটা বার বার মনে পড়ছিল। স্কুল থেকে ফেরার পথে সে দাদুর জন্য একগুচ্ছ গোলাপ ফুল নিয়ে এসেছে। যত্ন করে দাদুর খাটের পাশের টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে। সামনে পরীক্ষা বলে দাদুকে সময় দিতে পারছে না শমী । পড়ার টেবিলেই থাকতে হচ্ছে বেশি। রাতে সবার শেষে খাবার খেয়ে শমী যখন শোবার ঘরে ঢুকেছে ততক্ষণ জহুরা বেগম ঘুমিয়ে পড়েছেন । সারা ঘরে ছড়িয়ে যাচ্ছে গোলাপ আর বকুলের মৌ মৌ ঘ্রাণ । তিনি ঘুমের ঘোরে হাসছেন। দাদুকে অপূর্ব লাগছে দেখতে শমীর। হয়ত অতীতের কোন সুখ স্বপ্ন দেখছেন তিনি। আজ যে তাঁর বিয়ে বার্ষিকী।