প্রিয় পাঠক ঈদ আসছে। ঈদ আসলেই মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। মা–বাবাকে খুব বেশী মনে পড়ে। ওনাদের বয়স হয়েছে ; আমরা তিন ভাই বোন সবাই ওনাদের কাছ থেকে অনেক দূরে থাকি। আমার বড়ো ভাই গত দুই বছর আগে হঠাৎ স্ট্রোক করে খুব অল্প বয়সে মারা গেছেন। ওঁর ১১ বছরের ছেলে আর ভাবীকে নিয়ে ওনারা বাংলাদেশে থাকেন। ঈদ আসলে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। এতো কষ্ট করে বাবা–মা আমাদেরকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছেন , আর আমরা তাঁদেরকে ফেলে এই দূর দেশে চলে এসেছি– আর কয়দিনই বা বাঁচবেন ওনারা?
রোজার দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই শপিং শুরু করেছিলাম । শুরু করেছিলাম আমাদের যাঁরা দৈনন্দীন কাজে সাহায্য করেন তাঁদের জন্য কেনাকাটা দিয়ে । আমার আট মাসের ছেলে কাঙ্খিতকে আমি ইউনিভার্সিটিতে গেলে যাঁরা দেখাশুনা করেন মাইমুনা খালা, রোকেয়া খালা, স্বপ্না ,আর আনিস এর জন্য কেনাকাটা দিয়ে শুরু করলাম এবার ঈদের কেনাকাটা । আমাদের মেয়ে শ্রেয়ার আরবি টিচার জোহরা আপা, গানের টিচার মলয় দাদা আর নাচের টিচার রিংকু রোজারিও দিদির জন্য, আমাদের নিজেদের জন্যে, আমার মা–বাবা , ভাই–বোন, দেবর–ননদ, বন্ধু–বান্ধব আত্মীয়স্বজন, আমাদের কর্মস্থলের সহকর্মীদের সবার জন্যই কেনাকাটা করেছি, কেউই বাদ যায়নি। জাকাত-ফেতরা দেওয়ার জন্য শশুরবাড়িতে এবং আমার দাদাবাড়িতে যারা গরীব আত্মীয়-স্বজন আছেন তাদের সবার জন্যই আমি আর মুকুল রোজার শুরুতেই বসে বসে লিস্ট করেছি। ঈদের উপহার কাকে কত টাকা দেব তাও লিখে রেখেছি। কারণ বেতন এবং বোনাস দুটোইতো সীমিত। এর মধ্যে থেকেই তো বাজেট করে খরচ করতে হবে। রোজার প্রতিটা দিনই ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিয়েই চলে যেতে হতো কেনাকাটা করতে। কোনো গাড়ী ছিল না আমাদের, ইউনিভার্সিটির গাড়ীতে ক্লাস নিতে যেতাম আর আসতাম। তাই ঈদের কেনাকাটায় রিকশাই ভরসা ছিল। বাসায় এসে দেখতাম, স্বপ্না কাঙ্ক্ষিতকে নিয়ে বাইরে ঘুরছে, আনিস শ্রেয়াকে স্কুল থেকে নিয়ে এসেছে, মাইমুনাখালা ওদের দুইজনেরই খাওয়া গোছল সব করিয়েও কত রকমের ইফতার বানিয়ে রেখেছে! রোকেয়া খালা পুরা বিল্ডিঙের সিঁড়ি, গ্যারেজ ,সমস্ত ঘর-বাড়ি ঝাড়ু দিয়ে মুছে দিয়ে গেছে। সারা রোজার মাস এভাবেই গেছে। ভোররাতে সেহেরী খাওয়ার জন্য মাইকএ ডাকাডাকি, পাড়ার ছেলেরা থালাবাটি বাজিয়ে রোজাদারদের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করতো।চাঁদরাতে ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ গানটি বাজতে থাকে টিভিতে, মাইকএ সবখানে, শ্রেয়া হাতে মেহেদী পরে, বাজি ফোটায় পাড়ার ছেলেরা, টেলিফোনে শুধু দাওয়াতদেয়া–দিয়ি চলতে থাকে। চারিদিকে শুধু খুশি আর আনন্দ, সবাই খুশি ঈদ আসাতে।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো – আরে আমি তো স্বপ্ন দেখছিলাম! বাংলাদেশে আমার ফেলে আসা ঈদের দিন নিয়ে আমি এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিলাম।বিছানায় শুয়েই আমি কাঁদি – মুকুল ঘুমিয়ে আছে পাশে– টের পেয়ে যেতে পারে তাই অন্য রুমে চলে যাই।কান্না থামিয়ে বাস্তবতায় ফিরে আসি।
গত রোজার ঈদের কথা বলি। স্কুল, কলেজ, অফিস–আদালত সবই খোলা ছিল, ছেলেকে বলেছিলাম – আজ ঈদ, তোমার স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই, আমরা ঈদের মাঠে নামাজ পড়তে যাবো।শ্রেয়া, আমাদের মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে ওর ক্লাস থাকাতে ওকে ক্লাসে যেতে হয়েছিল । ।খুব সকালে উঠেই সব রান্না-বান্না সেরে ফেলেছিলাম । ছেলেকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে গোসল করে পাঞ্জাবি-পায়জামা পরতে বললাম।পাঞ্জাবি পরতে চায়না– বলে ইচি আর আনইউসুআল ড্রেস। আমরাও দুইজনে কাপড়-চোপড় পরে ঈদের মাঠে অর্থাৎ ডানফোর্থের বাংলা পাড়ায় মাঠে নামাজ পড়লাম। আমরা যেখানে থাকি সেখানেই মসজিদে ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানী, আফগানী, আরব মুসলিমরা ঈদের নামাজ পড়ে । কিন্তু ওতে আমাদের মন ভরে না- ডানফোর্থের মাঠে নামাজ পড়ি বাংলাদেশের অনেকের সাথেই দেখা হয়, কথা হয় সেই আনন্দে। নামাজের সময় আমার পাশে একজন মহিলা খুব কান্নাকাটি করছিলো। বললেন ছয় মাস হলো বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, আসার পরপরই বাবা মারা গেছেন, দেখতে যেতে পারেন নি, আর এখন মা হসপিটালে, কিডনি ডায়ালিসিস চলছে- যেকোনো সময় মারা যেতে পারেন- কিডনি দুটোই সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেছে। প্রথমে সাস্কাচেওন গিয়েছিলেন, এক সপ্তাহ হলো টরন্টো এসেছেন, ওখানে তেমন কোনো কাজ পাননি তাই। দুইহাত তুলে মোনাজাতের সময় উনি যেভাবে কান্নাকাটি করছিলেন তাতে চোখের পানি কিছুতেই ধরে রাখতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিলো আমার অসুস্থ মা-বাবার কথা।
ঈদে যেসব বাচ্চারা আমাদের বাসায় এসেছিলো তাদেরকে বাংলাদেশের স্টাইলে টাকা দিলাম ঈদ সালামী কি তা বোঝানোর জন্য। আমরাও কারো কারো বাসায় গেলাম। এভাবেই কেটে গেলো আমাদের প্রবাসীদের ঈদ। যাঁরা এখানে চাকরি করেন তাদের অধিকাংশই ঈদের নামাজ পড়তে যেতে পারেন না , কারণ ঈদের দিন কোনো ছুটিই তো থাকে না। তাই ঈদ করেন কোনো এক শনিবার বা রবিবার দেখে। মা-বাবা, ভাই-বোন , শশুর বাড়ি বাবার বাড়ির আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাংলাদেশে আমরা যেরকম ঈদ করি তেমনটি তো আর আমরা এখানে করতে পারি না তাই আমরা দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাই, আমরা ঈদ উদযাপন করি আমাদের মতো করে। ঈদের দিন আমরা মা-বাবার সাথে দেখা করতাম, আম্মা তাঁর বাচ্চাদের পছন্দের খাবার গুলোই রান্না করতেন, এখন নাকি তা আর করেন না। আমরা আমাদের শশুর শাশুড়ি আর মৃত আত্মীয়স্বজনদের কবর জেয়ারত করতাম, এখন তো আর তা পারি না, তাই এখানে বসেই ওনাদের জন্য দোআ করি। সবাইকে সাধ্যমতো উপহার আর ভালো খাবার খাইয়ে, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়িয়ে , জাকাত-ফেতরা দিয়ে যেভাবে আমরা দেশে ঈদ করতাম তা এখন শুধু স্বপ্নেই দেখি। এখন ঈদে বাংলাদেশে ডলার পাঠাই , আত্মীয় স্বজনরা কি কেনে না কেনে জানি না। আমরাতো আর নিজের হাতে ওদের পছন্দের কিছু কিনে দিতে পারি না। আমরা বাংলাদেশ ছেড়ে প্রবাসী হয়েছি বিভিন্ন কারণে, কিন্তু আমাদের মন তো পড়ে থাকে বাংলাদেশে। দেশের মানুষ আমাদের দোষ দেয় আমরা অকৃতজ্ঞ একথা বলে। তাঁরা তো আর জানে না আমাদের এই চাপা কষ্টের কথা! আবার এইখানেই অনেক বাংলাদেশের মানুষ আছেন যাদেরকে দেখে নিজেকে খুব বোকা আর আনস্মার্ট মনে হয়। কালকের একটা ঘটনা বলি- এক ভাই-ভাবির বাসায় গিয়েছিলাম। ভাবি কাজে গেছেন , ভাই এক টেবিল খাবার নিয়ে খেতে বসেছেন- আমাদেরকেও খুব অনুরোধ করছিলেন খাওয়ার জন্য। ভাই-ভাবি আসেন খাই- আমি নিজেই কয়েকরকম মাছ-মাংস রান্না করেছি একদম দেশি কায়দায়, খুবই মজা হয়েছে। আসেন গরম গরম খাই। শেষে বাধ্য হয়ে বলতেই হলো যে আমরা রোজা আছি। উনি বললেন ওনাদের ফ্যামিলিতে কেউই রোজা রাখেন না- এমনকি ওনাদের বাসায় কোনো জায়নামাজও নেই। টেবিলের উপরের বেশ অনেক গুলো বিভিন্ন ধরণের মদের বোতল সরাতে সরাতে বললেন- আমার ছোট মেয়ে গতকাল আঠারোতে পা দিয়েছে- এখন সে লিগালি এলকোহল খেতে এলাউড, তাই সবাই মিলে একটু সেলিব্রেট করেছিলাম কাল। ওনার ছেলে আসতে পারেনি কারণ সে তার আইরিশ গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে গতকালই নতুন কেনা এপার্টমেন্টে মুভ করেছে। ভাইদের রোজা বা ঈদ করার সময় সুযোগ হয় না। কারণ ওনাদের সবারই কাজ থাকে। তবে ক্রিস্টমাসে যেহেতু ছুটি থাকে , ঐসময় ওনারা কোনো না কোনো ভাবে সেলিব্রেট করেন। ওনারা ঠিকই করেন- যস্মিন দেশে যদাচার না করতে পারাটা ভীষণ আনস্মার্ট। তবে আমার মনে হয় না আমি আর এজীবনে ওরকম স্মার্ট হতে পারবো। আর আমার মনে হয় আমার আশেপাশের অধিকাংশ মানুষই আমার মতো সাধারণ, তাই এই প্রবাসে আমাদের সবারই ঈদ আসে একটা মিশ্র অনুভূতি নিয়ে- আনন্দ আর বেদনায় দুইয়েরই সংমিশ্রনে। ঈদের দিন বারে বারে শাহনাজ রহমতুল্লার ওই গানটি মনে পড়ে – একবার যেতে দেনা আমার ছোট্ট সোনার গাঁয় , যেথায় কোকিল ডাকে কুহু কুহু দোয়েল ডাকে মুহু মুহু, নদী যেথায় ছুটে চলে আপন ঠিকানায়।
মাহমুদা নাসরিন, আরসিআইসি & কমিশনার অফ ওৎস , ক্যানবাংলা ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস, ২০৫/৩০৯৮ ডানফোর্থ এভিনিউ, শিক্ষক এবং সমাজকর্মী।