তোমার সাথে আমার কথা হয় না দশ বছরের বেশী, তুমি চলে যাবার পর কতবার ফোনটা হাতে নিয়েছি কথা বলব ভেবে, আবার রেখে দিয়েছি ওপাশে কোন শব্দ নেই। প্রতিদিন তোমাকে মনে পরবেই কতবার তা জানি না। মাঝে মাঝেই ভাবি এতোগুলো ছেলে মেয়ের বাবা তুমি, ভালোবাসা তো সবার জন্য একই দেখেছি, কি ভাবে পারতে!
বাবাকে আমরা ভয় পেতাম কিনা জানি না কিন্তু যখনই তার মোটর সাইকেলের শব্দ পেতাম ওমনি সবাই যার যার জায়গায় বই নিয়ে বসে যেতাম। আবার সকালে যখন দেখতাম আব্বা উঠে গেছেন আবার সবাই পড়ার টেবিলে। আমার মনে আছে আব্বার হাতের মার খেয়েছি ক্লাশ ফোরে, সেটাই জীবনে প্রথম আর শেষ বার। সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন জেলার এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কখনো মোটর সাইকেল,জীপ ও স্পীড বোটে। WHO under এ বসন্ত নির্মূল অভিযান। সে পাব্লিক হেলথ এর ডিস্ট্রিক হেড ইন্সপেক্টর। মা আগেই সাবধান করত আমরা যেন আসার পরে ঝামেলা না করি। কিন্তু সেটা করতাম, ছোট ছোট জিনিস নিয়ে বড় আপা আর আমার লাগত। সেই দিন দুই বোন ই থাপ্পড় খেলাম, আমরা যেমন হতবাক আর আব্বার সারারাত কান্না মন খারাপ। আমাদের ধারণা ছিল মার খাব শুধু মায়ের হাতে, যেটা আমরা কেয়ার ও করতাম না। শাসন করার একচ্ছত্র ক্ষমতা দেয়া ছিল তার হাতে।
আমাদের ইংরেজী পড়াতেন আব্বা, প্রতিবার ই সেই টেন্স থেকে শুরু। খুব রাগ লাগত আবার সেই গোড়া থেকে শুরু। যে কোন কিছু পড়াতে গেলে এতভাবে বোঝানোর চেষ্টা করতেন, খুব বিরক্ত হতাম, ইস আর যদি না পড়তে হতো।
যেখানে আমাদের বন্ধু, বন্ধবীরা তাদের বাবা মায়ের কাছে সব লুকাত। আর আমরা বাবার সাথে সব শেয়ার করতাম, কোথায় কি দেখে আসলাম, আমাদের বান্ধবীদেরও অনেক ভরসার জায়গা ছিল আমার বাবা।
ক্লাস ফাইভে, এইটে বৃত্তি পরীক্ষা সারারাত আব্বা জাগা আমাদের সাথে। পরীক্ষার হলে নামিয়ে দেয়া আর গেট খুললেই প্রথমেই দেখতাম তিনি দাঁড়িয়ে। হাতে কিছু খাবার। মেট্রিক পরীক্ষার সীট পড়ছে গভঃগার্লসে, পাশেই যে বাড়ী ওনাদের বানর ছিল,যেটা প রীক্ষার হলের জানালা দিয়ে দেখা যেতো। একটা পরীক্ষা দিয়ে বের হয়েই দেখি আব্বা টিফিন নিয়ে দাঁড়ানো, বানরের গল্প শুরু করার সাথে সাথেই বললেন সর্বনাশ এই বানরের খেলা বড় আপাও তার পরীক্ষার সময় দেখেছে। ২য় পর্ব দিতে গিয়েই দেখি সে আর নাই গাছে। আব্বার অনুরোধে তাকে নীচে রাখা হয়েছে।
আমার পরীক্ষা খারাপ হলে বা যে কোন কারনে মন খারাপ হলে প্রথমেই আব্বা বলতেন এটা কোন ঘটনা না,আসো দেখি কি হইছে!
অনেক সুখ স্মৃতি আছে আমার বাবার সাথে। আমরা সব ভাই বোনেরা একসাথে খাটে বসে টিভি দেখতাম আব্বার সাথে। জানালার কার্নিশে সব চায়ের কাপ। মা মাঝে মাঝে এসে বলত, নবাবের বাচ্চারা নামো খাট থেকে সাথে নবাব , আব্বা মাকে বলতেন তুমি এইটা বইলো আমার পোলাপানরে, ভালো শোনায়।
আব্বা ১৪ বছর ছিলেন দেশের বাইরে সেই সময় ভাই বোনেরা সবাই কেবল বড় হচ্ছে। এরই মধ্যে অনেকে মেডিক্যাল কলেজ, ভার্সিটিতে চলে গেছে। আব্বা ছুটিতে আসলে কাউকে আর যেতে দিতে চাইতেন না, আজ না কাল যাও বা আমি যে কয়েকদিন আছি, না গেলা। আমার মা এসব একদম প্রশ্রয় দিত না, আব্বা সব সময় বলতেন, তোমার মা অনেক কঠিন। তোমার মা সুযোগ পেলে “ইন্দিরা গান্ধী হতো “।
বাবা যখন নানা বা দাদা হয়ে যান তখন তাদের আরেকটা রুপ দেখা যায় আর আমার বাবার মতো নরম মনের মানুষদের তো কথাই নাই। যতই বিরক্ত করুক কিছু বলা যাবে না। আব্বাকে বলতাম আপনার আহ্লাদে এরা তো সব সোনার বানর হবে।
আব্বার সাথে আমার শেষ দেখা ২০০৭। তার আগের বছরও আমরা দেশে গিয়েছিলাম। জীবনের শ্রেষ্ঠ আর সুন্দর সময় কাটিয়েছি তখন। আমার মেয়েরা ও বড় হয়েছে, নাতী নাত্নীদের নিয়ে আমাদের বাসা যেন চাঁদের হাট। সকালে আব্বা তার ফার্মেসীতে যাবার আগে দুই নাতীর লাঞ্চ দিয়ে যান আবার গিয়েই আমার মেয়েদের ফোন করেন তাদের কি লাগবে। তিন জনের বিশাল লিস্ট, আমড়া থেকে ছবি আকার রং আবার বিকেলে যাবার পর সেই বায়না করে নানা ভাইয়ের কাছে। এখান থেকে যাবার আগেই আমার ছোট মেয়ে বলে রাখছে তুমি আমার জন্য বিড়ালের বাচ্চা আনবে। আব্বা ঠিক কোন এক রিক্সাওয়ালাকে দিয়ে সেটাও জোগাড় করে রাখছেন, আমার মেয়েদের আনন্দের সীমা নাই। আরোও কত শত ঘটনা, নাতীনদের নিয়ে বাইরে যাওয়া ( ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে) কোন ক্লান্তি নাই। মা বলে তোর আব্বাকে আমি কাজে বললে কত অজুহাত, আর নাতীনদের সাথে নিজের ঘুরাঘুরিতে সমস্যা নাই। আমার মায়ের প্রতি অনেক আস্থা আর বিশ্বাস আর ভালোবাসা। মা একবার নিউইয়র্কে এসে আট মাস ছিল আব্বা আসেন নাই। আব্বা ফোন করে বলতেন তোমার মাকে পাঠিয়ে দাও “পাখীর মতো করে পালছি তাকে এতো কষ্ট সে করতে পারবে না ” প্রতিটি কাজে রোজীর ( বড় আপার নাম) মা, চোখে হারাতেন মাকে। আব্বা যখন চিঠি লিখতেন প্রতি চিঠিতে মা আমদের জন্য কি করেন স্মরণ করিয়ে দিতেন।
যেদিন আমরা চলে আসব ২০০৭ এয়ারপোর্টে সবাই, আব্বা ও আছেন। আমি তাকাতে পারছি না কারোদিকে, আমার মেয়েদের কান্না নানা নানুর জন্য। হঠাৎ আব্বা বললেন মাফ করে দিও আর যদি দেখা না হয়! আমার কেমন করে উঠলো বুকের মধ্যে, বাবা মা কি মাফ চায় সন্তানের কাছে!! আমি কোন কথা বলতে পারিনি, বলেছিলাম আবার তো দেখা হবে। আসলে আর দেখা হয়নি। গিয়েছিলাম শেষ পর্যন্ত, এই দীর্ঘ পথের যেন শেষ নাই, আমি পৌছবার আগেই চলে গেছেন দূর থেকে বহু দূরে। নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না, কেন এতো দেরী করে ফেললাম।
মনে হয় বাবা মা বেঁচে থাকলে সব সুন্দর জিনিসগুলো দেখাতাম। ভালো হোটেলে রাখতাম,দামী রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাওয়াতাম, সমুদ্র দেখাতাম আরোও কত কি!! কিছু করার সুযোগই পেলাম না, এদিক দিয়ে আমরা সাত ভাইবোনই খুব দূর্ভাগা। আমার বাবা মা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান নিজের হাতে সাতটা তাঁরা গড়ে,স্বপ্নের সাত তারা মঞ্জিল বানিয়েছেন। সেখানেও আজ শুন্যতা।
বাবা, মা প্রতিদিন তোমাদের খুজি, সুখে কি দুঃখে। বাবা শেষ বার তোমার মুখ দেখেছিলাম কাঁচের ওপাশে তখন তোমার আমার দু’জনের চোখ ই ঝাপসা। ক্ষমা করে দিও আমার অক্ষমতাকে, কত যে ভালোবাসি ওই মুখ বলা কি হয়েছে! হয়ত না, কিন্তু জানতে তুমি ঠিক ই। ভালোবাসি বাবা অনেক অনেক।