বর্তমান যুগ ইনফরমেশন টেকনোলজির যুগ। সারা দুনিয়ার আনাচে কানাচে সর্বত্রই এর প্রভাব বিদ্যমান। কম্পিউটার,ল্যাপটপ,স্মার্ট ফোন,আই প্যাড ইত্যাদি সব কিছুই আজকাল ইন্টারনেট নির্ভর। ইন্টারনেট ছাড়া এখন দৈনন্দিন জীবনযাত্রাই বলতে গেলে অচল। সব কিছু যেন এখন হাতের কছে চলে এসেছে। অনেক ভালো ভালো বিষয় আমরা অতি দ্রুত আয়ত্ত করতে পারছি এখন স্বল্প সময় ও স্বল্প শ্রমের মাধ্যমে।
তবে ইন্টারনেট বা “E ” জগৎ বা “E-নেট” আমাদের অনেক ভাল ভালো বিষয় যেমন দিচ্ছে ঠিক সেই পরিমান খারাপ বিষয়ও E – জগৎ থেকে সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে প্রবেশ করছে। অতি দ্রুতই এটার বিস্তার চলছে অপ্রতিরুদ্ধ গতিতে। এর ক্ষতিকর প্রভাব আশংকাজনক বলে সমাজের সব ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই তার স্থান সুদৃঢ় করে নিয়েছে।
বিশ্ব পরিমণ্ডলে “E” -জগতের ভালো/মন্দ প্রভাব নিয়ে আলোচলা একটি ব্যাপক বিষয়। আমি সে বিষয়ে আলোচলা করার যোগ্য নই। তবে আমার নিজস্ব পরিমণ্ডলে ইন্টারনেট বা ” E ” – জগতের যে প্রভান পড়েছে তার একটি দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করতে চাই। এই ” E” -জগৎ বা ইন্টারনেট আমাদের ” ভাষা “-কে সাংঘাতিক ভাবে আক্রমণ করেছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা ফেইসবুক,হোয়াটস আপ ,ইমো ,ভাইবার এবং আরো অন্যানো অনেক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছি। .প্রকৃত পক্ষে ,ফেইসবুক হোয়াটস আপ বা ম্যাসেন্জারের মাধ্যমে প্রতিনিয়তই এখন অনেকে দৈনন্দিন যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। এ সকল মাধ্যমে যোগাযোগ করতে আমরা আমাদের মাতৃভাষা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা কে-ও সংক্ষিপ্ত করে প্রায় নুতন রূপ দিয়ে ফেলেছি!! যে কেউ ফেইসবুক বা হোয়াটস আপ বা অন্য কোনো মাধ্যমে তার বন্ধুবান্ধব বা নিকটজনের কথোপকথন লক্ষ্য করলেই এটা দেখতে পাবেন।
“E ” – জগৎ বা ইন্টারনেটের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিভাবে আমরা ভাষা নুতন রূপ দিয়েছি সেটা নিয়ে আমার এক বন্ধুর একটি লেখা আমি সরাসরি উদৃত করলাম, —
“””বাংলা জোকস এর সদস্য দেব বিশ্বাস এর লেখা থেকে উদৃত “ আমাদের ‘E ‘ – জীবনের এক অসাধারণ প্রতিচ্ছবি।
“গতকাল আমার বন্ধুর মেয়ে আমায় হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ করল ‘Maa ask korlo J, kaal 2mi maa k ph kore6le keno’? ভাষাটা বাংলা বর্ণমালার হলেও হরফটা ইংরিজি। কয়েক দশকে বাঙালির কাছে এটা এক নব্য পণ্য। সম্প্রতি মোবাইল ফোনের দৌরাত্মে ই–মেলে, এসএমএসে, ফেসবুকে, হোয়াটস অ্যাপে সর্বত্র নানা কিসিমের বিচিত্র বাকবিন্যাস। পড়তে গিয়ে পদে পদে বিপদে পড়ি। ‘hate’ লেখা দেখে ভাবি আমি কি এতই ঘৃণ্য? বুঝতে পারি না ওটা হল ‘হাতে’। এভাবেই ক্রমাগত শিখছি ই–ভাষা।
ফেসবুকে বিচিত্র সংক্ষিপ্তকরণের ছড়াছড়ি। শুরুতে o.m.g. দেখলে ভাবতাম বোধহয় লিখতে চাইছে ‘ও মাগো’, এখন বুঝেছি ওটা বিস্ময়যুক্ত ‘ও মাই গড’! সংক্ষেপে লেখার ইঁদুর মারা কল যে কী ভয়াবহ আবহ তৈরি করে, ভাবলে রোমাঞ্চ হয়। হাঁটুর বয়সী একটি মেয়ে সেদিন লিখেছে ‘আঙ্কেল, এই নিয়ে চারটে মেসেজ করলাম, বাট এখনও তুমি আমাকে রেপ করলে না’? যখন বুঝলাম ইংরাজি হরফে ‘rep’ হল ‘reply’-এর সংক্ষিপ্তকরণ, তখন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। মনে মনে বললাম – মা, আমাকে বরং ‘ans’ করতে বোল।
কত সংক্ষেপে লেখা যায়, তার যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে ই–ভাষায়। শুধু ‘u’ অক্ষরটি দিলেই বুঝে নিতে হয় যে, ওটা আসলে ‘you’। বাংলার কয়েকটি শব্দ ইংরাজির একটি হরফের উচ্চারণেই মিলে যায়। যেমন J হল যে, K হল কে। এই রীতিতে লিখতে থাকলে কেসটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে ভেবেছেন?
LOL, LMAO, RFOL, WTF, BTW, FYI, GM, GN….. এর কোন শেষ নেই। আস্ত একটি অভিধান বানানো যাবে!!
আমার এক নব্য কলিগ সক্কাল সক্কাল পাঠালেন GM.. আমিতো আকাশ থেকে পড়লাম, এটাকি গালাগাল?? হ্যা গালাগালি ই তো!! আমার রাগ হয়ে গেল আমি রিপ্লাই দিলাম BC!!
ওমা সংগে সংগে রিপ্লাই “মানে!! আমি আপনাকে গুডমর্নিং বললাম আর আপনি আমাকে বিসি বলছেন?? “আমি পড়লাম মহা ফাঁপরে– কোনরকমভাবে মেকআপ করলাম এই বলে যে” আমি সংখেপে লিখেছি Be Cheerful “…TC মানে এখন টেক কেয়ার! TX মানে থ্যাংকস
বিপস মানে বিপাশা বসু,’টগর‘ মানে এখন রবীন্দ্রনাথ, আরো এক্সট্রিম !!
ই–ভাষার মক্কা অধুনা ফেসবুক। রীতিমত গবেষণার অজস্র রসদ মজুত রয়েছে ফেসবুকিয়ানদের ওয়ালে। খ্যাতনামা ব্যক্তির জন্মদিন বা মৃত্যুদিন এলেই হল। ছবি পোস্ট করার ধুম লেগে যাবে হৃদকমলে। পোস্টটা যদি মৃত্যুদিনের হয়, তাহলেই গেড়ো। খালি কমেন্ট আসবে ‘RIP’। বিপ–বিপ ধ্বনির মতো এই রিপ–রিপ কী বস্তু, না বুঝলে আপনি যে ই–দুনিয়ায় আনাড়ি তা প্রমাণ হয়ে যাবে। এই রিপ হল ‘রেস্ট ইন পিস’। শান্তিতে থাকার কী অশান্তিকর প্রার্থনা প্রয়াস।
শুধু কি ভাষার জটিলতা? ফেসবুকিয়ানরা এক–একজন একেক বস্তু। কেউ লাইক বিশেষজ্ঞ। এঁরা বেশি কথা না বলে পাইকারি হারে লাইক করে যান। কারও হয়ত বাবা মরেছে, সে বেচারি কাঁদোকাঁদো ভাষায় জানিয়েছে মৃত্যুসংবাদ। ব্যস, লাইক মাস্টার সেটিও দিলেন লাইক করে।
আর এক কিসিমের ফেসবুকিয়ান আছেন, যাঁদের বলা হয় স্ট্যাটাসটিয়ান। এঁরা পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর হেঁচকি তোলার মত স্ট্যাটাস দিতে থাকেন। এঁরা কারও উত্তর বা মতামতের ধার ধারেন না। এঁদের স্ট্যাটাসে থাকে ‘বড্ড মাথা ধরেছে’, পরমুহূর্তেই ‘উফ্ কী দিল!’ কে দিলেন, কাকে দিলেন, কেন দিলেন– তা কেউ জানতেও চায় না; তবু তিনি শুধু স্ট্যাটাস দিয়ে যান।
ই–রাজ্যের আর এক বাসিন্দার নাম বলা যেতে পারে ট্যাগনেশিয়ান। এঁরা সারাদিন ব্যক্তিগত ফটো পোস্ট করেন আর সেগুলো যাঁকে খুশি ট্যাগ করতে থাকেন। তিনি বুঝতেও চান না যে, তাঁর বাথরুমের জন্য কেনা নতুন মগের ছবি নিয়ে অন্যেরা কী করবে!
আর আছেন কমেন্টেটারগণ। তিনি যেখানে পারেন, কমেন্ট দিয়ে বেড়ান। চেনা–অচেনার ধার ধারেন না। হয়তো একটি বিমূর্ত ছবি নিয়ে কথা বলছেন দুজন শিল্পী বন্ধু। কমেন্টেটার এদের ভেতরে ঢুকে বলে এলেন – ‘থ্যাঙ্ক ইউ’! কাকে থ্যাঙ্ক ইউ, কেন থ্যাঙ্ক ইউ, এসব প্রশ্নই ই–দেশে অপ্রাসঙ্গিক।
ই–দুনিয়ায় এখনও যাঁরা পা রাখেননি, তাঁরা জানেন না কী বিচিত্র এই পৃথিবী। এখানে কারও ঘর ভাঙে, কেউ ঘর বাঁধে। এখানে তৈরি হয় নানা ধরনের গ্রুপ। সেই গ্রুপের সদস্যরা গেট টুগেদার করে, পিকনিকে যায়। দল বেঁধে যারা গেট টুগেদারে যায়, তাদেরই কেউ কেউ দলছুট হয়ে মিট করে কোনও মলে। বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়, জোড়া জোড়া নারী–পুরুষ ‘মলে মলে যোগ দিন’ স্লোগান তুলে দেখা করে। সেই ‘দেখা’ কারও কারও চোখে সর্ষেফুল দেখায়, প্রাণ এবং মান বাঁচাতে তথাকথিত ফ্রেন্ডশিপকে তারা কয়েক মাস এড়িয়ে চলে!
তারপর যথারীতি গেয়ে ওঠে – ‘আহা E আনন্দ আকাশে বাতাসে…
কালান্তরের আশায় দিন গুনতে গুনতে ভাষান্তরটা যে কবে হয়ে গেল টেরই পেলুম না।“””
দেব বিশ্বাস সংগৃহিত এ লেখাটি আমাকে “E” -জগতের ভাষা সম্পর্কে যে ধারণে দিয়েছে তাতে আমি শংকিত। এভাবে চলতে থাকলে না জানি কবে আমাদের ভাষার নিজস্ব চেহারাটাই কবে নুতন রূপ ধারণ করে !!!
ছবি:-সৌজন্যে Mi Guia Argentina
– মোঃ মনিরুজ্জামান / টরন্টো