বেক্তিগত কাজে ব্যস্ত থাকায় আজ দুদিন বাংলাদেশের খবর দেখার সময় হয়নি। আজকে মোস্তফা ভাইয়ের একটি পোস্ট থেকে ঢাকার FR টাওয়ার এর আগুন এবং প্রাণহানির খবর শুনলাম। আমাদের অফিসে প্রতি ৩/৪ মাস অন্তর অন্তর Fire Drill হয়ে থাকে। এ সময় আমাদের অফিসের হেলথ এন্ড সেফটি কমিটির ফায়ার ওয়ার্ডেন এর নেতৃত্ব আমরা দ্রুত নিরাপদ স্থানে গিয়ে জড়ো হই। প্রথম প্রথম এর গুরুত্বটি বেশি বুঝতে পারি নাই। ভেবেছি একবার হলেই তো হলো। এতো ঘন ঘন কেন। আসলে ঘন ঘন না করলে ঠিক বিপদের মুহূর্তে মনে থাকবে না এবং সেফটি প্ল্যান অনুযায়ী আগানো যাবে না।
যাহোক কয়েকদিন আগে আমাদের তেমন একটি ফায়ার ড্রিল হয়। ঠিক গত রাত্রে আমি সেই ফায়ার ড্রিলই স্বপ্ন দেখি। জানিনা এটি কোনো খারাপ খবরের টেলিপ্যাথিক ব্যাপার কি না। যাহোক এই মর্মান্তিক ঘটনায় আমরা শোকাহত এবং আল্লাহর কাছে মৃতদের আত্মার প্রতি মাগফেরাত কামনা এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য লাভের দোয়া করছি।
আমি এখানে সেফটি প্ল্যান নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। পুরান ঢাকার আগুন লেগেছিলো, সেটি এতো উন্নত এলাকা ছিল না, বা ওখানে কর্পোরেট অফিসও ছিল না তাই তাদের সেফটি প্ল্যান আর কি থাকবে, যদিও সমস্ত জায়গায় এটি থাকার দরকার। আমি এখানে ফায়ার সার্ভিসের দায়দায়িত্ত্বর কথা বলবো না। আমার কথা হলো আমাদের কর্মক্ষেত্রের কতৃপক্ষের, কর্মক্ষেত্রের বিল্ডিং কতৃপক্ষের এবং আমাদের বেক্তিগত সেফটি প্ল্যান বা দায়িত্বের কথা। আর এই সেফটি প্লানের জন্য কোনো খরচ দরকার হয় না অতএব ওই কর্মক্ষেত্রের বা সরকারের টাকা নেই, সে কথা বলে দায়িত্ব উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। FR টাওয়ারের আগুন এবং লোকজনের অপরিকল্পিত এবং নিরবিচ্ছিন্ন পন্থায় বাঁচার চেষ্টা দেখে এটা খুবই পরিষ্কার যে ওখানে কোনো ধরণের সেফটি প্ল্যান ছিল না।
এতগুলি আধুনিক বিল্ডিং, কর্পোরেট অফিস এবং ওখানে যথেষ্ট শিক্ষিত এবং সচেতন মানুষ আছেন কিন্তু তারা আগুন, ভূমিকম্পহ বা ঝড়-বাদল জাতীয় বিপদের কোনো সেফটি প্ল্যান রাখেন বলে মনে হয় না। নিয়মিত ড্রিল করার কথা তো বাদই দিলাম। যেহেতু এই সেফটি প্ল্যান তৈরিতে খুব বেশি অর্থের দরকার হয় না তাই এক্ষেত্রে সরকারে সংস্লিষ্ট দফতরের একটি দেখভাল খুবই প্রয়োজন। সাথে সাথে আমি প্রতিটি ব্যক্তিকে বলবো এই ব্যাপারে আপনার অফিস এবং স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করুন। নিরাপদ সড়কের আন্দোলন করছি কিন্তু আসলে কোথাও কি আমাদের নিরাপত্তা আছে। কথাটি ব্যাপক হয়ে গেলো হয়তো, কিন্তু সামপ্রতিক ঘটনাবলী দেখে মনে এমন প্রশ্ন আসে। আর সবার প্রতি অনুরোধ, যারা বিশেষ করে এই ধরনণের জায়গায় কাজ করেন, গাড়ি ঘরে চলাচল করেন, বড়ো কোনো গেদারিংএ যান তারা কবে কখন সরকার বা সংস্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগুলি করবে সেই আশায় বসে না থেকে নিজে নিজে যতটুকু পারেন নিজের একটি এস্কেপ রুট বা সেফটি প্ল্যান রেডি রাখুন তাতে আল্লাহর ইচ্ছায় আপনার ক্ষতি একটু কম হবে।
আমি চেষ্টা করেছি একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে নিরপেক্ষ কথা বলতে কিন্তু কিছু কিছু কথা সরকারি অবেবস্থাপনার ইঙ্গিত দিবে, আর সেটি আমি মনে করি খুবই প্রসাঙ্গিক। দল ফল আমি কিছু জানি না, এই মুহূর্তে সরকরি কোনো দায়দায়িত্বের ব্যর্থতা বর্তমান সরকারকেই নিতে হবে, আর হাঁ, শুধু মাত্র সরকারের আশায় বসে থাকলে চলবে না। চেষ্টা করুন নিজের দায়িত্বটাও সময়মতো করার।
এবার আমি আসি আমার টোরোন্টোবাসী তথা কানাডাবাসীদের কথায়। এখানে সেফটি প্ল্যান বা এই জাতীয় জিনিস থাকার পরেও আমরা অনেক সময় সেগুলি পাত্তা দেই না বা ignore করি। শুধুমাত্র বাঙালিরাই না অন্য দেশীয়দের মধ্যেও এই প্রবণতা আছে, তবে যেহেতু আমাদের নিয়ে কথা বলছি তাই বাঙালির মধ্যেই সীমিত রাখছি। আপনি যে অফিসে বা যে জায়গায় কাজ করেন সেই বিল্ডিং এর সেফটি প্লানটি জেনে রাখুন এবং মাঝে মধ্যে সেটিতে চোখ বুলান। আপনার বাসার স্মোক অ্যালার্ম বা কার্বন মোনক্সাইড অ্যালার্ম ঠিকমতো কাজ করে কি না সেটি টাইম টু টাইম চেক করুন। আপনি কন্ডোতে বা রেন্টেড এপার্টমেন্ট এ থাকলে ওরা মাঝে মাঝে এসে চেক করবে এবং ড্রিলও করে। ওই সময়ের ওদের নির্দেশাবলী মনে রাখুন। নিজের এবং পরিবারের জরুরি অবস্থায় এসকেপ রুটটি মনে করে রাখুন। দেখবেন প্রতিটি কন্ড বা এপার্টমেন্টের এন্ট্রান্সএ সেফটি প্ল্যান এবং ম্যাপ আছে। সেটি ভালো করে জেনে রাখুন।
আর যদি নিজের বাড়ি অথবা এমনি সিঙ্গেল বাসায় থাকেন তাহলে সেফটি প্লানটি আপনার নিজেকেই করতে হবে, স্মোক অ্যালার্ম বা কার্বন মোনক্সাইড অ্যালার্ম আপনার নিজেকেই চেক করতে হবে। ভেবে দেখুন শেষ সময় কখন করেছেন। বিগত দুই/তিন বছরে টরন্টো বা আসে পাশের কয়েকটি অগ্নিকান্ডে ফায়ার মার্শালের রিপোর্টে জানা গেছে তাদের স্মোক ডিটেক্টর কাজ করছিলো না তাই তারা ঘুমের মধ্যে বুঝতে পারে নাই এবং বোঝার আগেই আগুন তাদেরকে ধরে ফেলেছে। সাম্প্রতিক আমাদের মেরিটাইম প্রভিন্সে এক সিরিয়ান পরিবারের যে ৬/৭ বাচ্চা আগুনে পুড়ে মারা গেলো, শুনেছি তাদেরও স্মোক ডিটেক্টর একটিভ ছিল না।
পাবলিক বাস, প্লেন বা ট্রেনে উঠলে ওদের এক্সিট দরোজাটা আপনার থেকে কত দূরে সেটি খেয়াল রাখুন এবং এমার্জেন্সি অবস্থার কর্মকান্ডের করণীয় কাজগুলি জেনে রাখুন। নিজের গাড়িতে চড়লে জেনে রাখুন গাড়িতে হটাৎ আগুন লাগলে বা গাড়িটি পানির মধ্যে পড়ে গেলে আপনি কিভাবে বের হবেন ইত্যাদি। আমরা অনেক সময় নৌকায়, কেনুতে বা ছোট খাটো বোটে গেলে নিজের দামি ফোনটি সঙ্গে রাখি না। এসময় আপনি আপনার একটি পুরানো সেল ফোন যেটির কোনো সাবস্ক্রাইবার নেই সেটি চার্জ দিয়ে সঙ্গে রাখতে পারেন। এই ফোনে অন্য কোথাও ফোন না করতে পারলেও ৯১১ কল করতে পারবেন, বিনা পয়সায়। তাছাড়া আপনার হয়তো সেল ফোন বিল মেইন্টেন করার সামর্থ নেই কিন্তু একটি পুরান ফোন আছে। সেটি আপনি শুধু মাত্র ৯১১ কল করার জন্য ফুল চার্জ দিয়ে সঙ্গে রাখতে পারেন। মোটামুটি সিগন্যাল থাকলেই আপনি ৯১১ কল করতে পারবেন, আপনার ফোনে টাকা থাকুক বা নাই থাকুক।
আমি বেক্তিগত সেফটি প্লানের উপর জোর দিলাম এই কারণে যে আপনি উন্নত দেশে থাকেন বা উন্নয়নশীল দেশেই থাকেন না কেন সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের জরুরী সাহায্যে আপনার কাছে পৌঁছাতে কিছুটা সময় লাগবে, অন্তত সেই সময়টুকু কিভাবে টিকে থাকবেন সেই বেপারে নিজেকে প্রস্তুতু রাখুন, বাকি আল্লাহর হাত। শুধু মাত্র জরুরী সাহায্য আসার আগে কি করতে হবে সেটি জানা থাকলে বনানীর আগুনের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কম হতো। আমরা হয়তো আল্লার মাল আল্লায় নিয়েছে বলতে পারি, কিন্তু তাতে দায় দায়িত্ব কিন্তু এড়ানো যায় না।
আমার অবাক লাগে, এই কানাডাতেও অনেকে এই সেফটি ব্যাপারটি পাত্তা দেন না। যেমন আমার এক আত্মীয় যদি গাড়িতে স্কারবোরো থেকে মিসিসাগার মতো ছোট দূরত্বেও আসেন তাহলে সিটবেল্ট বাঁধতে চান না। কারণ উনার নাকি গায়ে “জ্বালা উঠে “. এক্ষত্রে উনি এই ৪০/৫০ মিনিটের গায়ে জ্বালা খেলার থেকে বাঁচার জন্য পুরা জীবনটাই হুমকিতে রাখছেন। আবার তেমনি তার বাচ্চাটি প্রথম প্রথম সিট্ বেল্ট বাঁধলে কান্নাকাটি করতো। উনি তার সিটবেল্ট বাঁধতে চাইতেন না, কারণ বাচ্চার কান্না এবং কষ্ট উনি সহ্য করতে পড়তেন না। এখানেও উনি বাচ্চার এই ৪০/৫০ মিনিটের কষ্টের কাছে তার জীবনকে হুমকির মুখে রাখছেন। এখানে অনেক অনেক গাড়ি এক্সিডেন্টের রিপোর্টে আমরা জানতে পাই যে যারা সিটবেল্ট পরে ছিলেন না তাদের হতা-হতের পরিমান বেশি। পুলিশের টিকেট খেলে আপনার হয়তো খুব একটা ক্ষতি হবে না, কিন্তু একসিডেন্ট হলে যে আপনার পুরো জীবনটাই চলে যেতে পারে। যাহোক বিষয় গুলি সবাই এখানে মুটামুটি জানেন তার পরেও বলছি এই কারণে যে মানুষ কিন্তু মাঝে মধ্যেই এই বিষয়গুলিকে অবহেলা করে অনেক বিপদে পড়ছেন।
নিজে এবং নিজের পরিবারের সেফটি প্ল্যান মাথায় রাখুন। Young Driversএ গাড়ি চালনার ট্রেনিং ক্লাসে একটি কথা শিখেছিলাম, ” “you may not avoid accident, but you can avoid collision” তাই আসুন যেটিকে avoid করার আমাদের উপায় আছে সেটিকে avoid করি এবং নিজে এবং অন্যকে নিরাপদে থাকতে সাহায্য করি।
সবাই ভালো, সুস্থ এবং নিরাপদে থাকুন। পরম করুনাময় আমাদের সহায় হউন।
বি. মুকুল