“প্রবাসে বাংলা শেখার প্রয়োজনীয়তা ও করণীয়” শীর্ষক সেমিনার নিয়ে আমার আগের লেখাটা অনেকটা ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ইতি টেনেছিলাম। কারন আমি পত্রকার নই বা গল্পকার নই আর ব্লগের পাঠকরা সাধারণত নাতিদীর্য লেখা পছন্দ করেন। কিন্তু পরে ভাবলাম কোথাও যেন একটা অসপূর্ণতা রয়ে গেছে। এজন্যই আজকের পর্বটি লেখা।
অভিবাসন একটা কঠিন পরীক্ষা। যার মধ্যে আছে আনন্দ , ত্যাগ , আর সংগ্রাম।
আনন্দ – এটা একটা নতুন আবাসস্থলে আগমন আর সেই সাথে নতুনের সাথে পরিচয়ের আনন্দ। অনেক আকাংখিত আপেক্ষার পরিসমাপ্তি।
ত্যাগ – ফেলে আসা জায়গাটি , যেখানে জড়িয়ে আছে জন্ম , শৈশব,কৈশোর আর যৌবনদের স্মৃতিময় দিন গুলো। যেখানে আর চাইলেই সহজে ফিরে আসা যায় না।
সংগ্রাম – একটা নতুন পথ চলার শুরু। নতুন কর্মস্হল , নতুন বাসস্থান ,নতুন পরিবেশ। আগের পদ-পদবী, পেশা সবই অতীত। পিছনে ফিরে তাকাবার সময় নাই। শুরু হলো বাঁচে থাকার নতুন সংগ্রাম।
প্রবাসে বাংলা শেখার প্রয়োজনীয়তা ও চর্চা নিয়ে গত অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকল গুনীজনেরা সুচিন্তিত মতামত রেখেছেন। তুলে ধরেছেন প্রবাসে বাংলা চর্চার প্রয়োজনীতা। আর সেই সাথে দিয়ে গেছেন এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার বিভিন্ন পথনির্দশনা।
আমি অন্যদের উদহারণ দিয়ে নয় , আমার আত্মস্বীকৃত জবানবন্দী দিয়ে শুরু করতে চাই এই বিষয়টা। আমি বিশ্বাস করি কোনো পরিবর্তন করতে গেলে নিজের ঘর থেকেই তা শুরু করা প্রয়োজন। কারণ আমার সমস্যাগুলো আমিই ভালো জানি, অন্য মানুষ তা জানার কথা নয়।
১৬ বছরের দুবাইয়ের প্রবাস জীবন কাটিয়ে আজ থেকে ১৭ বছর আগে আটলান্টিক পার হয়ে পৌঁছেছিলাম এই নতুন আবাসস্হলে। একটা নতুন ঠিকানায় , একটা নতুন দেশ আর একটা নতুন পরিবেশ।দুবাইতে ছেড়ে এসেছিলাম একটা ইউরোপিয়ান বিমান সংস্থার দীর্যদিনের চাকুরী। ছেড়ে এসেছিলাম পদ-পদবী। তখনকার দিনে কিন্তু সেল ফোন বা ইন্টারনেটের এতটা প্রচলন ছিলোনা। না ছিল ফেসবুকের এতটা জনপ্রিয়তা। ছিলোনা আজকের মত কোনো ফেসবুক গ্রুপ ABCD বা XYZ । সবটাই করতে হয়েছে নিজের চেষ্টায়। সহযোগিতা বা পরামর্শ বলতে যা বুঝায় তা পেয়েছি শুধুমাত্র আমার এক স্কুল সহপাঠীর ছোট ভাই মুকুল এর কাছ থেকে। মুকুল- সে আমার চাইতে কয়েক বছর আগেই কানাডাতে এসেছিলো।
২০০২ সালের শীতের প্রারম্ভে শুরু হলো জীবনের একটা নতুন অধ্যায়-জীবন সংগ্রামের দ্বিতীয় অধ্যায়। দুই ছেলেকেই স্কুলে ভর্তি করা হলো। একজন প্রাইমারিতে আর ছোটটি কিন্ডারগার্ডেনে। দুজনেই দুবাই থেকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এসেছিল। তদুপরি দ্বিতীয় সপ্তাহে স্কুল থেকে নোট আসলো , ঘরে ইংলিশে কথোপকতন করার জন্য। ছোট ছেলের ইংলিশ Communication skill বাড়াবার জন্য। আমার দুবাইয়ের অভিজ্ঞতার আলোকে বিষয়টা আমার কাছে অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিলো। আমার ১৬ বছরের দুবাইয়ের প্রবাস জীবনে দেখেছি ভাষাগত পারদর্শিতার জন্য ভারতীয়রা আমাদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে ছিল। আমরা অধিকাংশ বাঙালিরা দেশে বাংলা মাধ্যমে পড়াশুনা করে এসেছি – ঘরেও ছিল বাংলার চর্চা। পক্ষান্তরে প্রায় সকল ভারতীয়রাই ঘরে ইংলিশে কথোপকথন করে থাকে। নির্দিষ্ট একটা শ্রেনীকক্ষের বাইরে আমাদের ইংরাজির চর্চা ছিলনা বললেই চলে। তাইতো আমরা ভুলে যাই যে এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাইরে পা বাড়ালেই ইংরাজির প্রয়োজন।
ফিরে যাই যে কথা বলছিলাম সেখানে। স্কুল থেকে নোট পাবার পর থেকে ঘরের মধ্যে শুরু হলো ESL চর্চা। সেই থেকে ঘরের মধ্যে শুরু হলো আংশিক ইংরেজী কথোপোকথন। আর ফিরেদেখা হয়নি। জীবনটাতো BBC বর্হিবিশ্ব কার্যক্রম নয়, যে প্রতিটি ঘন্টায় নিজ থেকে অনুষ্টানের ভাষার পরিবর্তন আপনা-আপনি হতে থাকবে। জীবনের দৌড়ে এতই ব্যাস্ত ছিলাম যে চ্যানেলটা আর পরিবর্তন করা হয়নি। যখন থামলাম ,তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।
আমার এই কথাগুলো বলার কারণ এই নয় যে আমরা ঘরে বাংলার চর্চা করবো না।. মনে রাখা প্রয়োজন এই প্রবাসে দুটি ভাষাই আমাদের জানা প্রয়োজন। বাংলা – আমার সভ্যতা আর সংস্কৃতির প্রয়োজনে আর ইংলিশ- আমার দৈনন্দিন কর্মজীবনের জন্য।
কথাটি আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বললাম। এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়তো আরো অনেকেইর থাকে পারে।আমার সমস্যাটা কিন্তু আমার চাইতে অন্য কারো ভালো জানার কথা নয়। আর আমার সমস্যার আলোকেই কিন্তু আমার সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। এজন্যই অনুরোধ করবো অন্যের প্রতি আঙ্গুল না উঠিয়া আমাদের নিজের সমাধানের পথ নিজর মত করে খুঁজি। আর এই পথযাএা নিজের ঘর থেকে শুরু করি।
আসেন আমাদের লক্ষ হোক এই প্রবাস জীবনে আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতি যেন আমরা বাঁচিয়া রাখতে পারি। আর শুরুটা যেন নিজের ঘর থেকেই হয়।
আমাদের এই প্রবাস জীবনের ব্যাস্ততার মাঝে বাচ্চাদের সাথে ভিন্ন ভাবে বসে একটা অতিরিক্ত বিষয় শেখাবার মতো সময় হয়তো আমাদের হাতে নাই। কিন্তু তাই বলে তাদের বাংলা শেখার পথটা কিন্তু সম্পূর্ন রুপে বন্ধ নয়। এই বিষয়ে আপনার সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে HSDN ইন্টার্ন্যাশনাল। প্রতি শনিবার সকাল সাড়ে ১১ টায়। টরন্টোর ডানফোর্থস্ত Access Point এ চলছে বাংলা শেখার স্কুল। আপনার আমার সবার জন্য উন্মুক্ত।
ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন , এই শুভ কামনা রইলো।