দেশের মানুষের মাথা পিছু আয়, জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের সাথে সাথে বেড়েছে দেশের জি.ডি.পি প্রবৃদ্ধি সবই সত্যি। টিভি, পত্র-পত্রিকায় সরকারের দাবি-বাংলাদেশ সারা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। কিন্তু, এত উন্নয়নের পরেও প্রদীপের আলোর নীচের অন্ধকারের মত এখনো অনেক অন্ধকার রয়ে গেছে। আর এদেশে, সেই একটি অন্ধকার দিক নারী নির্যাতন, যা ভয়াবহ রূপ ধারন করেছে। বেসরকারী আইন ও সালিশ কেন্দ্র সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ৮৯৫ টি শিশু ও নারী বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার। এর মধ্যে খুনের শিকার ২০৩। ধর্ষনের শিকার হওয়া নারী ও শিশুদের মধ্যে ১৮ বছরের নীচে শিশু কিশোরীরাই বেশী। ধর্ষনেরা শিকার ৫৯ জনের বয়স ৬ বছর । ১০২ জনের বয়স ৭-১২ বছর। ৯৭ জনের বয়স ১৩-১৮ বছর। ২৭ জনের বয়স ১৯-২৪ বছর। ১৬ জনের বয়স ২৫-৩০। ১৭ জনের বয়স ৩০ এর বেশী। ধর্ষনের শিকার ৬ বছর বয়সী ৫ জন, ৭-১২ বছর বয়সের ৭ জন , ১৩-১৮ বছর বয়সের ৯ জন, ১৯-২৪ বছর বয়সের ২ জন, ২৫-৩০ বছর বয়সের ২ জন এবং ৩০ বছরের উপরে ৪ জনকে ধর্ষনের পর হত্যা করা হয়েছে।
আজ আমাদের দেশে মেয়ে সন্তানদের বাবা মায়ের দিন কাটছে গভীর উদ্বেগ আর অজানা আতঙ্কে। এ কথা কেউ বলতে পারবেন না, মেয়েদের নিরাপদ আশ্রয় স্থল আজ কোথায় ? মেয়েরা কোথায় যাবে ? যে পরিবার সকলকে সুরক্ষা দেয়, সেই পরিবারেও মেয়েরা আজ অরক্ষিত। নিজ পরিবারে মেয়েরা আজ পিতা দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে, শ্বশুড় পূত্র বধুকে ধর্ষন করছে। এদেশে ধর্ষকের তালিকায় সবাই আছে। কেউ বাদ নেই, ডাক্তার শিশুকে অজ্ঞান করে নিয়ে তাকে ধর্ষন করছে। গণ পরিবহনে চালক, হেলপার ধর্ষণ করছে; সেনা নবিাসের অভ্যন্তরে পর্যন্ত ধর্ষনের পর হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষক হিসাবে যেমন মাদকাসক্ত, অশিক্ষিত বেকার যুবক আছে, তেমনি সর্বোচ্চ শিক্ষিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আছে। অবশ্য এব্যপারে আরো অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে মাদ্রাসার শিক্ষক। এক মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছাত্রীকে ধর্ষনের পর তার হাতে কোরআন শরীফ তুলে দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছে-ছাত্রীটি এই ধর্ষনের কথা কখনো প্রকাশ করবে না। আরো একজন মসজিদের ইমাম। যে ১৮ বছর ধরে জ্বীনের ভয় দেখিয়ে বিধবা ও প্রবাসীদের স্ত্রীকে ধর্ষন করে আসছে। শুধু তাই নয়, পড়তে আসা শিশুদের ও সে বলৎকার করে। শুধু ধর্ষন করেই ক্ষান্ত হয় না ধর্ষকরা। তারা গণ ধর্ষন এবং হত্যা যেমন করে তেমনি, দেড়/দুই বছরের শিশু থেকে শতবর্ষী বৃদ্ধা পর্যন্ত কেউই তাদের হাত থেকে রেহাই পায় না।
মনে পড়ে, ধর্ষন শব্দটির অর্থ আমরা বুঝতে পেরেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে। আর এখন ৬/৭ বছরের ছেলে মেয়েরা গলায় ফেষ্টুন ঝুলিয়ে, হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় দাড়িয়ে ধর্ষকের শাস্তি দাবী করছে। মানব বন্ধন করেছে। এতটুকু ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত আজ ধর্ষনের অর্থ-বোঝে। সচেতনতা ও সোচ্চার হওয়ার পাশাপাশি এটা সামাজিক অবক্ষয় নয় কি ? বলতে দ্বিধা নেই, মানুষ আজ পশুর চাইতে ও অধম। পশুদের মধ্যে লজ্জা বোধ ও চিন্তা শক্তি নেই। তাদের মধ্যে সম্পর্কের রকমভেদ থাকে না। তাই তারা যে কারো সাথে সর্ম্পকে লিপ্ত হয় এবং একারণেই তাদের পশু বলা হয়। কিন্তু আজ! মানুষের বিবেক, চিন্তা ও বোধ শক্তি, জ্ঞান থাকা স্বত্তেও এই গর্হিত অন্যায় কাজ করছে। পশু পাখির ভিতরে ও মাতৃ¯েœহ থাকে। তারা ও নিজের জীবন দিয়ে সন্তান রক্ষা করে। কিন্তু এখন খবরের কাগজে চোখে পড়ে পরকীয়ার কারনে মা নিজ সন্তানকে হত্যা করছে। বাবা-মা পারিবারিক কলহে সন্তানকে, স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে হত্যা করছে। আর এই সব কিছুই ঘটেছে মানুষের নৈতিক অক্ষয়ের কারনে। বাংলাদেশের মত একটা স্বল্প শিক্ষিত দেশে অশিক্ষিত, শিক্ষিত, বেকার, মাদকাসক্ত, দরিদ্র সবার হাতেই স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট। প্রতিটি জিনিসেরই ভাল খারাপ দুটি দিক থাকে। ইন্টারনেটের খারাপ দকিটি গ্রহন করেছে এক শ্রেণির শিশু, কিশোর, তরুন, যুবক, পুরুষরো। ধর্ষন কারীরা ধর্ষন করছে। সেই চিত্র ভিডিও করেছে। আবার সেই চিত্র ছড়িয়ে দেবার কথা বলে পূনরায় ধর্ষন করছে, ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। এছাড়া ও ডিশ এন্টিনার কারনে রয়েছে পশ্চিমা সংস্কৃতির অগ্রাসন। মানুষ ছুটে চলেছে অবৈধ ভাবে টাকা উপার্জনের পিছনে। আর এই সবকিছু মানুষের নৈতিক অবক্ষয় কে ত্বরান্বিত করেছে।
পরিবারে পুরুষ সদস্যদের নারীকে অসম্মান করা, কর্মক্ষেত্রে নারীকে অধস্তন হিসাবে দেখা, তাচ্ছিল্য করে কথা বলা, কোন নারী বা কিশোরীকে তার স্বাভাবিক চলাফেরা ও কাজকর্ম করা অবস্থায় অশালীন মন্তব্য করা, অশ্লীল অঙ্গ-ভঙ্গি করা, ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা দেওয়া, স্কুল কলেজ রাস্তায় মেয়েদের ইভটিজিং করা, উদ্দেশ্যমূলক ভাবে পিছু নেওয়া, গান, ছড়া আবৃত্তি করা, পথরোধ করে দাঁড়ানো, প্রেমে সাড়া না দিলে হুমকি প্রদান, ভয় দেখানো, ভিড়ের মধ্যে মেয়েদের শরীরে হাত দেওয়া, খামচে ধরা, এই সবই ধর্ষন মানসিকতার প্রাথমিক ধাপ। তৃণ মূল থেকে এই সব মানসিকতার পরিবর্তন যেমন প্রয়োজন, তেমনি ই জরুরী প্রয়োজন প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল শিক্ষা দেওয়া এবং এটি বাধ্যতামূলক হওয়া প্রয়োজন। কিশোর, তরুন, যুবক, পুরুষ প্রত্যেককে পরিবারে মা, বোন, কন্যা, স্ত্রী হিসাবে তাদের অবদান অনুভব করতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তরের পুরুষকে অনুধাবন করতে হবে- নারী শুধু দূর্বল জীব নয়, ভোগরে সামগ্রী নয়, পুরুষের মত তার সম্মান তার যোগ্যতা, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে, মেধায়, মননে সৃজনশীলতায়।
বাংলাদেশের বিচার হীনতার সংস্কৃতিই দিন দিন ধর্ষন বৃদ্ধির জন্য দায়ী। এমন কোন দিন নেই, যেদিন খবরের কাগজে ধর্ষনের খবর আসে না। এরই মাঝে ইয়াসমিন, মিলি, তনু, রূপা কিংবা নূসরাতের মত কতিপয় ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে আলোচনার ঝড় তোলে। দেশের মানুষ ধর্ষকদের বিচারের দাবিতে মানব বন্ধন, আন্দোলন, বিক্ষোভে সোচ্চার হয়ে উঠে। জনতার দাবিতে ত্ববিত গতিতে বিচার হয়ে, হয়ত দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি হয় অপরাধীর। দু/তিন মাস পর আলোচনা, সামলোচনা স্তিমিত হয়ে আসে। মানুষজন সব ভূলে যায়। কিছুদিন যেতে না যেতেই আবারো কবর থকেে মাটি খুড়ে জন্ম হয় কোন নূসরাত বা ইয়াসমিনের আত্মার। একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। দু/একটি আলোচিত মামলা ছাড়া ধর্ষনের বাকী মামলা গুলো হারিয়ে যায়। আবার গ্রামের প্রত্যন্ত অ লগুলোতে ধর্ষনের যে ঘটনাগুলো ঘটে, সেগুলো পত্র পত্রিকায় আসে না বলে, কেউ জানতে পারে না এবং তার মামলাও হয় না। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ৬৩০ টি ধর্ষনের মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ৪৩২ টির। আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থায় ধর্ষিতাকে ধর্ষনের প্রমান দিতে হয়। অবস্থা সম্পন্ন না হলে ধর্ষক ধরা পড়ে। কিন্তু, ধর্ষক যদি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় আশ্রিত কেউ কিংবা প্রভাবশীলী বা ক্ষমতাবান হয়ে থাকে তখন রাষ্ট্র অপরাধীর পক্ষেই দাঁড়ায়। প্রশাসন তখন মামলা গ্রহনে অস্বীকৃতি জানায়, অপরাধীকে বাঁচানোর জন্য অভিযুক্তকে এজাহারে রাখে না। পুলিশের দীর্ঘসুত্রতার সুযোগে অপরাধীরা পালিয়ে যায়। ধর্ষকরা জামিনে বের হয়ে এসে পুনরায় ধর্ষন করে, মামলা তুলে নেওয়ার জন্য ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। সালিশ বসিয়ে ধর্ষকের নয়, ধর্ষিতার বিচার হয়, তাকেই অপরাধী প্রমান করা হয়। বছরের পর বছর মামলা চলতে থাকে। মামলা দায়ের করার পরে বাদীর উপর চাপ প্রয়োগের সময় পুুলিশের নিস্ক্রিয়তা এবং মামলার প্রক্রিয়া সবকিছুই ধর্ষিতা নয় এবং অপরাধী তথা ধর্ষকের পক্ষে কাজ করে। কাজেই এদেশে উত্তর উত্তর বৃদ্ধি ছাড়া ধর্ষন কোনদিন বন্ধ হবে না। ধর্ষন বন্ধ করতে যুক্ত রাষ্ট্রের আলবামা অঙ্গরাজ্যের সংসদে একটি নতুন আইন পাশ হয়েছে। ১৩ বছরের কম বয়সী কোন শিশুকে ধর্ষন করলে ধর্ষককে ইনজেকশন দিয়ে বা ঔষধের মাধ্যমে নপুংশক করে দেওয়া হবে। এতে করে অপরাধী আর কোন দিন কারো সাথে শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না। অপরাধী যদি কারাবন্দী থাকে তাবে তাকে তখন ইনজেকশন দেওয়া হবে না। প্যরোলে ছাড়া পাওয়ার পর তার শরীরে ইনজেকশন পুশ করা হবে। অপরাধী যদি ইনজেকশন নিতে রাজী না হয় তাহলে আজীবন তাকে কারাগারে থাকতে হবে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউক্রেনে ২০১৭ সালে ৩২০ জন শিশু ধর্ষনের শিকার হওয়াতে ইউক্রেন সরকার ও সংসদে এই আইনটি পাশ করেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি একজন নারী। আমাদের এই দেশে একজন ধর্ষিতার অবস্থা আপনার অজানা নয়। আমাদের এই সমাজে মেয়েটির সাথে তার পরিবাকেও মানসিক ভাবে ধর্ষন করা হয়। ধর্ষনের ফলে কি অবস্থা হয় সেই মেয়েটি ও তার পরিবারের? একজন ধর্ষিতাকে আমাদের সমাজ কোন দিন মেনে নেয় না। কোন পুরুষ তাকে বিয়ে করে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনে না। দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, মানসিক যন্ত্রনা, অপমানে মেয়েটি মানসিক ভারসাম্য হারায়, না হয় আত্মহত্যা করে। নয়ত পরিশেষে তার স্থান হয় পতিতা পল্লী। দিনে পর দিন কত শত শত মেয়ের জীবন অন্ধকারের অতল গহব্বরে হারিয়ে যাচ্ছে তার হিসাব আমরা কেউ রাখি না। ছোট ছোট শিশু থেকে শুরু করে কি অপরাধ তাদের- ধর্ষনকারীরা যাদের জীবন এভাবে বিষাক্ত করে তুলেছে ? দেশের জনগনের জীবনের নিরাপত্তার দ্বায়িত্ব সরকারের। সরকার যদি মেয়ে শিশু থেকে শুরু করে নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ধর্ষনের শিকার শত শত মেয়েদের দায়ভার তো সরকারকেই নিতে হয়। ধর্ষিত মেয়েদের হাহাকার, আর্তনাত যদি আপনার কানে পৌছে থাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তবে আপনি ধর্ষনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করুন। ক্রস ফায়ার বা হারকিউলিস নয়, সাত দিনের মধ্যে বিশেষ বিচার ব্যবস্থায় ধর্ষকের আজীবন কারাদন্ড অথবা মৃত্যুদন্ড দিন। অথবা ইনজেকশন প্রয়োগে নপুংশক করে দিন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধর্ষন রুখতে যদি এই আইন করা হয়, তবে বাংলাদেশে এই আইনের বাস্তবায়ন হতে বাধা কোথায় ? চোখের সামনে অন্যায় কারীর শাস্তি দেখলে অন্যায় বন্ধ হতে বাধ্য। ইয়াসমিন, শাজনীন, তনু, রুপা, মলি, নুসরাত এদরে সারি যনে আর র্দীঘ না হয়, আর কোন মেয়ের জীবন যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়।
-শম্পা সাহা,লেখিকা ও মানবাধকিার র্কমী,
টরন্টেো