মোঃ মনিরুজ্জামান
বাংলাদেশের মানুষ ভালো আছে। অনেক শান্তিতে আছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ বেড়িয়ে এসে আমার এ ধারণা হয়েছে। কি জন্য আমার এ ধারণা হয়েছে সেটা বিস্তারিতভাবে সম্ভব না হলেও কিছু কিছু বিষয় এখানে উল্লেখ করতে চাই।
দেশে জমিজমা ও পারিবারিক কিছু ঝামেলা সমাধানের জন্য আমি গত মাসে দু ‘সপ্তাহের জন্য দেশে যাই। আমার ছোট ভাইও আমার সাথে দেশে গিয়েছিল। সময় স্বল্পতার কারণে বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়–স্বজনের সাথে দেখা করতে পারি নাই। অনেকেই এজন্য ভীষণ গোসা।
বাড়ির সমস্যা মোকাবেলার ফাঁকে ফাঁকে মানুষের আচার আচরণ,অর্থনৈতিক অবস্থা,দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি বেশ কিছু বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি। আমার কাছে সাধারণ মানুষের অবস্থার অনেক উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয়েছে। সেজন্যই বলছি যে দেশের মানুষ ভালো আছে।
কানাডা থেকে আমার দেশে যাবার কথা ছিল ১৩ জানুয়ারী। তবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে তিন দিন পরে যেতে হয়েছিল। সৌদি এয়ারলাইন্স এ এবার প্রথম ভ্রমণ করলাম। প্লেনে সার্ভিস মোটামুটি চলনসই হলেও সৌদি আরবের এয়ার পোর্ট গুলির অবস্থা অত্যান্ত নিম্নমানের। অনেক বিরক্তি ও অসন্তোষের পর ১৬ জানুয়ারী মধ্যেরাতে ঢাকা এয়ারপোর্ট নেমে এবার একটু ভালো অবস্থা চোখে পড়ল। ইমিগ্র্যাশন পুলিশ আগের তুলনায় ভালো ও অরগানাইজ মনে হয়েছে। মাত্র পাঁচমিনিটের মধ্যে ইমিগ্রশন সেরে লাগেজ নিতে কনভেয়ার বেল্টের কাছে অপেক্ষা করছিলাম আর চারিদিকে দেখছিলাম।কনভেয়ার বেল্টের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।কাস্টমস বা পোর্টারদের কোন ঝামেলা নেই। সব কিছু আগের তুলনায় ভালো মনে হল।
সময় কম থাকাটার কারণে বাড়িতে যাবার আগে এবার ঢাকায় মাত্র একদিন ছিলাম। ঐদিন কিছু কেনা কাটার জন্য নিউমার্কেট ও এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় গেলাম। এ সময় ঈদ–কোরবানি না হলেও দোকানগুলিতে ক্রেতাদের ভিড় লেগেই আছে। দোকানগুলিতে দেশি–বিদেশী সব পণ্যসামগ্রীর ছড়াছড়ি। আমি কয়েকটি প্যান্ট শার্ট ও শাল কিনলাম। নিউমার্কেট থেকে ট্রাউজার ও গেঞ্জি–জাঞ্জিয়া কিনলাম। সর্বত্রই লক্ষ্য করলাম মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত পদচারণা ও ক্রয় ক্ষমতা। আর্থিক অবস্থা আগের তুলনায় ভালো বলেই এটা সম্ভব বলে মনে হয়েছে।
পরদিন সকালে আমরা দু‘ভাই ও আমার ছোট ভায়রা ভাই একটা ভাড়া করা মাইক্রোবাসে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলাম। গুলশানের নিকেতন থেকে শাজাহানপুর হয়ে যাত্রাবাড়ী পার হয়ে ঢাকা শহর ছাড়তেই আমাদের তিন ঘন্টা পেরিয়ে গেল। যাত্রাবাড়ীর পর থেকেই মাওয়া ফেরী ঘাট পর্যন্ত শুধু কন্সট্রাকশন আর কনস্ট্রাকশন। অসংখ্য গাড়ি, ধুলাবালি আর গাড়ির হর্নের উৎকট আওয়াজের মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে চলছি আর রাস্তার দুপাশে দেখছি। ঢাকা থেকে চার লেনের রাস্তা,দু’পাশে সংযোগ রাস্তা ও পদ্মা সেতুর নির্মান কাজের জন্য যেন দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়েছে !! সেইসাথে রাস্তার দু’পাশে গড়ে উঠছে অসংখ্য নুতন নুতন স্থাপনা। এসব কিছু দেখছিলম্ আর ভাবছিলাম দেশের সরকার ও সাধারণ মানুষের কাছে মনে হয় টাকার অভাব নাই। আমার ভায়রা ভাই জানলো এ ধরণের আরো বেশ কিছু মেগা প্রকল্প এখন ব্যাস্তবায়নাধীন।
ফেরি ঘটে পৌঁছে আমাদের আর দেরি করা লাগল না। আমার ভায়রা ভাইয়ের এক বন্ধুর ক্ষমতার দাপটে আমরা তাৎক্ষণিক ভাবে ঘটে অপেক্ষামান একটি ভি আই পি ফেরিতে আরোহন করলাম। তিনি আমাদের ফেরির ফার্স্ট ক্লাসের ওয়েটিং রুমে বসিয়ে চায়ের ব্যবস্থা করে চলে গেলেন। ফেরি থেকে পদ্মা ব্রিজ এর নির্মাণ কাজ দেখতে দেখতে ভাবছিলাম এত বড় ও বিশাল কাজ ঠিক মত শেষ হবে কিনা। এ বিশাল কর্মকান্ডের সাথে এখন দেশের বহু লোকের ভাগ্য জড়িত। তাই মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম এ কাজ যেন সহি সালামতে সম্পন্ন হয়।
ফেরি ঘাট থেকে নেমে নুতন এপ্রোচ রোড দিয়ে যেতে যেতে মনে হল আমরা যেন বাংলাদেশ নয় , কানাডা বা বিশ্বের অন্য কোনো উন্নত দেশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের ড্রাইভার কে ‘ড্যাম কেয়ার’ স্টাইলে ১২০ কিলোমিটার স্পীডে গাড়ি চালাতে দেখে আমার এ ধারণা হয়েছিল। এপারে কয়েক কিলোমিটার রাস্তা চার লেনে নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে এবং রাস্তার কাজও খুব সুন্দর হয়েছে। দেশের যোগাযোগ ব্যাবস্থার এ সব কর্মকান্ড দেখতে দেখতে একসময় আমার গ্রামের বাড়ি পৌছালাম বিকেল চারটার সময়।
উল্লেখ্য ,গোপালগঞ্জ শহর থেকে আমার বাড়ি পর্যন্ত ৫/৬ কিলোমিটার রাস্তার দুপাশের প্রায় সব জমিই সরকার একোয়ের করেছে। এ সব জায়গায় নির্মাণাধীন রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ,কারিগরি শিক্ষা ইনস্টিটিউট,চক্ষু হাসপাতাল, ডেন্টাল কলেজ, এসেনশিয়াল ড্রাগ ফ্যাক্টরি ,পুলিশ লাইন,ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও রেলওয়ে জংশন। এছাড়া আরো রয়েছে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ,ব্যাংক ,ঘোনাপাড়া বাজারে একটি পাঁচতালা শপিং কমপ্লেক্স ও আরো কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এ সব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলির নির্মাণ কাজ শেষ দিকে। গোপালগঞ্জ থেকে তাই আমাদের বাড়ি পর্যন্ত এখন শহরের বিস্তৃতি লাভ করেছে বলা যায়।
বাড়িতে এসে প্রথম রাতে রেস্ট নিয়ে পরদিন থেকে জমিজমা ও অন্যানো ঝামেলা নিয়ে ব্যাস্ত সময় অতিবাহিত করতে শুরু করলাম । ফাঁকে ফাঁকে বিকালের দিকে ঘোনাপাড়া বাজারে যেতাম ছোট চাচাকে নিয়ে। চা এর দোকানে মানুষের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করেছি সব সময়। আর মোবাইল রিচার্জ–বিকাশ ও কম্পিউটারের দোকানও আছে অনেকগুলি। আমি দেখলাম মানুষ চা সিগারেট খেয়ে অনায়সে ২/৩ শত টাকা বিল দিচ্ছে। সকালে ও বিকালে ঘোনাপাড়া মোড়ে নিয়মিত বাজার বসে। কাঁচা বাজার ছাড়াও এখানে সব কিছু পাওয়া যায়। তাই মানুষের এখন আর গোপালগঞ্জ যাবার প্রয়োজন নাই। বাজারে মানুষের কেনা কাটার বহর দেখে আমার মনে হয়েছে আমরা কানাডা থাকলেও দেশের মানুষের তুলনায় গরিব। একটু অবস্থাপন্ন মানুষের পরিবারে দৈনিক এক হাজার টাকার বাজার করা যেন কোনো ব্যাপারই না। আমি দেশের মানুষের আর্থিক অবস্থার এ উন্নতি দেখে অবিভুত।
(ছবি: গোপালগঞ্জের ঘোনাপাড়া বাজারের বর্তমান চিত্র।)
রাস্তা ঘাট,অবকাঠামো বা মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির সাথে উন্নতি হয়েছে সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রায়। বাড়িতে ছুটা কাজ করার মানুষ এখন আর পাওয়া যায় না। আমি বাড়িতে থাকার ৭/৮ দিনের জন্য দুই হাজার টাকা দিতে চেয়েও কোনো কাজের মহিলা পাইনি। ফলে আমার বোনরা অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও বাড়ির সব কাজ নিজেরা করেছে। আমার এক বন্ধু বললো ,কোরবানির মাংস বিতরণ নিয়ে সে মহা ঝামেলায় পড়েছিল। মাংস নেয়ার লোক নাই। গভীর রাত পর্যন্ত থেকেও নিজের ইচ্ছামতো মাংস বিতরণ করতে পারে নাই। শুধু তাই নয়,সমাজের আরো নিম্নবৃত্ত যারা ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে তাদেরও জীবনযাত্রা বা কর্মকান্ডতে পরিবর্তন এসেছে। একরাতে বাজারে চা এর দোকানে বসে দেখলাম কয়েকজন অন্ধ হ্যান্ডমাইক ব্যাবহার করছে ভিক্ষা করার জন্য। এসব কিছুই আমার কাছে মানুষের সার্বিক অর্থ–সামাজিক উন্নতির সূচক বলে মনে হয়েছে।
(ছবি-ঘোনাপাড়া বাজারে হ্যান্ডমাইক সহযোগে ভিক্ষা করছে কয়েকজন অন্ধ ভিখারী।-)
এতক্ষন যাবৎ আমার নিজের এলাকায় দেখা আর্থসামাজিক অবস্থার কথা বলেছি। তবে এ সব উন্নয়ন দেশের সব জেলাতেই হয়েছে। বাড়ি থেকে ফেরার পথে খুলনা যশোর হয়ে শার্শা উপজেলায় আমার শশুর বাড়ি যাবার পথেও চারিদিকে অনেক নূতন নুতন স্থাপনা ও কর্মকান্ড লক্ষ্য করেছি। আমার বাড়ি থেকে আগে খুলনা যেতে লাগতো প্রায় দুঘন্টা ,আর এখন বিশ্ব রোড দিয়ে যেতে লাগে মাত্র ৪০ মিনিট। পথে কোনো স্থানে গাড়ি না থামিয়ে প্রায় একটানে খুলনা পর্যন্ত যাওয়া যায়। খুলনা থেকে এবার ট্রেনে যশোর গেলাম। আমার ছোট ভাই আর সব ভাই বোন ও ভাগিনা –ভগ্নিপতিদের নিয়ে একই ট্রেনে রাজশাহী যাচ্ছে। আমি দেখলাম ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর বগি আগের তুলনায় অনেক পরিচ্ছন্ন ও আরামদায়ক। এ সব ক্ষেত্রে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন প্রশংসার যোগ্য।
শার্শা ও বেনাপোলে দুদিন ছিলাম। একই অবস্থা এখানেও। অর্থাৎ বাসায় কাজ করার লোক নাই। নিম্নবৃত্ত মহিলারা অনেকেই নুতন স্থাপিত জুট মিল বা সার কারখানায় কাজ করছে। আমার শশুর বাড়ি মাসিক পাঁচ হাজার টাকা দিয়েও কোনো কাজের লোক পাওয়া যাচ্ছে না। আমার মনে হয়েছে একটি নিম্ন বৃত্ত পরিবারেরও মাসিক আয় এখন দশ হাজার টাকার উপরে। তাই মানুষ এখন আর ছুটা কাজে আসতে চায় না। এখানে একটি উদাহরণ না দিলেই নয়। আমার শশুর বাড়িতে এক লোক কাজ করতো। তার তিন ছেলে। একজন আকিজ জুটি মিলে ,একজন গাড়ির ড্রাইভার ও একজন বাজারে সবজি বিক্রি করে। তাদের মাসিক ইনকাম কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা। বাড়িতে নুতন বিল্ডিং তৈরি করেছে। তার নাতি পোতা রা স্কুল কলেজ পড়ছে। এভাবে অনেক পরিবারেই এখন আর্থিক সচ্ছলতা লক্ষ্য করেছি। এ জন্যই আমার মনে হয়েছে দেশের মানুষ এখন অনেক ভালো আছে।
(ছবি: আমার প্রিয় শার্শা পাইলট হাই স্কুল। তবে এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে আকার/আয়তনে।)
যাইহোক ,তাড়া হুড়ো করে নিজ গ্রামের বাড়ি ও শশুর বাড়ি ঘুরে ঢাকা ফিরে এলাম কানাডা ফেরার মাত্র দু’দিন আগে। সময় স্বল্পতার জন্য এবারে সচিবালয়ে আমার সহকর্মী বন্ধুদের কাছেও যেতে পারিনি। শুধু আমার শ্যালিকার বাসার কাছে বলেই রামপুরা বাংলাদেশ টেলিভিশিন ভবনে কর্মরত আমার দুই ঘনিষ্ট বন্ধুর সাথে দেখা করতে পেরেছিলাম। আর কানাডা ফেরার আগের দিন বিকালে আমার ইউনিভার্সিটির ক্লাসমেট বন্ধুদের সাথে এক বিকালে সময় কাটিয়েছি। কাওরান বাজারের কাছে বাংলাদেশ ল্যান্ড পোর্ট অথরিটির অফিসে ঘনিষ্ট বন্ধু ও চাকুরীতে ব্যাচমেট যুগ্মসচিব হাবিবের অফিসে ক্লাসমেট বন্ধুদের কয়েকজন এসেছিল আমার সাথে দেখা করতে। দীর্ঘ প্রায় ৩৪ বছর পরে আমরা এক অপরকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম।ফেসবুকের কল্যানে আমরা বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতাম। তবে সরাসরি দেখা সাক্ষাৎ হল সেই ১৯৮৫ সালের পরে। বন্ধুদের সাথে তাদের পরিবার ও দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হল। বন্ধুদের সবাই এখন নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। বন্ধুদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে , দেশের রাজনৈতিক অবস্থা যাই হোক না কেন মানুষের অর্থ-সামাজিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। দেশের মানুষ এখন অনেক ভালো আছে ।
(ছবি: ঢাকায় সহপাঠী কয়েকজন বন্ধুদের সাথে)
বিকাল সাড়ে তিনটা থেকে রাত নয়টা বাজলো তারপরও আমাদের কথা শেষ হল না। বন্ধুদের সাথে কথা বলতে বলতে কিভাবে যে সময় কেটে গেল তা বুঝতেই পারলাম না। আমার শ্যালিকার টেলিফোন পেয়ে খেয়াল হল এখন ফিরতে হবে। কানাডা ফেরার আগে ব্যাগ-লাগেজ গোছানো ও আরো কিছু কাজ আছে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বন্ধুদের সাথে আড্ডা শেষ করতে হল। বিদায়লগ্নে সবাই একে ওপরের সাথে যোগাযোগ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যার যার পথে বাসায় রওয়ানা হলাম।
১ লা ফেব্রুয়ারী বিকালে সৌদি এয়ারলাইন্স এর নির্ধারিত বিমানে ঢাকা থেকে যাত্রা করে টরন্টো ফিরে এলাম তার পরদিন। দেশের সব কিছু স্মৃতির খাতায় জমা করে কানাডার যান্ত্রিক জীবনযাত্রায় আবার নিজেকে সম্পৃক্ত করলাম।