অন্য সব দিনের মতই সেদিন খুব তাড়াহুড়ো করে অফিস যেয়ে দেখি বস সাহেবের আমার চেয়েও দেরি হচ্ছে। পাশের অফিসে উঁকি দিয়ে দেখি প্রিয় গাফ্ফার আঙ্কেল আছেন। মনে মনে খুশি হলাম, তিনিও বরাবরের মতই আমাকে মামনি ডেকে কাছে ডাকলেন এবং পরিচয় করিয়ে দিলেন পাশে বসা ফোজিত শেখ বাবুর সাথে। প্রায় দেড় মাস আগের ঘটনা কিন্তু আমি এখনও কৃতজ্ঞ আঙ্কেলের প্রতি এই পরিচয়টি এবং তার পরের দায়িত্বটি দেওয়ার জন্য। আঙ্কেল তার স্বভাবসুলভ বিনয়ী কন্ঠে অনুরোধ করলেন ফোজিত শেখ বাবুকে তার আগামী অনুষ্ঠানে সাহায্য করার জন্য। প্রসঙ্গত বলে রাখি, বাবু আমাদের বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত আলোকচিত্র সাংবাদিক যিনি দেশের নানা বিষয় তাঁর অসাধারন ছবির মাধ্যমে তুলে ধরেন।আর এবার তিনি টরন্টো এসেছেন দেশের অন্যতম সমস্যা “রহিঙ্গা” জনগোষ্ঠীর মানবেতর জীবন যাপনের উপরে একটি প্রদর্শনীর মাধ্যমে তুলে ধরতে। প্রথম বিশ্বের ব্যাস্ততম জীবনের কষাঘাতে কাবু হয়েও নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি এত মহান এক উদ্যোগের থেকে। বসের অনুমতি নিয়ে রাজি হয়ে গেলাম। আর সেই থেকেই শুরু।
পরবর্তি দেড়টা মাস প্রায় প্রতিদিনই আমার বাবুর সাথে দেখা হয় এবং আমি দেখি কি অমানসিক পরিশ্রম তিনি করে গেছেন একটি সফল চিত্রপ্রদর্শনির জন্য। এখানে বাবু সম্পর্কে একটু বলতে চাই- ফোজিত শেখ বাবু, বাংলাদেশের শ্রমজীবী শ্রেনীর মানুষ। ক্লাসরুমে নতুন বই নিয়ে পড়াশুনা করাটাও যার কাছে বিলাসিতা ছিল। রিকসাওয়ালা বাবার ছেলে হিসেবে সমাজের নিন্মবিত্ত মানুষের প্রতিনিধি আমাদের বাবু। ছোটবেলা থেকে দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করে এবং নিজের জীবনটা অর্থপূর্নভাবে কাটানোর প্রবল ইচ্ছাশক্তি তাকে ১৯৯৩ সালে একটি ক্যামেরা কেনার মত সামর্থ দান করে। তারপরে ছোট ভাই এর সাথে ২০০৭ সালে ছবি তোলার একটি ক্ষুদ্র স্টুডিও দেন। এর দুই বছরের মধ্যে ছবি তোলার শিল্পে তিনি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দক্ষতা অর্জন করেন এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি ছোট ভাইয়ের দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ে তিনি পুরোদমে ফটোসাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়ে নেন। তারপরে আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। অত্যন্ত বিনয়ী বাবু বলেন তিনি “ফটো- ব্যকরন” সম্পর্কে কিছুই জানেন না কারন তিনি কখনও ক্লাসরুমে যান নি। কিন্তু এবারের প্রদর্শনী সহ তিনি ১১ টি আলোকচিত্র প্রদর্শনী করেছেন অত্যন্ত সফলতার সাথে। আর তার ছবি ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রদর্শিত হয়। দেশের পরিবেশ, নদী, শিক্ষা ব্যবস্থা, রোহিঙ্গা সমস্যা সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে তার তোলা ছবিতে। বেশিরভাগ ছবির বিষয়ে সমাজের নিন্মবিত্ত মানুষের জীবনধারা বর্নিত হয় কারন হিসেবে হয়তো বাবুর নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা তাকে এক শক্তি যোগায়।
বাবুর মত একজন স্ব- শিক্ষিত গুনি মানুষের জীবনে অর্থের একটি নির্দিষ্ট আবেদন থাকলেও আত্মার প্রশান্তি এবং ভালো কাজের সম্পূর্নতা একটি মুখ্য ভুমিকা পালন করে। কিছু মহান বাংলাদেশ কেনেডিয়ানের সহায়তায় বাবু টরন্টোতে এসে ডাউনটাউনের মত জায়গায় চিত্রপ্রদর্শনি করতে পারলেও দুটি মাস এই বিদেশের মাটিতে তার ব্যক্তিগত চলার খরচ একেবারেই ছিল না বললেই চলে।কেবলমাত্র আমার সাথে দেখা করার জন্য তিনি প্রতিদিন প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে আসতেন। বাকি সব কাজ তো তার পরে হেঁটেই করতেন।থাকা খাওয়ার খরচ যোগাড় করার জন্য কখনও বাঙালি দোকানে মাংস কাটতেন অথবা কনস্ট্রাকসনের কাজও করতেন। তবে তিনি গাফ্ফার আঙ্কেলের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন কারন একমাত্র তিনিই মাঝে মধ্যে তাকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করেছেন। তিনি আরও কৃতজ্ঞতা জানান কমিউনিটির একাউন্টেন্ট মোহাম্মদ রোকোনুজ্জামানকে যিনি নানাবিধ উপায়ে এই প্রদর্শনিটি সফল করতে সাহায্য করেছেন।
এবারের চিত্র প্রদর্শনিটি টরোন্টের ডাউনটাউনের মেট্রো হলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি শুরু হয় গত ১৯ আগস্ট স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে তিনটায়। ভাবগম্ভীর আলোচনা সভা শেষে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক আসাদ চৌধুরী, ফিতা কেটে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন।
ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ আব্দুল গাফফারের (গাফ্ফার আঙ্কেল) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক আসাদ চৌধুরী, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন একাউন্টেন্ট রুকনুজ্জামান, সঙ্গীত শিল্পী জাহিদ হোসেন, সাহিত্যিক অনুরুদ্ধ আলম, ফটো গ্রাফার নাদিম ইকবাল। ভিডিও বার্তায় যোগ দেন প্রধান আলোচক ব্যারিস্টার ও সলিসিটর ওয়াশিম আহমেদ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন কমিউনিটির প্রিয় মুখ মম কাজী।
সভায় বক্তারা জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিয়ে মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরে যেতে সহায়তা করতে বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানান। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সবসময় বাংলাদেশের পাশে আছে কানাডা। এই বিষয়ে যত রকম সহযোগিতা প্রয়োজন তাই করবে কানাডা সরকার বলে জানান বক্তারা। তারা আরো বলেন, এই ছবির মাধ্যমে ফুটে উঠেছে রোহিঙ্গাদের দুঃখ দুর্দশার । এখনি যদি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান না করা হয় তবে ভবিষ্যতে এর খেসারত দিতে হবে পুরো বিশ্বকে। ১০ লক্ষ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ যে আশ্রয় দিয়েছে এর অর্থ এই নয় যে তাদেরকে সারা জীবন রাখতে হবে।
ফোজিত শেখ বাবু শুরুতেই ধন্যবাদ জানান বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। যিনি মমতাময়ী মায়ের মতো নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন। বাবু রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা জেনে ক্যামেরা নিয়ে ছুটে যান সেই কক্সবাজার উখিয়া, রিফুজি ক্যাম্পে। নিজের ক্যামেরায় তাদের অসংখ্য ছবি তুলেন এবং বাংলাদেশের কিছু সাংবাদিক এর থেকে কিছু ছবি সংগ্রহ করে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন।এই প্রদর্শনির ছবির মাধ্যমেই সব প্রমানিত।
ফোজিত শেখ বাবুর একটাই দাবি, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক নেতাদের হস্তক্ষেপে রোহিঙ্গাদের দ্রুত নিজ দেশে পুনর্বাসিত করা হোক। একটি জাতিগোষ্ঠীর মাঝে ক্ষুদ্র কোন জাতিসত্তা বসবাস করলে সেই জাতির প্রতি মান্বঅধিকার লুন্ঠিত হলে, সেখান থেকে জন্ম নেয় বিভিন্ন উশৃঙ্খল গ্রুপ। তাই এই রোহিঙ্গারা শুধু বাংলাদেশের হুমকি নয়। হুমকি সারা বিশ্বের জন্য।
বাবুর যাত্রা বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করার জন্য, তিনি এসেছেন পিতা-মাতাহীন শিশুদের নিজ জন্মভূমিতে ফিরিয়ে দিতে, এসেছেন গর্ভবতী শতশত অসহায় মা-বোনকে তাদের ভিটে-মাটি ফিরিয়ে দিতে। তার লক্ষ্য আলোকচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে শিক্ষিত বিবেক কে জাগ্রত করতে। তাদের নিজ দেশে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা সহকারে জাতিসংঘের সহযোগিতায় কঠোর হস্তক্ষেপ এর মাধ্যমে পূনর্বাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হোক।
ফটোগ্রাফি এবং অন্যান্য কাজে যারা সহযোগিতা করেছেন-দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার ফটো সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন জয়, দৈনিক দেশ রুপান্তর পত্রিকার ফটোসাংবাদিক হারুনুর রশিদ, ডেইলি নিউ এজ পত্রিকার ফটো সাংবাদিক মোঃ সৌরভ, বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোর অনলাইন পত্রিকার ফটো সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল মোমিন, দৈনিক বণিক বার্তা পত্রিকার ফটো সাংবাদিক ফজলে এলাহী ওমর, দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ফটো সাংবাদিক রেহানা আক্তার, দৈনিক নবচেতনা পত্রিকার ফটো সাংবাদিক বাদল দাস, স্মৃতি কালার স্টুডিও’র ভিডিও গ্রাফার আবুল হোসেন, স্মৃতি কালার স্টুডিও’র ভিডিও গ্রাফার মো: গোলাম কিবরিয়া সাইমন, অনুবাদক ওমর ফারুক জয়, অনুবাদক মোহাম্মদ তারেক, লেখক সওকত হোসেন জনী, লেখক মোহাম্মদ ফারুক হোসাইন এবং গ্রাফিক্স ডিজাইনার শোহাগ হাসান সহ অন্য সবাইকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।।
এই আলোকচিত্র প্রদর্শনিটি গত ১৯ অগাস্ট শুরু হলেও চলবে আগামী ২৩ অগাস্ট শুক্রবার পর্যন্ত। অসাধারন এই প্রদর্শনিটি উপভোগ করার জন্য বন্ধু ও পরিবার নিয়ে চলে যেতে পারেন ৫৫ জন স্ট্রিটের মেট্রো হলে- প্রতিদিন সকাল ৮.০০ টা থেকে বিকেল ৮.০০ টা পর্যন্ত চলবে। আমি যতবারই এই ছবিগুলোর মাঝখানে দাঁড়াই ততবারই বাংলাদেশি হিসেবে মনে একটা চাপা কষ্ট অনুভব করি এবং একই সাথে গর্বে মনটা ভরে ওঠে। বিদেশ বিঁভুইয়ে বসে ফেলে আসা দেশটার জন্য বড় মায়া হয়।