আমি নর্থ ইয়র্ক, টরন্টো, বাসা থেকে দুই কিলোমিটার দূরে  একটা কমিউনিটি সেন্টারে প্রায় প্রতিদিনই কিছু সময়ের জন্য যাই, সেখানে আমার বয়সী বা ছোটোবড়ো অনেকেই অবসর জীবনের কিছুটা সময় এটাসেটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে যেমন : ব্যায়াম,খেলাধুলা,প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষা   ।  প্রথমেই তাদের দেয়া ” কী ট্যাগ” দিয়ে  উপস্থিতি দেখাতে  হয়।  অফিসে  বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোক  উপস্থিতি দেখাশুনা,ও সাহায্য করে  ; আজ  একজন ইতালিয়ান  ২৭-৩০ বৎসরের মহিলা (ইমা)উপস্থিত ছিল,ও প্রায়ই এই সেন্টারে কাজ করে।  ইতালিয়ান পুরুষ ও মহিলা  বেশ লম্বা, সুদর্শন ও সুদর্শনা, আলাপী এবং কঠোর পরিশ্রমী ।  আমার ধারণা ছিল ইমা হয়তো এ দেশের স্কুলের  ১২ গ্রেড পড়াশুনা করে এখানে নিয়মিত কাজ করে। এখানে অনেকেই ইউনিভার্সিটি ডিগ্রী বা ছাত্র, পার্ট-টাইম কাজ করে কিছু পয়সা রোজগার করে  । 

অনেকেই বড়ো বড়ো ডিগ্রী নিয়ে তাদের নিজস্ব ক্ষেত্রে কাজ না পাওয়া পর্যন্ত যা পায় তা দিয়েই বেঁচে থাকতে চেষ্টা করে, তাছাড়া কাজের দক্ষতা বাড়ানো ও প্রয়োজন । এ দেশে  নিয়োগকর্তা দরখাস্তকারীর বিভিন্ন ধরণের যোগ্যতাকে প্লাস- পয়েন্ট হিসাবে দেখে।   তার কারণ হিসাবে, কর্মকর্তা কোনো লোকের  বিভিন্ন যোগ্যতাকে  কর্মঠ বা সক্রিয় হিসাবে ধরে নেয় এবং ইন্টারভিউর সময় প্রশংসা করে ।   

 এ দেশে ছেলেমেয়েরা স্কুল শেষ (১২ গ্রেড) করার পর,মাবাবার ছাতার নিচে আর থাকে না, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করে , পড়াশুনার জন্য স্টুডেন্টস লোন পাওয়া যায়, তাছাড়া ছেলেমেয়েরা উইকেন্ড বা ছুটির দিনে কাজ করে পয়সা জমায় এবং এই পয়সা  পড়া খরচ,দেশ ভ্রমণ ও জ্ঞানার্জন করে। কানাডার অনেক ছেলেমেয়ে এশিয়া,আফ্রিকা, ইউরোপ,দক্ষিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ঘুরে দেখে, ও সব দেশে ছুটির সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করিয়ে হাত খরচের পয়সা রোজগার করে এবং ঝুঁকি নিতে শিখে। এদেশে কাজের পছন্দ বলতে কিছু নেই,পয়সার জন্য যে কোনো কাজ করতে রাজি যেমন রেস্টুরেন্ট,সিকিউরিটি,বাসাবাড়ি, গাড়ি রিষ্কার করা থেকে যে কোনো ধরণের কাজ করে  পয়সা রোজগার, নিজের থাকা খাওয়া ও হাত খরচ এবং টিউশন ফি সংগ্রহ করে।  এতে মাবাবার উপর চাপ কম পড়ে, স্বাচ্ছন্দে নিজে স্বাধীন ভাবে চলতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ :আমার কিছু পরিচিত  বাংলাদেশ থেকে এক বৎসর হয়  এ দেশে পড়াশুনার জন্য এসেছ। ওরা bike কিনে অবসর সময়ে ডেলিভারির কাজ করে, থাকাখাওয়া ও টিউশন ফী নিজ কাজ থেকে সংগ্রহ করে ,  স্বাচ্ছন্দ বোধ করে।   

ইমা  সম্পর্কে বলতে গিয়ে অনেক কিছু বলে ফেললাম, ইমার বাবা পর্তুগীজ ও মা ইতালিয়ান,ইমা  জন্ম সূত্রে কানাডীয়ান, ও বিয়ে করেছে  ক্লাসমেট (রোক্কো ) ইতালিয়ান । ওর হাসব্যান্ড  একজন সরকারি চাকুরীজীবি , তাদের ছোট ছোট দুই বাচ্চা, এখনও স্কুলে যাওয়ার বয়স হয় নি। ইমা ইউনিভার্সিটি ব্যাচেলর অফ চাইল্ড এডুকেশন এবং ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি  থেকে  এডুকেশন ট্রেনিং প্রাপ্ত, বতমানে (১) পার্ট টাইম টিচার, টরন্টো বোর্ড অফ এডুকেশন এবং (২)পার্ট টাইম এই কমিউনিটি সেন্টারে কো-অর্ডিনেটর।   সে বলে তার  স্বামী শনি  ও রবি বারে  বাসায় বাচ্চাদের দেখাশুনা করে এবং সে এ সময় কাজ করে।  কথা প্রসঙ্গে সে বলে, বাচ্চাদের ডে- কেয়ার এ দেয়ার মতো আর্থিক সামর্থ নেই এবং সে চায় না পুরা সময় কাজ করে, যে পর্যন্ত না বাচ্চারা স্কুলে যায়।  ইমার পরিকল্পনা শুনে আমার বেশ ভালো লাগলো। এ দেশে ছেলেমেয়ে হলে,মাবাবাকে বাড়তি খরচ ও বাড়তি ঝুঁকি নিতে হয়। যে জন্য অনেকে একটা বাচ্চা নেয়ার পর আর ঝুঁকি নিতে চায় না। অনেক মায়েরা বিশেষ করে আমাদের দেশীয়, বাসায় নিজের এবং আরও বাহিরের বাচ্চা (Baby  sitting ) রেখে  বাড়তি পয়সা রোজগার করে সংসার খরচ করে।  আমাদের দেশে  বাসায় কাজের লোক ছাড়া ও বৃদ্ধ দাদা দাদি বাচ্চাদের baby  sitting করে।  কিন্তু এ দেশে সবাই কাজ করে এবং কারো বাসায় বাড়তি লোক থাকে না বা রাখা অনেক খরচের ব্যাপার, যা সম্ভব হয় না।

আমাদের দেশ থেকে যে সব লোক  ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে  পড়াশুনা,ইমিগ্রেশন, ভিজিটর  হিসাবে এসে রেফিউজি   দরখাস্ত করে, তাদের জন্য এখানকার জীবন কঠিন, অনেক ধরণের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়  ; তার কারণ এ দেশে প্রথম দিকে এসে থাকা এবং  রোজগারের ব্যবস্থা  করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ।   ছোটছোট বাচ্চা থাকলে তো সমস্যা আরও বেড়ে যায়, একজনকে দিনে এবং একজন রাতে কাজ করে রুটি রোজগারের ব্যবস্থা করতে ও হিমশিম  খেতে হয়।      ইমা এ দেশে জন্ম গ্রহণ করেছে, তার মাবাবা এ দেশে বহুদিন থেকে আছে , তা ছাড়া তার স্বামী এ দেশে ভালো চাকুরী করে, তথাপি তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে এ দেশে জীবন ততটা মসৃন নয়।  

খ) আমার বাসার পাশেই একটা পাবলিক লাইব্রেরি , তার সামনে দিয়েই ব্যস্ত সড়ক ( সেপার্ড এভিনিউ),২৪ ঘন্টা  দুই দিকের গাড়ি এবং বাস চলাচল করে। এই লাইব্রেরি  বাসা থেকে ৭-৮ মিনিটের হাঁটার রাস্তা।   আমি সামারে হেঁটে এবং অতি ঠান্ডা বা বরফে গাড়ি নিয়ে লাইব্রেরি পার্কিং এ রেখে  ভিতরে ঢুকে বই ও পত্র -পত্রিকা নিয়ে, গ্লাস উইন্ডোর পার্শে বসে  পড়ি এবং সময় সময় বাহিরে সড়কে যানবাহন দেখি ।মাঝে মধ্যে আমার প্রিয় টিমহর্টন্স থেকে কফি এনে ক্লান্তি দূর করি,   বিরামহীন ভাবে দুই দিক থেকে গাড়ি চলছে, আমার মতো অনেক ছাত্র/ছাত্রী বা বয়স্ক/বয়স্কা  পুরুষ,মহিলারা কেউ কম্পিউটারে বা বই অথবা পত্র-পত্রিকা নিয়ে পড়াশুনা করে।  অনেক মা ছোট ছোট বাচ্চাদের এই লাইব্রেরিতে এনে শিশু বিভাগের বই,খেলার এটাসেটা দিয়ে ব্যস্ত রাখে। 

লাইব্রেরিতে ঢুকতেই দরোজার সামনে এক ভারতীয় যুবক (সিকিউরিটি গার্ড) দাঁড়িয়ে থাকে এবং লোকদের সাহায্য করে।  দেখে উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি স্থায়ীভাবে এই কাজ করো, সে মাথা নেড়ে  জবাব  দিলো না, সপ্তাহে ৩ দিন কাজ করি । কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম তোমার নাম কি ? বলে তার নাম রতন , শুনে হাসতে হাসতে বললাম,তুমি কি ভারতীয় বা বাংলাদেশী ? সে বলে তুমি ঠিকই ধরেছো ” আমি বাংলাদেশী”। জিজ্ঞেস করলাম বাংলাদেশে কোথায় তুমি বা তোমার পিতামাতা থাকে  ?সে পরিচয় দেয়াতে খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলাম তুমি কি পড়াশুনা করো ? সে  বলে  কোনো একটা কমিউনিটি কলেজে হসপিটালিটি (আতিথেয়তা) নিয়ে দুই বৎসরের ডিপ্লোমা কোর্সের শেষ সেমিস্টারের ছাত্র। আগামী এপ্রিল ২০২৫,তার পড়াশুনা শেষ হয়ে যাবে এবং  সেমিস্টার শেষ করলেই ফুল টাইম কাজের জন্য চেষ্টা করবে।  রতনের মতো   হাজারো ছেলেমেয়ে ভারত,পাকিস্তান,বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশ থেকে এ দেশে এসে পড়াশুনা করে স্থায়ীভাবে থেকে যায় এবং দেশে রেমিট্যান্স  পাঠায়। এ দেশের জীবন কঠিন কিন্তু উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।  

সমাপ্ত

পূর্ববর্তী নিবন্ধ“জেন-জি” : এ জার্নি ফ্রম এক্স টু জেড -পর্ব ৯
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন