টরোন্টোর কোনো এক লং টার্ম কেয়ার হোম বা নার্সিং হোমে আমাকে সপ্তাহে একদিন যেতে হয় এক রেসিডেন্ট এর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে। মূল লক্ষ্য থাকে ক্লায়েন্টের কুশলাদি জানা, তাদের হয়ে কথা বলা এবং সেই সাথে সেবা সমন্বয় বিষয়ক কিছু সহায়তা প্রদান। কেন জানি না, যতটা আগ্রহ নিয়ে যাই, ফিরে আসি ঠিক ততটাই মন খারাপ করা এক অনুভূতি নিয়ে। নার্সিং হোমের সেবার মান নিয়ে মন খারাপ হয় না, মন খারাপ হয় অন্য কারণে। সেই প্রসঙ্গে যাবার আগে বলে রাখি এখানকার নার্সিং হোমগুলো পরিচালিত হয় Ministry of Health and Long-Term Care এর অর্থায়নে এবং ২০০৭ সালে প্রণীত Long-Term Care Homes Act এর অধীনে। OHIP সেবাপ্রাপ্ত, আঠারো বছর বা এর বেশি বয়স্ক অন্টারিওর যেকোনো অধিবাসী যাদের সার্বক্ষণিক নার্সিং এর প্রয়োজন হয়, তারা এই লং টার্ম কেয়ার হোমের জন্য আবেদন করতে পারেন। অনেকেই আবেদন করলেও আসলে কারা এই নার্সিং সেবা আগে পাবেন, তা নির্ধারিত হয় এখানে ব্যবহৃত Method for Assigning Priority Levels (MAPLe) নামের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। এই MAPLe Low, Mild, Moderate, High এবং Very High নামের পাঁচটি স্তর নির্ধারণ করে। যারা High বা Very High Need এর স্তরে অবস্থান করেন, তারাই অন্যদের আগে নার্সিং হোমের সেবা পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হন। জটিল শারীরিক, মানসিক অসুস্থতা বা প্রতিবন্ধিতায় প্রায় অচল এই মানুষগুলো জীবনের চাকা নুতন করে ঘুরাতে চেষ্টা করেন এই নার্সিং হোমগুলোতে। তাদের জন্য এখানে রয়েছে চব্বিশ ঘন্টা ডাক্তার, নার্স, ব্যক্তিগত সহায়তা (খাওয়ানো, গোসল করানো, টয়লেটে সহায়তা ইত্যাদি), ঔষধ, diagnostic ও therapeutic সেবা। এ ছাড়াও রয়েছে Restorative & Life Enrichment program নামে তাদেরকে বিভিন্ন কর্মকান্ডে নিয়োজিত রাখার কর্মসূচি। মোটকথা, অসুস্থ একজন মানুষের সেবাযত্ন ও প্রয়োজনীয় সব চাহিদা পূরণের পৰ্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে প্রতিটি নার্সিং হোমে। এতো কিছু থাকার পরেও অদ্ভুত এক শূন্যতা লক্ষ্য করি এখানে। নার্সিং স্টেশনের সামনে বেশিরভাগই হুইল চেয়ারে বসা এই মানুষগুলোকে দেখে মনে হয় এরা কোনো এক প্রতীক্ষায় আছেন। এই প্রতীক্ষা হয়তো আরো একটি দিন ভালোভাবে বেঁচে থাকার প্রতীক্ষা কিংবা হুমায়ুন আহমেদের “ধবল পংখী নায়ে চড়ে অচিন দেশে, অচিন কোনো গাঁয়ে যাওয়া”র প্রতীক্ষা। কাজ সেরে নার্সিং হোমের গেট পেরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবি, যে মানুষগুলো একসময় হয়তো দুর্দান্ত, ব্যস্ত জীবন কাটিয়েছেন, সেই মানুষগুলো এখন নিশ্চুপ, একাকী বসে আছেন পরপারের ডাকের অপেক্ষায়। এরা কেউই হয়তো কখনো ভাবেননি যে নার্সিং হোমে এসে তাদেরকে গাইতে হবে বেলা শেষের গান। সময় মানুষকে আসলেই কতটা অসহায় করে তুলে !
প্রতীক্ষার এই পালা শুধু নাসিং হোমের বাসিন্দাদের জন্যই নয়, জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে আমরা সবাই প্রতীক্ষায় থাকি দিন বদলের। কানাডায় কিছু মানুষকে দেখি নিয়মিত ভিত্তিতে, বিপুল আগ্রহ নিয়ে “Lotto 6/49” নামের মিলিয়ন ডলারের লটারীর টিকেট কিনেন। কেউ কেউ একজীবন কাটিয়ে দেন লটারি পেয়ে কোটিপতি হবার স্বপ্নে। দিন বদলের স্বপ্নই হয়তো বাঁচিয়ে রাখে মানুষকে, সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে একসময় মানুষ পৌঁছে যায় তার গন্তব্যে। আমাদের চারিপাশে অসংখ্য সফলতার গল্প তার প্রমান। ব্যক্তিগত স্বপ্নের সীমানা ছাড়িয়ে বৃহত্তর পরিসরে নিজের দেশকে নিয়েও প্রতীক্ষায় থাকি অনেকেই। জানি, সামাজিক ন্যায় বিচার, আইনের শাসন, প্রশাসনিক ও নাগরিক দায়বদ্ধতাবোধ – এসব ক্ষেত্রে কানাডার ধারে কাছে পৌঁছুতে চাইলেও জন্মভূমি বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হবে আরো অনেকদূর। আমূল পরিবর্তন দরকার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে, নেতৃত্ব ও সাধারণ নাগরিকদের মন ও মননে। তারপরেও স্বপ্ন দেখি একদিন জবাবদিহিতাবিহীন ক্ষমতার রাজনীতি চিরতরে বিদায় নিবে, গড়ে উঠবে দায়বদ্ধ, জনকল্যানমুখী শাসন। আইনের অপ্রতুল, অপব্যবহারের কারণে অকালে ঝরে পড়বে না আর কোনো নিরীহ প্রাণ। লোভ ও ক্ষমতার মোহ কেটে গিয়ে পূর্ণ শক্তিতে জেগে উঠবে সততা ও মানুষের বিবেক। হয়তো তা আসলেই অনেক দূরের পথ, কিংবা কে জানে হয়তোবা সেই দিন বেশি দূরে নয়। হাজার হাজার মাইল দূরে বসে আমরা প্রতীক্ষার প্রহর গুনি সেই দিনের আশায়।
সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে