বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক কারণে ১৯৭০ সালের আগে বাংলাদেশে ঘন ঘন বন্যা দেখা দিতো। একদিকে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও অসংখ্য ছোটো- বড় নদী এ দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে; অপর দিকে দক্ষিনে বিরাট বঙ্গোপসাগর, সাগর থেকে ৫ মিটারেরও কম উচ্চতা বাংলাদেশের সমতল ভূমি । অদূরে বৃহত্তর হিমালয় পর্বত,জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী বৃষ্টি হয় এবং বন্যার পানি গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনাসহ বিভিন্ন নদীর মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় যার কারণে বর্ষা মৌসুমে, এই নদীগুলির পানি প্রায়শ-ই তীর উপচে পড়ে এবং ভারী বৃষ্টিপাত প্রায়শ-ই জলাবদ্ধতা এবং বন্যার দিকে পরিচালিত করে । আমি চাঁদপুরের নিম্নাঞ্চলের মানুষ , সে যুগে বর্ষার মৌসুমে ঘর থেকে বের হতে হলেই নৌকা প্রয়োজন হতো। কিন্তু আজকাল নৌকা প্রায় দেশ থেকে উঠেই গেছে তার কারণ ভারত নদীগুলিতে বাঁধ দিয়ে পানি নিজেদের দেশে কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য ডাইভার্ট করেছে,আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন, অপর দিকে দেশে অনেক রাস্তা হয়েছে যার ফলে নৌকার প্রচলন একেবারে উঠেই গেছে।

দেশের সব কটা নদী প্রতিবেশী ভারত থেকে উৎপত্তি এবং ওই দেশ ফারাক্কার মতো বড় বড় বাঁধ দিয়ে পানি নিজেদের দেশে কৃষি আবাদ করার কারণে বাংলাদেশে শুস্ক মৌসমে পানির অভাব, এবং বর্ষার মৌসুমে বেআইনিভাবে বাঁধ ছেড়ে দিয়ে এ দেশে বন্যার সৃষ্টি করে,যেমন এইতো কয়েকদিন হলো গোমতীর বাঁধ ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশে বন্যার সৃষ্টি করেছে । এটা বাংলাদেশের জন্য একটা বিরাট সমস্যা ; একদিকে শুস্ক মৌসমে নদীগুলিতে পানি থাকেনা, অপর দিকে বর্ষার মৌসুমে দেশ পানিতে তলিয়ে যায়।

১৯৭০ এর পূর্বে নদীগুলির পানি অতিশয় স্বচ্ছ থাকতো যার ফলে দেশের লোকজন পানি ব্যবহার করতে পারতো ; আজকাল এ সব নদীর নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে এবং পানি অত্যধিক দূষিত আকার ধারণ করায় কেউ আর আগের মতো এই পানি ব্যবহার করতে পারে না। শুকনো মৌসুমে নদীগুলি শুকিয়ে যাওয়াতে অনেকে নদী বেদখল করে বাড়িঘর করে নিয়েছে এবং যে কেউ মাটি/বালি তুলে নিয়ে ব্যবহার করছে।এ যেন এক অরাজকতার দেশ, আইন কানুন বলতে কিছুই নেই।

আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৬ বৎসরের ইতিহাসে দেশে যে অরাজকতার সৃষ্টি করেছে,তার ফলে গত এক মাস (জুলাই থেকে ৫ই অগাস্ট ) ছাত্র আন্দোলনে সরকারের পতন ও প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা লুকিয়ে দেশ ত্যাগ করেন। বর্তমানে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চালু আছে । বাংলাদেশ গণতন্ত্রের নামে সৃষ্টি হলে ও গত ৫৩ বৎসরের ইতিহাসে এ দেশে গণতনতন্ত্র ফিরে আসে নি।

১৯৬৬ র দিকে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান (তখন বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয় নি ) লাহোর, পাকিস্তান সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ৬ দফা (স্বায়ত্তশাসন ) দাবির পক্ষে বক্তব্য রাখেন ; এই স্বায়ত্তশাসন এর অর্থ হলো প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় ব্যতীত বাকি সব ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানের উপর ন্যস্ত করতে হবে। এই ৬ দফার ভিত্তিতে (অনেক ঘটনার পর ) স্বাধীন বাংলাদেশ হলে ও আজ পর্যন্ত এ দেশে স্বৈরাচারী সরকার দিয়েই পরিচালনা করা হয়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে জানুয়ারী ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে এসে ক্ষমতা নেয়ার সময় সাড়ে সাত কোটি জনতা ছিল। এ সময় দেশে অভাব,খাওয়া খাদ্য, আর্থিক সংকট ছিল। নতুন দেশ, ব্যাংকে কোনো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যতীত টাকা মুদ্রণ করে দেশ পরিচালনা করা হতো। বিদেশ থেকে যা ত্রাণ সামগ্রী আনা হতো তা ও সঠিক বন্টন হতো না। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে খাওয়া খাদ্য মৌজুদ বলতে কোনো কিছুই ছিল না, এক দিকে দেশে আকাল, বিদেশ থেকে যা ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো হত,দেশের জন্য ছিল অপ্রতুল এবং শুধু শহরগুলিতে রেশনিং এর মাধ্যমে দেয়া হত, গ্রামে দেয়ার মতো অধিক পরিমান খাদ্য ছিল না যার দরুন প্রায় তিন মিলিয়ন লোক না খেয়ে মারা যায়।

১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারকে হত্যা করা :

ক ) বিতর্কিত জাতীয় রক্ষী বাহিনী ও সেনাবাহিনীতে ক্ষোভ :

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ৩০, ০০০ মুক্তিযোদ্ধা যুবককে “জাতীয় রক্ষী বাহিনী “নাম আলাদা নিয়োগ দেয় , যার ফলে রক্ষী বাহিনী দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে দেয়, এর ফলে দুই বাহিনীর সঙ্গে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বেঁধে যায়। এ ছাড়া রক্ষী বাহিনী বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত অনেক হত্যাকাণ্ডসহ নানা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে যার ফলে দেশের আইন শৃঙ্খলা বাধার সৃষ্টি হয়।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ শুরু হলে লাখ লাখ মানুষ খাবারের সন্ধানে গ্রাম থেকে রাজধানীতে ভিড় জমায় । আমার অফিসের সামনে হোটেল পূর্বাণীর ডাস্টবিন থেকে অনেক ক্ষুধার্ত লোকদের ময়লাযুক্ত উচ্ছিষ্ট (জাঙ্ক ফুড) খাবার তুলে খেতে দেখেছি , প্রতিদিন কাজের পর আমি গুলিস্তান এলাকা দিয়ে পায়ে হেঁটে বাসায় যেতাম, বহু নরকংকালের মতো জীবিত, মৃত ব্যক্তি আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের গাড়ি দিয়ে উঠিয়ে নিতে দেখেছি। সে সময় একজন পিওনের মাসিক বেতন ১০০ টাকা এবং চাউলের মন ৫০০ টাকা, মহিলারা কাপড় খরিদ করতে না পেরে পুরানো কাপড় জোড়াতালি দিয়ে পড়তো। বিদেশ থেকে আসা ত্রাণ সামগ্রী কারচুপি করে বাহিরে বিক্রি করা হতো। বিদেশে বদনাম ছড়িয়ে পড়লো যে (Bangladesh is a bottomless busket )বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন বাস্কেট হিসাবে দেখা দিয়েছে,যদি ও বঙ্গবন্ধু এর প্রতিবাদ করেছিলেন, দেশের মানুষ ওনার কথা শুনতেন না ।

বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ মিটিং এ আমি উপস্থিত ছিলাম। মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে রেসকোর্স ময়দানে তাঁর সর্বশেষ মিটিং এ বঙ্গবন্ধু দেশের দুর্ভিক্ষ , অসাধু লোকেরা জিনিসপত্র বাজার থেকে উধাও করা এবং উনি সরাসরি নিজের দলের লোকদের দায়ী করেন।এমন কি তিনি এক পর্যায়ে “লালঘোড়া দাবড়িয়ে ” দেবেন (রক্ষিবাহিনী )বলে ও হুশিয়ার করেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ এই ময়দানে উপস্থিত ছিলেন,লোকজন ভেবেছিলো উনি নতুন কিছু বলবেন, আশাবাদী কথা না শুনতে পেয়ে ময়দান থেকে আস্তে আস্তে জনগণ সরে পড়তে দেখে উনি বক্তৃতা সংক্ষেপ করেন।

বঙ্গবন্ধু জানতেন তাঁর বাসা সেনাবাহিনী আক্রমণ করতে পারে, ওনার আত্ববিশ্বাস অনেক বেশি ছিল এবং কাউকে বিশ্বাস করতেন না। তাছাড়া উনি নিজের বাড়িতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেকটা অরক্ষিত অবস্থায় থাকতেন।

বাকশাল(বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ ) গঠন:

১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহু দলীয় গণতন্ত্র বাদ দিয়ে বাকসাল(বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ ) গঠন করেন । ২২ সে জুন ১৯৭৫ তিনি প্রতিটি জেলার জন্য একজন গভর্নর ও তার অধীনে কাউন্সিল নিয়োগের উদ্যোগ নেন , ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ গভর্নরদের শপথ নেয়ার প্রস্তুতি চলছিল। ১৫ই অগাস্ট হত্যাকাণ্ড না হলে বাংলাদেশ এক দলীয় রাজনীতি চালু হতো। এ নিয়ে জনগণের মধ্যে এখন পর্যন্ত নানাহ ধরণের অসন্তোষ ও মতবাদ রয়েছে,কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে যে বঙ্গবন্ধু সারা জীবন বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন,হঠাৎ জনগণকে কোনো রকমের ব্যাখ্যা না দিয়ে এ জাতীয় পরিবর্ত্তন গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন নি।

সিরাজ সিকদারকে বিনা বিচারে হত্যা :

পশ্চিম বাংলার (ভারত) চারু মজুমদার এবং পূর্ব পাকিস্তানের সিরাজ সিকদার উভয়ই কমিউনিস্ট ভাবধারা নিয়ে রাজনীতি করতেন। সে সময় পাকিস্তানে কমিউনিস্ট ভাবধারার রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল;কাজেই পূর্ব পাকিস্তানে সিরাজ সিকদার,সর্বহারা পার্টি প্রধান ও তার সংঘটনের লোকজন লুকিয়ে রাজনীতির কাজ করতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২রা জানুয়ারী,১৯৭৫ সনে তাঁকে গ্রেফতার অবস্থায় বিনা বিচারে জাতীয় রক্ষী বাহিনী দিয়ে ক্রস ফায়ার করে হত্যা করে,এ নিয়ে দেশের জনগণ অসন্তোষ ও নিন্দার চোখে দেখে।

খালেদ মোশারেফ হত্যা এবং জিয়া ক্ষমতা দখল :

বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা যারা পরে রক্ষিবাহিনীতে যোগ দেন,এরা ছিল স্বপ্ন বিলাসী,সুবিধাবাদী ; রাতারাতি দেশের ক্ষমতা দখল করে কে কার আগে দেশের প্রধান হবে এ নিয়ে ছিল প্রতিযোগিতা। মেজর জেনারেল খালেদ মোশারেফ ও জিয়াউর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার এবং ঘনিষ্ট বন্ধু। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের হত্যাকাণ্ড ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন মোশাররফ। তবে ৭ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থানের সময় তিনি নিহত হন।

সে সময়ের কিছু ঘটনা আমার আজ ও মনে পড়ে;চিফ অব স্টাফ জিয়াউর রহমান হাউস গ্রেফতার (হাউস এররেস্টেড ) হন এবং তিনি তার পদ থেকে পদত্যাগ করান , আমরা অফিসে রেডিওর সামনে প্রতি মুহূর্তে খবর শুনছি, হঠাৎ খবরে বলা হলো যে সাধারণ সেনাবাহিনীর সদস্যরা খালেদ মোশারফকে হত্যা করে জিয়াউর রহমানকে মুক্তি দিয়েছে এবং জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নিলেন। বঙ্গভবনে সিপাহীরা আনন্দে ফাঁকা আওয়াজ করতে গিয়ে এদিক সেদিক গুলি ছোড়তেছে -আমাদের অফিসের এক কর্মচারী (ইদ্রিস)টিকাটুলি তাঁর বাসার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এর জন্য আমাদের অনেক দুঃখ হয়,তবে কে কার বিচার করে এবং অফিস থেকে চেষ্টা করে ও তাঁর পরিবারের জন্য কিছুই করা গেলো না।

জেল হত্যা  দিবস :

জেল হত্যা দিবস আওয়ামী লীগসহ বাংলাদেশের বেশ কিছু রাজনৈতিক দল কর্তৃক প্রতি বছর ৩রা নভেম্বর পালিত হয়। ১৯৭৫ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগের চারজন জাতীয় নেতাঃ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মুহাম্মদ মনসুর আলী এবং  আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি স্মরণার্থে এ দিবস পালন করা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সেনাবাহিনীর দ্বারা ধানমন্ডি তাঁর  নিজস্ব বাসভবনে সপরিবারে হত্যার পর তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক আহমেদ নিজেকে রাষ্টপতির পদে আসীন করে সামরিক শাসন জারি করেন। ২২শে আগস্ট মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকে গ্রেফতার করে পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। ২ মাস ১৯ দিন পর একই বছরের ৩ নভেম্বর গভীর রাতে সেনাসদস্যরা ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে  সেখানে বন্দি অবস্থায় থাকা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী তৎকালীন জাতীয় চার নেতাকে  গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এটা মানব ইতিহাসে জঘন্যতম অপরাধ বলে বিবেচিত হয় ; কারাগারে  বিচারে সিদ্ধান্ত নেয়া এবং বিচারাধীন আসামি নিরাপদে রাখে,এই কারাগারেই যদি আসামিদের নিঃসংশ্রভাবে  হত্যা করা হয় , তা হলে বলতে হবে এ দেশে কোনো আইনকানুন নেই, মানুষ মানবতা হারিয়ে পশুত্ত্বে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাস এই চার নেতাকে বাদ দিয়ে লিখলে তা হবে অসম্পূর্ণ।

২১শে অগাস্ট২০০৪,  আওয়ামী লীগ মিটিং,পল্টন ময়দান,ঢাকা, গ্রেনেড এটাক :

বাংলাদেশের ইতিহাসেএখন পর্যন্ত নৃশংস সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটেছে, ২১শে অগাস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা তার একটি। ঐ ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাবও ফেলেছে। ২০০৪ সালের ২১শে অগাস্ট শনিবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে জড়ো হয়েছিলেন দলের সিনিয়র নেতারা এবং অগণিত  মানুষ । দলটির প্রধান এবং তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা ছিলেন ঐ সমাবেশের প্রধান অতিথি।ঐ সমাবেশে তখন উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের তৎকালীন সদস্য  আমির হেসেন আমু এবং আরও অনেক সিনিয়র সদস্য  ।

 এক সাক্ষাৎকারে আমির হোসেন আমু বলেন, “শেখ হাসিনার  বক্তব্য শেষ হবার সাথে সাথে হঠাৎ করে বিকট শব্দ শুনলাম। প্রথমে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, এদিক-ওদিক তাকালাম। তখন চারপাশে চিৎকার শুনতে পেলাম।” ঐ গ্রেনেড হামলায় ২৪জন নিহত হয় তন্মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান সাহেবের  স্ত্রী আইভি রহমান, সিনিয়র প্রেসিডিয়াম  সদস্য এবং আরও অনেকে , তাছাড়া অনেকে আহত হয়।

কোনো সভ্য দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে এ ভাবে গ্রেনেড হামলা হয় না, আমাদের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬৫ -১৯৭১ পর্যন্ত রেসকোর্স ময়দানে ও এর চেয়ে অনেক বেশি  লোকের সভা হয়েছে এবং তখনকার দিনে  এ ধরণের কোনো আক্রমণ  হয়  নি।  কিন্তু আজকাল বাংলাদেশে ধ্বংসাত্মক  রাজনীতি চালু হয়েছে, এ থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে দেশ অনেক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।

২০০৯ পিলখানা বিডিআর হত্যা রহস্য :

বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) বিদ্রোহ, যা পিলখানা ট্র্যাজেডি নামেও পরিচিত ; ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯  ঢাকায় বার্ষিক “বিডিআর সপ্তাহ” চলাকালীন সময় শুরু হয় । খবরে  প্রকাশ বিদ্রোহের সূচনা করেছিল একদল অসন্তুষ্ট বিডিআর সৈন্য যারা তাদের কমান্ডিং অফিসারদের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল, তাদের অভিমত এই ছিল যে সেনাবাহিনী অফিসার দ্বারা বিডিআর সময় সময়  নির্যাতিত ও অপমানিত হচ্ছে। তাছাড়া চোরাচালান থেকে আরম্ভ করে সব ধরণের অপকর্মের সঙ্গে সেনা সদস্যরা জড়িত,এই অসন্তোষ বহুদিন থেকে চলে আসছিলো এবং অভিযোগ করা হলে ও তার কোনো সুবিচার করা হয় নি। এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে ৬৩ জন অফিসার প্রাণ হারায়।   বিডিআর জোয়ানরা বর্ডারে অধিক পরিশ্রম করে,সে হিসাবে তাদের কোনো সুযোগ সুবিধা দেয়া হয় না। বিডিআর সপ্তাহ শুরু হলে এ নিয়ে আলোচনা ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়।  এক পর্যায়ে বিডিআর সেনারা গোলাবারুদ রাখা স্টোর থেকে  বিভিন্ন ধরণের রাইফেল ও মেশিন গান এবং অন্যান্য ধরণের অস্ত্র নিয়ে অফিসারদের হত্যা করা শুরু করে।

 সরকার পূর্ব থেকে ওদের দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনা করে একটা সমঝোতায় আসা দরকার ছিল , এতে এতগুলি লোক প্রাণ হারাতো না এবং তাদের পরিবার ও নির্যাতনের শিকার হতো না।  অনেকে অভিযোগ করেছে যে সেনা অফিসারগণ এ সব ছোটোখাটো খেটেখাওয়া লোকদের কোনো মূল্যায়ন করতো না।

২০১৩ সনের ৫-৬ মে, শাফলা চত্বর, ঢাকা;রাতের অন্ধকারে  হেফাজত আক্রমণ  ও হত্যা এক জগন্যতম অপরাধ  :

মতিঝিল,ঢাকা শাপলা চত্ত্বরের  বিক্ষোভ যা নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা অপারেশন শাপলা বা অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট নামেও পরিচিত ; ৫ এবং ৬ মে ২০১৩ তারিখে সংঘটিত বিক্ষোভ এবং পরবর্তী গোলাগুলির ঘটনাকে বোঝায়। হেফাজতে ইসলাম তাদের দাবি নিয়ে ৫ই মে ঢাকা শহরে প্রতিবাদ  করে এবং রাতে শাপলা চত্বরের চারিদিকে অবস্থান নেয়। রাত আনুমানিক দুইটার দিকে দুই দিক থেকে ( টিকাটুলি ও নোটরেডম কলেজ এলাকা) পুলিশ ও রেব শহরের রাস্তার বৈদ্যুতিক লাইন বিচ্ছিন্ন করে অন্ধকারে গোলাগুলি করে এবং লোকদের পিটিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করে।  এতে কত লোক মারা গিয়েছে বা আহত হয়েছে তার হিসাব সরকার অথবা কেউ সঠিকভাবে দিতে পারে নি।  কোনো সভ্য দেশে রাতের অন্ধকারে এ জাতীয় ঘটনা কোনোদিন হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই।  বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের আমলে গত ১৫ বৎসরের ইতিহাসে এ জাতীয় অনেক ঘটনা ও হয়েছে।

হিন্দু-মুসলিম ভ্রাতৃত্ব  :

এটা কখন ও হেলথি সাজেশন নয় যে কোনো সংখ্যালঘু লোকের সম্পদ, মন্দির ভেঙ্গে  দেয়া বা  সংঘাত সৃষ্টি করা। আমাদের দেশ  ধর্ম নিরপেক্ষ , এখানে জন্মগত সূত্রে সব মানুষের সমান অধিকার রয়েছে।কে সংখ্যাগরিষ্ঠ  বা কে সংখ্যালঘু  এটা বড় কথা নয়,প্রতিটি  মানুষ নির্ভীক ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে  বুধবার ১৮ই মে,২০২৪  শিকাগো,আমেরিকা  ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশনের মাত্র কয়েক ব্লক আগে ইহুদি ও হিন্দু মিলে এক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং  ঘৃণা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য বাংলাদেশের ইহুদি কর্মী ও হিন্দুদের  উৎসাহ দেয় । অনেক সময়   কারও কারও মুখে শুনা যায় ভারতে মুসলমানদের বাবার মসজিদ ভেঙে দিয়ে হিন্দু মন্দির তৈরী করা হয়েছে, ভারতে মুসলমানরা নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে।  ভারতে নিন্দনীয় কাজ হলে আমাদের ও কি তাই করতে হবে ? আমরা বরং ভারতকে প্রমান করবো যে আমরা সবার প্রতি উদার নীতি অবলম্বন করি।

নিজেদে মধ্যে একতা থাকলে এ দেশ এগিয়ে যাবে নতুবা ভাই ভাই রেষারেষিতে দেশে  অশান্তি এবং ব্যবসা  বাণিজ্যে ক্ষতি, নানাহ দিক থেকে পিছিয়ে যাবে ।  দেশে ছাত্র সংগ্রামের সঙ্গে জনতার সমর্থন ছিল,না হলে এত দ্রুত ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন  হতো না।  কিন্তু কিছু বিষয় অতীব দুঃখের সঙ্গে জানাতে হয় যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা নিয়েছে মাত্র কয়েকদিন ; এরই মধ্যে আনসার সচিবালয় আক্রমণ করেছে, বিভিন্ন গোষ্ঠী দাবি দাওয়া নিয়ে হাজির হয়েছে। বিএনপি মাঠে নেমেছে এবং নির্বাচন দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে।  অন্তর্বর্তীকালীন সরকার  অতীতের দুর্নীতির ফাঁকফোকর খুঁজে বের করতে চেষ্টা করতেছে  ।  কাজেই দেশের দুর্নীতি যথা ব্যাঙ্কিং অনিয়ম,মানি লন্ডারিং,গণতন্ত্র হীনতা এবং স্বৈরাচারী সরকারের নানাবিধ কার্যকলাপ পুঙ্খানো পুংখরূপে দেখে গণতন্ত্রতো প্রতিষ্ঠা সময় স্বাপেক্ষ। জাতিকে ধর্য্য নিয়ে বর্তমান সরকাকে সমর্থন ও সাহায্য করা সমীচীন বলে মনে করি।

দেশের তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগানো :

চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে ২৬ লাখে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষিত ছেলেমেয়ে স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশুনা করে বেকার ঘুরাঘোরি করে এবং মাবাবার উপর বোঝা  হিসাবে দেখা দেয়।এই যে গত মাসে ছাত্র আন্দোলন হয়ে গেলো,এটা তারই একটা মূল কারণ।  মাবাবা টাকা পয়সা খরচ করে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করিয়ে শেষ পর্যন্ত জমিজমা বিক্রি করে বিদেশে পাঠায়।  অথচ এই দেশে প্রতিবেশী ভারত থেকে লক্ষ লক্ষ লোক  এনে কাজ করায় , এটা দুঃখজনক।  আমাদের ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণের জন্য যদি প্রশিক্ষক নিয়োগ করা হতো , তাতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অপচয় হতো না, নিজেদের ছেলেমেয়েরা প্রশিক্ষণ পেয়ে কাজ করা এবং অন্যদের সাহায্য করার সুবিধা পেতো।

উপসংহার :

কানাডার ১০টি প্রভিন্স ও টেরিটোরির মধ্যে অন্টারিও একটি; একমাত্র  অন্টারিও প্রদেশের এরিয়া ৩,৫৪,৩৪২ বর্গ মাইল,যার লোক সংখ্যা ১৫ মিলিয়ন বা দেড় কোটি ; বাংলাদেশের এরিয়া   ৫৭,৩২০ বর্গ মাইল এবং লোক সংখ্যা ১৭০ মিলিয়ন বা ১৭ কোটি। গড়ে কানাডার প্রতি বর্গ মাইলে  ৪২ জন  এবং বাংলাদেশে প্রতি বর্গমাইল ২,৯৬৫ জন লোক বাস করে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের আয়তন প্রায় ১২৫ বর্গমাইল (৩২৫ বর্গকিলোমিটার)। এটি দেশের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর, প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৩,২৩৪ জনেরও বেশি লোক রয়েছে।  ৫৩ বৎসর পূর্বে(১৯৭০ )  পূর্ব পাকিস্তানের লোক সংখ্যা ছিল ৭৫ মিলিয়ন বা সাড়ে সাত কোটি এবং বর্তমানে এই লোকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭০ মিলিওনে বা সতেরো কোটি ।  বাংলাদেশ পৃথিবীর একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ ; এই  দেশের জনসংখ্যার  শতকরা ৭০ জন লোক এখন ও কৃষির উপর নির্ভর করে।

কাজেই দেশের সমস্যাগুলি প্রতি মানুষকে উপলব্ধি করা এবং সে ভাবে ধর্য্য ধরে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়া সরকার ও জনগণের  দায়িত্ব। মিছিল,ঘেরাও, জ্বালাও -পোড়াও নীতিতে দেশের ক্ষতি এবং বিদেশে এর  প্রতিচ্ছবি  বা ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, তার ফলে বিদেশী বিনিয়োগ বাধাপ্রাপ্ত হয়।

সমাপ্ত

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধকানাডার শিশু
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষকের মর্যাদা
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

১ মন্তব্য

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন