১
তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই চরম অর্থনৈতিক সমস্যা,অতিমাত্রায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নিরক্ষরতা , স্বাস্থ্যসেবার অভাব,বেকার সমস্যা , আর্থিক মন্দা এবং জনসংখ্যার অধিকাংশই দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে।
অধিকাংশ অনুন্নত দেশে দারিদ্র্যের হার সর্বোচ্চ, গুরুতর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং উল্লেখযোগ্য মানবিক ও উন্নয়নমূলক সহায়তার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।তাছাড়া এ সব দেশে ধনী ও গরিবের ব্যাবধান ধরাছোয়ার বাইরে ;গরিব দুবেলা খেতে পায় না, তাদের নিকট ভোটের মর্যাদা কি-ই বা থাকতে পারে। এ সব দেশে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব,যার কারণে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা দিয়ে দেশ শাসনের নামে শোষণ করার প্রবৃত্তি দেখা যায় । দেশ পরিচালনার জন্য উন্নত দেশ বা বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিভিন্ন সংস্থা থেকে বা বিদেশী সাহায্য পাওয়া গেলে ও তলাবিহীন ঝুড়ির মতো কোথায় চলে যায় বা সঠিক ব্যবহার হয় না। এক দলীয় শাসন ব্যবস্থার দরুন গরিবদের মূল্য দেয়া হয় না- জবাবদিহিতার অভাব থাকায় ভালো কোনো কাজ হয় না বা হলেও এক দল অফিস এবং প্রতিপক্ষ রাস্তায় মিছিল, জ্বালাও পোড়াও নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
পৃথিবীর কোথায় ও কি শান্তি আছে ? আসলে মানুষ শান্তিতে থাকতে চায় না , দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার সব সময় ছিল এবং আজও আছে।এই অহংকার,এক ব্যক্তি থেকে অপর ব্যক্তি বা এক রাষ্ট্র থেকে অপর রাষ্ট্র; সবাই সৃষ্টিকর্তাকে মুখে বিশ্বাস করে , কাজেকর্মে তা মানে না। ২
আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অনেকেই তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংঘাতময় ইতিহাস সঠিক ভাবে জানে না বা মুখে মুখে যে ইতিহাস জানে তা অনেক সময় সঠিক না। বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে হলে পাকিস্তানের জন্ম লগ্ন থেকে বাঙ্গালীদের করুন সংগ্রামের ইতিহাস জানা দরকার। আমাদের অনেকেই পাকিস্তানের বিভিন্ন গঠনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত। আমি ১৯৭০-১৯৭১ সনে পশ্চিম পাকিস্তানের আটকে পড়া বাঙ্গালীদের একজন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং নাইজেরিয়ায় চাকুরীকালীন সময়ের স্বৈরশাসনের রূপ দেখেছি ; স্বৈরতন্ত্র শাসন ব্যবস্থা কোনো দেশেই বেশিদিন টিকে থাকে না বা টিকে থাকলেও শেষ ফলাফল ভালো হয় না।
অনেক দেশে সরাসরি সামরিক শাসন না থাকলেও, অগণতান্ত্রিক -ভাবে নির্বাচিত সরকার সামরিক একনায়কদের মতোই আচরণ করে ; তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির দিকে তাকালে এর প্রমান পাওয়া যাবে। যেমন সিরিয়া সামরিক শাসন ব্যবস্থা চালু না থাকলে ও প্রেসিডেন্ট “বাসার আসাদ ” গত ২৩ বৎসর স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা দিয়ে দেশকে চালিয়ে আসছেন এবং এই দেশে বহুদিন থেকে গৃহ যুদ্ধ লেগে আছে,দেশটির দুই অংশ মূলত সরকার ও বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে। লিবিয়ার গাদ্দাফি আর এক স্বৈরতান্ত্রিক শাসক চলে গেলে ও এই দেশে এখনও গৃহ যুদ্ধ এবং দেশের দুই অংশ দুই সরকার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান ১৯৫৮ সনে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে,রাতারাতি লন্ডনে পাঠিয়ে দিয়ে এক অভিনব কায়দায় ১০ বৎসর দেশ পরিচালনা করেন। স্বৈরাচারী সরকার অলৌকিক ভাবে ক্ষমতায় এসে দেশের জন্য অনেক কিছু করে ফেলবে অঙ্গীকার করলে ও তার দীর্ঘস্থায়ী ফলাফল দেশের জন্য ভালো হয় নি ।
ভারত ও পাকিস্তান আলাদা হওয়ার পর, ভারতের প্রধান মন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও তাঁর সরকার এক বৎসরের মধ্যে দেশ ও জাতির জন্য ” ধর্মনিরপেক্ষ ” সংবিধান তৈরী করে উপহার দেন । তা ছাড়া “নেহেরু” এক ব্যক্তি ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ (মৃত্যু) পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। অপর দিকে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে ১৯৭০ সনের নির্বাচনের সময় পর্যন্ত দেশে কোনো রাষ্ট্রীয় গঠনতন্ত্র ছিল না । দেশের লোকসংখ্যার ৫৬% তৎকালী পূর্ব বাংলা ও ৪৪% পশ্চিম পাকিস্তানে; পূর্ব বাংলার লোকদের হাতে ক্ষমতা দেবে নির্বাচনের মাধ্যমে,এটা কি করে সম্ভব ? পাকিস্তানী শাসকগুষ্ঠি তা কোনো দিন ভাবতে ও পারে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রথম থেকেই মূল সমস্যা পূর্ব বাংলা/পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক আধিপত্য নিয়ে।
উর্দু ভাষা সে তো আর এক সমস্যা ; ৭% লোক যারা ভারত থেকে পাকিস্তানে অভিবাসন বা মাইগ্রেট করেছে , তাদের ভাষা। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন পাঞ্জাব, সিন্দু ,বালুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের নিজ নিজ ভাষা যথা পাঞ্জাবি,সিন্দি,পস্তু ও অন্যান্য ভাষার লোক বাস করে; অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র ভাষা বাংলা। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত,(হিন্দু সংখ্যা লঘু সদস্য) ১৯৪৮ সনে করাচিতে জাতীয় সংসদে বাংলা ভাষাকে সংখ্যা গরিষ্ঠ জাতির ভাষা হিসাবে মর্যাদা দেয়ার জন্য অতি সাহস করে বিল উত্থাপন করেন , তিনি এর জন্য সমালোচনার সম্মুখীন হন। ১৯৫২ সনের ২১ সে ফেব্রুয়ারী ভাষা আন্দোলন ও শহীদদের রক্তে রাঙ্গানো ঢাকা শহর, ইতিহাস আজ ও স্বাক্ষি দিচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ২৫সে মার্চ ১৯৭১ গ্রেফতার করার তিনদিন পর ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তাঁর ছেলে দিলীপ কুমার দত্ত সহ কুমিল্লার নিজের বাসা থেকে রাতের অন্ধকারে সেনাবাহিনীর লোকেরা উঠিয়ে নিয়ে ( ২৯সে মার্চ ১৯৭১)ময়মনামতি সেনা নিবাসে অত্যাচার করে শহীদ করে। তাঁর অপরাধ কি ছিল ? বাঙ্গালীদের জন্য বাংলা ভাষা দাবি করা।
পূর্ব পাকিস্তানের পাট রফতানিকৃত বৈদেশিক মুদ্রার অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানের নতুন রাজধানী ইসলামাদ নির্মাণ কাজ ও বিভিন্ন খাতে খরচ করা হতো।বাজেটে যে অর্থ পূর্ব পাকিস্তানে সড়ক পরিবহনের উন্নয়নের খাতে বরাদ্দ হতো , বর্ষার মৌসুমে পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তর করে খরচ করা হতো, বিনিময়ে বিদেশী সাহায্য “জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি (FAO )”যথা চাল, চিনি ও সস্তা দরের কাপড় শ্রমিকদের কাজের বিনিময়ে দেয়া হতো- তাও কেউ পেতো এবং কেউ পেতো না। আমার ছোট সময়ের কিছু স্মৃতি থেকে বলছি,সে সময় গ্রামের শ্রমিকদের দিয়ে খাল খনন করে রাস্তা মেরামত করা হতো বিদেশী রেশনিংয়ের বিনিময়ে। সে এক করুন কাহিনী, যারা কাজ করতো, প্রতি মাসে একবার ইউনিয়ন পরিষদের অফিস থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে মোটা চাল, চিনি,গম পেতো, তাও পর্যাপ্ত পরিমান নয়। কখনও এক মাস একটানা কাজ করলে গরিব মেয়ে মানুষের জন্য একটা সাদা যেনতেন শাড়ি পাওয়া যেত।
পাকিস্তানী শাসক চক্রের মনোভাব কখনই পূর্ব পাকিস্তানের আধিপত্য মেনে নেয়ার অনুকূলে ছিল না। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী মোহাম্মদ আলী ( বগুড়া) প্রস্তাব করেছিলেন রাষ্ট্রীয় জনগণের প্রতিনিধি (সংসদ সদস্য ) জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গ (পূর্ব পাকিস্তান ) ১৬৫ এবং পশ্চিম পাকিস্তান ১৩৫ = ৩০০ আসন হবে বলে দাবি করে ছিলেন । এ নিয়ে ও অনেক সমালোচনা হয়ে ছিল যার ফলে তাঁকে প্রধান মন্ত্রী থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। একমাত্র আবদুল মোনেম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর যিনি ১৯৬২ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘতম সময় ক্ষমতায় ছিলেন ; তাঁকে রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের “ইয়েস ম্যান” বলা হতো । এখানে বলে রাখা দরকার যে ১৯৫৫ সনে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান রাখা হয়।
আইয়ুব খান ১৯৬২ সালে তাঁর সুবিধার্থে মৌলিক গণতন্ত্র ” রাষ্ট্রপতি “সংবিধান প্রণয়ন করেন। এই সংবিধানের মাধ্যমে ১৯৬৫ সালের ২রা জানুয়ারি পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সারা দেশে ৮০,০০০ মৌলিক গণতান্ত্রিক ‘বেসিক ডেমোক্র্যাটস’-এর মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৪০,০০০ এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৪০,০০০ ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ও চেয়ারম্যান মৌলিক গণতন্ত্রীরা শহুরে এবং আঞ্চলিক কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। দুই অংশ থেকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে না হয়ে সমান সংখ্যক সদস্য ভোট দেয়া নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে তুমুল ঝড় উঠেছিল; মি: আলতাফ গওহর, মৌলিক গণতন্ত্র প্রণেতা, যিনি আইয়ুব খানের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং তাঁর সামরিক শাসনের সময় গণতন্ত্র বিরোধী পদক্ষেপের প্রবর্তক এবং বাস্তবায়নকারী ছিলেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন দিয়েছিলেন ।তাছাড়া এটাই একমাত্র জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানে ১৬২ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮ সিট বন্টন করে (১৬২+১৩৮ ) = ৩০০ আসনে নির্বাচন হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ধারণা করতে পারেনি যে পূর্ব পাকিস্তানে নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ পাশ করবে। সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বেকায়দায় পড়ে যায় এবং ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সনের রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত জনগণের উপর সেনা হত্যাযজ্ঞ চালায়।
পাকিস্তানের জন্মলগ্ন ১৪ই অগাস্ট ১৯৪৭ থেকে ২৭ই অক্টোবর ১৯৫৮ (১০ বৎসরে ) ৪ জন গভর্নর জেনারেল ও ৬ জন প্রধান মন্ত্রী নিয়ে দেশ পরিচালনা করেন এবং এরা হলেন:
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (গভর্নর জেনারেল) : এক বৎসর এক মাস ক্ষমতায় থাকার পর স্বাস্থগত কারণে (১১– ৯-১৯৪৮ মৃত্যুবরণ করেন ); ১৯৫৮ সনে জেনারেল আয়ুব খান ক্ষমতা নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন সময় খাজা নাজিমুদ্দিন, গোলাম মোহাম্মদ ও মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা গভর্নর জেনারেল হিসাবে কর্তব্য পালন করেন। এদের কেউ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়েন নি ; বরং জোরপূর্বক ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। এই ১০ বৎসরে যে সব প্রধান মন্ত্রী দেশের দায়িত্বে ছিলেন :
একমাত্র লিয়াকত আলী খান (প্রধান মন্ত্রী) ৪ বৎসর ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁকে কেন প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেছিল তা জানা যায় নি । পরবর্তীতে মোহাম্মদ আলী বগুড়া (দুই বৎসর),চৌধুরী মোহাম্মদ আলী (এক বৎসর),হোসেন শহীদ সারওয়ার্দী (এক বৎসর ) ,ইব্রাহিম ইসমাইল চন্দ্রিগার (দুই মাস) ও ফিরোজ খান নূন ( দশ মাস ) ক্ষমতায় ছিলেন। এ অবস্থা দেখে বুঝা যায় যে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানে নেতৃত্বের কোন্দল , ক্ষমতার লোভ ও একের প্রতি অন্যের বিশ্বস্ততার অভাব ছিল।
যদি ও পাকিস্তানের ইতিহাসে (১৯৪৭-১৯৫৬) লিখিত সংবিধান ছাড়াই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে । তথাপি নয় বছরের প্রচেষ্টার পর পাকিস্তান ১৯৫৬ সনে একটি সংবিধান প্রণয়ন করেছিল । পূর্ব পাকিস্তান এই সংবিধানের সাথে একমত ছিল না ; তাও দুই বৎসর পর আয়ুব খান ১৯৫৮ সনে এই সংবিধান বাতিল করে সামরিক শাসন জারি করেন।
চলবে :