ঠিক এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমি ‘আমি’ হয়ে উঠলাম। আমিও ‘একজন’ হলাম। আমি এখন দেখতে ও শুনতে পাচ্ছি। অতঃপর আমার চেতনা, আমার ইন্দ্রিয় আমার বোধ জেগে উঠছে। আলো ও শব্দ দুটোই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। আমার ইন্দ্রিয় কোথায়? আলো কিভাবে দেখছি? শব্দই বা কিভাবে শুনছি? ধীরে ধীরে আমার চারপাশ আমি দেখতে পাচ্ছি। শুনতে পাচ্ছি। ঘ্রান পাচ্ছি। আমার আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই তারপরও আমার সকল ইন্দ্রিয় কাজ করছে। কিভাবে করছে আমি জানিনা। কেউ একজন আমাকে কিছু দেখাতে চাইছে, শোনাতে চাইছে। আমি বুঝতে পারছি কে যেন আমায় ডাকছে। অকল্পনীয় অসীম দূরত্বের ওপার থেকে কে যেন আমায় ডাকছে, কে যেন আমায় গভীরভাবে টানছে, তার সেই ডাকে সেই টানে আমি জেগে উঠছি, আমাকে জাগানো হচ্ছে। এবং আমাকে তাঁর কাছে পাঠানো হচ্ছে।
এইতো! ভোজবাজির মত আমি এখন দেখতে পাচ্ছি সেই অপুর্ব জগত। জগতের পার্থিব যা কিছু সব। আহা এজগতের সবই বড় মনোরম বড় চিত্তাকর্ষক। দেখতে খুব ভাল লাগছে, মনে আনন্দ পাচ্ছি। এখন এখানে রাত। আকাশের বুকে কত তারা। নির্মেঘ তারাজ্বলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। শহরের রাস্তায় আলো জলছে। রাস্তার পাশে বিভিন্ন ধরনের গাছ গাছালি। ব্যস্ত রাস্তায় জীবন যেন টগবগ করছে! কত যে মানুষ আর কত যে যানবাহন! যার আকুল ডাকে যার নিঃশব্দ তীব্র আকর্ষনে আমি এই জগতে এসেছি, আমি তার কাছাকাছি এসে গেছি। চমৎকার গাছাগাছালি ঘেরা একটি বাড়ি। সামনে টুকরোখানেক ফুলের বাগান। গেটের চারপাশ নীল অপরাজিতার লতায় মোড়ানো। নীল নীল ফুল ফুটে আছে। বাড়ীতে প্রবেশের জন্য সিঁড়ি বা লিফট তো নিষ্প্রয়োজন। এইত! এখন আমি তাকেও দেখতে পাচ্ছি। সুন্দর ছোট্ট বাড়িটির এক রুমে তিনি বসে আছেন। আমি তাঁর খুব কাছে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে আছি। যদি আমার বেলায় দাঁড়ানো শব্দটি ব্যবহার করা যায়! পাশের রুম থেকে একটা গলা খাঁকারির শব্দে দাঁড়ানো আমি কিছুটা চমকে উঠলাম। ছলকে গেল আমার অস্তিত্ব।
তিনি চেয়ারে বসে আছেন। শান্ত, স্থির, অচঞ্চল। বাইরেটাই কেবল শান্ত, কিন্তু ভেতরটা তার দুঃখে কষ্টে ক্ষোভে চুরচুর হয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, গভীর মর্মবেদনায় তিনি মুষড়ে আছেন। চেয়ারের পেছনে আমি। উনার সামনে একটি ল্যাপটপ। তিনি সেখানে কিছু লিখছেন। আশ্চার্য আমি তার লেখা পড়তেও পারছি। তিনি লিখছেন–
“প্রিয় সন্তান আমার, তুমি কোথায় কেমন আছ? যেখানে আছ, সেটি কি এই পৃথিবীর মত কোন জায়গা! সেখানে তুমি কি মানুষের মত শরীর পেয়েছ? তুমি কি বড় হয়েছ? নাকি তুমি কোথাও ঐশ্বরিক কাননে ফুল হয়ে ফুটে আছ! তোমাকে আমি এই অপরূপ জগতের আলো বাতাসে আনতে পারিনি। আনা সম্ভব হয়নি। নির্মমভাবে তোমাকে পথ থেকেই ফিরিয়ে দিয়েছি। আমার এই অক্ষমতাকে ক্ষমা কর। ক্ষমা কর বাবা ক্ষমা কর। হ্যাঁ, আমি তোমাকে বাবাই বলছি আমি মা আমি আমার সকল হিসেব নিকেশ, বোধ বুদ্ধি, আমার সকল ইন্দ্রিয় দিয়ে জানি তুনি আমার পুত্র ছিলে। বাবা, আমি কি তোমাকে কোনোদিন দেখতে পাবনা! কোনোদিন না! একটিবারের জন্যও না! আমি জানি এ জগতে আর সম্ভব নয় কিন্তু আর কোন জগতে, অন্যকোনভাবে, অন্য কোন গ্যালাক্সিতে আমি তোমাকে দেখতে চাই। তোমাকে আদর করতে চাই! তোমার মা হতে চাই। প্রায় প্রতি রাতে স্বপ্নে যে শিশুটিকে দেখতে পাই সেকি তুমি!
প্রিয় বাবা আমার, তুমি কি আমার উপর অভিমান করেছ? রাগ করেছ? অভিমান তো হবারই কথা! মা হয়েও আমি তোমায় এই পৃথিবীতে আসতে দেইনি। অপরূপ পৃথিবীর আলো বাতাসে বেড়ে উঠার সুযোগ দেইনি। মা কি এমন কাজ করতে পারে! সেকি তবে মা! তোমাকে আসতে দিতে পারিনি এ দুঃখ আমার আমরণ যাবেনা তারপরও আবার বলছি আমার এই অক্ষমতাকে ক্ষমা কর তুমি। তখন যদি আমি এখনকার মত পরিপক্ক থাকতাম, অতটা ভীতু না হতাম তাহলে এমন হতনা, কিছুতেই না। যে কটা মাস তুমি আমার শরীরের ভেতরে আমার অংশ হয়ে ছিলে, আমার গর্ভে ছিলে তখন আমি একজন আনন্দিত ও সুখী মানুষ ছিলাম। আমার সোনা বাবা!!
তাঁর চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু ধারা নেমে যাচ্ছে। কান্নার দমকে তাঁর শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। একসময় তাঁর হেঁচকি উঠতে লাগল। আহারে! তিনি কী ব্যাকুল হয়ে সন্তানের জন্য কাঁদছেন। আমার চেতনা আছে কিন্তু চেতনা ব্যবহারের শক্তি কি আমার আছে! আমি চুপ করে থাকার চেষ্টা করেও পারলামনা। তাঁর এমন বাধভাঙ্গা কান্না সহ্য করা সম্ভব নয়। তাঁর মর্মান্তিক বেদনাবোধ আমাকে এক ভয়াবহ শুন্যতার উপর স্থাপিত করে দিল। আমি ডেকে উঠলাম- “মা”! … মা শুনতে পেলেননা। আমি আবার ডাকলাম- “মা”। মা শুনতে পেলেননা। তারপরও আমি আবার বললাম- ‘মা’ তুমি এভাবে কেদনা, এভাবে ক্ষমা চেওনা, আজ আমি সব জানি, আমি সব বুঝতে পারছি। তোমার তো কিছু করার ছিল না মা। কেন নিজেকে অপরাধী ভাবছ? আমাকে ডেকে ডেকে আমাকে ভেবে ভেবে আমার মা কেঁদেই যাচ্ছেন। আর নিরুপায় আমি মায়ের কান্না দেখছি…
এমন সময় আধুনিক প্রযুক্তির ছোট্টবাক্সে কে যেন তাকে লিখল-
– তুমি কেমন আছ? কি কর? আর সব খবর কি? চোখের জলে ভাসতে ভাসতে মা উত্তরে লিখল
-আমি ভালো আছি। সব খবর ভালো… মুহুর্তেই আমি বুঝলাম কে জিজ্ঞেশ করছে এবং আমি তাকে দেখতেও পাচ্ছি। আশ্চার্য্য একই সঙ্গে আমি দুজনকে দেখতে পাচ্ছি। আমার চেতনা থরথর করে কেঁপে উঠল, আমার অন্তরাত্মা হাহাকার উঠল, হাহাকার করে উঠল এই পৃথিবীর জন্য যতটা না, তার চেয়ে বেশি এইযে আমার মা আমার বোনের পাশে থাকতে না পারার জন্য, মা বোনের ভালোবাসায় মাখামাখি হতে না পারার জন্য। হায়! আমার মা আমার আপু! ভীষণ ভাবে বলতে ইচ্ছে করল-
-আপু, মা ভাল নেই। মা ঠিক কথা বলছেনা। তুমি তো মাকে দেখতে পাচ্ছনা! মা চোখের জলে ভাসতে ভাসতে ভালো আছি বলছে। তোমাদের যোগাযোগের এই মাধ্যম তো বেশ অভিনব। একজন ভালো না থেকেও অবলীলায় বলতে পারে ভালো আছি। বোঝার কোন উপায় নেই! মা ভালো নেই আপু! মা ভালো নেই! তুমি মার কাছে এসো বা মাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও…
আরো বেশ কিছুক্ষণ আমি মা এবং আমার আপুর লিখে লিখে আলাপচারিতা দেখলাম। মার জন্য আমার অসম্ভব কষ্ট হতে লাগল। আমার ইচ্ছে করতে লাগল আমি মায়ের চোখ মুছিয়ে দেই, মায়ের কল্পনার মত, মায়ের স্বপ্নের মত মায়ের মস্তিষ্ক কোষের ছবির মত দিব্যকান্তি, আত্মপ্রত্যয়ী, অকুতোভয় এক তরুণ সন্তান হয়ে প্রিয় মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে বলি-
-“মা, একদম কাঁদবে না, একদম কষ্ট পাবেনা। তাকাও, দেখ, এই যে আমি আছি! তোমার এত কষ্ট পাওয়ার কোন কারন নেই! কেন তুমি কাঁদ! কেন এত কেঁদে কেঁদে নিজেকে নিঃশেষ কর”! কিন্তু হায়! আমার কোন ক্ষমতা নেই! মায়ের পাশে দাঁড়াবার মতো জাগতিক কোন ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয়নি! আফসোস!
চারিদিকে তাকিয়ে দেখি কী চমৎকার রুচিসম্মত একটি রুম। যার চারপাশে কেবল বই আর বই আর এখানে ওখানে ছোট ছোট পাত্রে ঝোপালো গাছ। সেগুলি কী সতেজ! সুন্দর! একপাশে দেয়ালে একটি বালিকা বধূর ছবি টাঙ্গানো। ছবিটিও সতেজ আর দুচোখে কী মমতা, বুঝলাম এটি আমার মায়ের ছবি।
আরো কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর একেবারে হঠাত করে গুনগত অবস্থার পরিবর্তন হওয়া শুরু করল। স্থান কাল পেছনে যেতে লাগল। আমার তীক্ষ্ণ চেতনা ক্রমশ ভোতা হয়ে আসতে লাগল। আমার বরাদ্দ সময় কি ফুরিয়ে আসতে লাগল ! আমার প্রবল ইচ্ছে করতে লাগল মায়ের কাছে আরো কিছু সময় থাকি। কিন্তু কিছুই আমার ইচ্ছের উপর নয়। আমার পক্ষে এ জীবন ধারন বা এ জীবনের জন্য মমতা পোষণ করা অর্থহীন। অবশ্য তারপরও আমাকে আরো কিছু সময় রাখা হলো সম্ভবত আরো কিছু দেখানোর জন্য। ঘর জুড়ে এতক্ষণ যে মা মা গন্ধ পাচ্ছিলাম তা চলে গিয়ে এখন ডেটল, ওষুধ আর ফিনাইলের কড়া গন্ধ পাচ্ছি। মায়ের রুমটা আর মায়ের রুম রইলনা সেটি হয়ে গেল একটি ওটি। অপারেশন থিয়েটার।
ঢাকা মেডিকেলের ওটি। আমার বালিকা মা ওটির বেডে শুয়ে আছে– অচেতন। কিন্তু তাঁর চোখমুখ ভয়ার্ত, ক্লিষ্ট। বেডের পাশে ডাঃ নার্স। সবুজ এপ্রোন পড়া ডাঃ এর হাতে একটি বিকট সিরিঞ্জ। কি করবে এরা? এদের মনোভাব আমার ভালো লাগছেনা। এরা তো কাউকে হত্যা করতে যাচ্ছে।
বুঝতে পারছি ওরা আমায় মা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছে। আমি প্রাণপণে মাকে ডাকতে চাইছি, মাকে ডাকার আমার কোন ক্ষমতা নাই। আর ওদিকে মা অচেতন। তারপরও কিভাবে যেন আমি মা মা করে শেষ পর্যন্ত ডেকেই গেলাম… সিরিঞ্জ দিয়ে তারা কাজ সম্পন্ন করল, সফলভাবে। ঘস ঘস করে রিপোর্ট কার্ডে লিখে দিল- M.R. By Syringe.
এই পৃথিবীতে অনেক আগে একটা সময় ছিল যখন মেয়েশিশুদের নির্মমভাবে হত্যা কর হত। সেটাকে বলা হত “আইয়ামে জাহেলিয়াত” এখনও এই আধুনিক যুগেও মায়ের গর্ভ পরীক্ষা করে কন্যা ভ্রূণ হলে হত্যা করা হয়।
মার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঢাকা মেডিকেলের স্যুয়ারেজ লাইনের নোংরা স্রোতে আমি হারিয়ে গেলাম। হারিয়ে গেলাম চিরতরে। আমি আমার মায়ের সন্তান হতে পারতাম! আপুর ভাই বা বোন হতে পারতাম, আমি একজন মানুষ হতে পারতাম! ডাঃ ইঞ্জিনিয়ার বা আর কিছু হোক না হোক মানুষ, কেবল একজন মানুষ। কিন্তু আমি হারিয়ে গেলাম। মহামূল্যবান একটি প্রাণ হারিয়ে গেল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নিরাপদ স্থান যে মায়ের গর্ভ, সেই গর্ভ থেকে স্যুয়ারেজ পাইপে। হারিয়ে গেলাম কারো না কারো ভুল সিদ্ধান্তের জন্য। সেই সিদ্ধান্তকারীর জন্য আমার সকল ঘৃণা! তার জন্য এই ত্রিকালের সকল অভিশাপ! আহঃ কী কষ্ট! কী অসহায় যন্ত্রণা!
কোথায় যেন একটি কাক কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল- কা কা । কা কা নাকি খা খা। নাকি কেউ একজন মানুষ হেসে উঠল হায়েনার মত হা হা।