ফ্লোরিডা থেকে:-

(প্রথম পর্বের পরে ২য় পর্বটি পড়ুন)

উপন্যাসটির শুরুই হয়েছে এক অসহ্য অস্বাভাবিকতায় :
“আমার মা মারা গেছে। নিশ্চিত নই আজ না কাল , আসলে আমি সঠিক জানিনা ” মার্শালের আত্মকথন।
সে তার মায়ের সৎকারে যেয়ে কোন কান্নাকাটি করেনি, বরং কফিনের পাশে বসে চুপচাপ সিগারেট খেয়েছে, কফি পান করেছে, তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সে মায়ের মুখ দেখতে চায় কিনা , সে বলেছিল না । সে মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে কোন আবেগ ব্যক্ত করেনি বরং মন্তব্য করেছে সৎকারে উপস্থিত অন্যান্যরা কে কি করেছে সে বিষয়ে ।
পরে তার দেখা হয় প্রাক্তন কলিগ ম্যারীর সাথে, তাদের মধ্যে ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠে , তারা সুইমিং পুলে সাঁতরাতে যায় ,তারপরে এক হাসির ছবি দেখে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের যৌন মিলন হয় এবং এসবই ঘটে তার মায়ের মৃত্যুর একদিন পরে।
কয়েক দিন পরে সে তার প্রতিবেশী ও বন্ধু রেইমন্ডকে সাহায্য করে তার গার্ল ফ্রেন্ডের উপর প্রতিশোধ নিতে। রেইমন্ডের অভিযোগ তার গার্লফ্রেন্ড তার প্রতি বিশ্বস্ত নয় । সুতরাং সে মার্শালকে অনুরোধ করে এমন একটি প্রেম পত্র লিখে পাঠাতে যাতে সে বিশ্বাস করে আবার ফিরে আসে। সে তার পরিকল্পনার কথা জানায়: গার্লফ্রেন্ড যখন আসবে তারা আগের মতই যৌন মিলনে লিপ্ত হবে এবং মিলনের চরম মুহূর্তে এসে সে বান্ধবীর মুখে থুথু ছিটিয়ে লাথি মেরে বের করে দেবে।
মার্শাল বন্ধুকে সাহায্য না করার বিশেষ কোন কারন দেখেনা । সে রেইমন্ডের গল্পটি বিশ্বাস করে । তার ধারনায়ই আসেনা যে রেইমন্ডের গার্লফ্রেন্ডেরও নিজস্ব গল্প থাকতে পারে এবং তার এই অংশগ্রহন হবে সেই মেয়ের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা এবং মানসিক ভাবে তাকে খুবই কষ্ট দেয়া হবে ।
সে চিঠি লিখে দেয় । চিঠি পেয়ে গার্লফ্রেন্ড আসে।
প্ল্যান মত রেইমন্ড তাকে লাথি মেরে বের করে দিলে বিনিময়ে সে চড় মারে । যার ফলে রেইমন্ড তাকে বেধড়ক মারধোর করে। রেইমন্ডকে কোর্টে নেয়া হয়, মার্শাল তার পক্ষে সাক্ষী দেয় যে গার্লফ্রেন্ড ছিল অবিশ্বস্থ যদিও তা ছিল বন্ধুর ভাষ্য । রেইমন্ড কেবল মাত্র ওয়ারনিং পেয়ে ছাড়া পায়। এ ঘটনার পর থেকে গার্ল ফ্রেন্ডের ভাই এবং তার আরব বন্ধুরা রেইমন্ডকে ফলো করতে থাকে।
একবার রেইমন্ড মার্শালকে তার বীচ হাউসে দাওয়াত দেয় ,সে ম্যারীকে নিয়ে যায়।
বীচে হাঁটতে গেলে গার্লফ্রেন্ডের ভাই এবং তার বন্ধুরা আক্রমন করে এবং রেইমন্ডকে ছুরির আঘাতে আহত করে । সেই দিনই মার্শাল রেইমন্ডের থেকে তার রিভলভার ছিনিয়ে নেয় এই ভয়ে যে আরবদের গুলী করে মেরে ফেলতে পারে । সে যখন রিভলভারটি সাথে নিয়ে বীচে ফিরে যায় , আরবদের একজন তাকে একা পেয়ে আবার ছুরি উচিয়ে এগিয়ে আসে। তার হাত স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে চলে যায় পকেটে রিভলভারের ট্রিগারে । তখন ছিল অসম্ভব গরম, সে ছিল অজ্ঞান প্রায় , রোদ গন গন করছিল। সেই রোদ ছুরিতে প্রতিফলিত হয়ে তার চোখ ঝলসে দেয় । রৌদ্রস্নাত স্বেদবিন্দু তার দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দেয় এবং এমন অবস্থায় সম্পূর্ন বিভ্রান্ত এবং ঘোরের মধ্যে সে রিভলবারের ট্রিগার টিপে দেয় ,
আরব মরে পড়ে যায় এবং সে লাশটিকে দেখতে পেয়ে পর পর আরো চারবার গুলী করে । কেন সে আবার মৃতদেহটিকে চারবার গুলী করলো তার কোন ব্যাখা সে দিতে পারেনা। কারন হিসেবে কেবল বলে যে গরম এবং অত্যোজ্জ্বল সূর্যালোকের কারনে সে ছিল অসম্ভব বিরক্ত এবং বিভ্রান্ত ।
তাকে জেলে রাখা হয় । যেহেতু সে ছিল এমনিতেই সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন , জেলে সে সহজেই খাপ খাইয়ে নেয়, সে মেনে নেয় যে আগের মত সে আর যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারবেনা। একমাত্র অপূর্ণতা সে অনুভব করে যে আগের মত তার ম্যারীর সাথে যৌন মিলনের স্বাধীনতা আর নেই। সে শুয়ে বসে ঘুমিয়ে সময় কাটায় অথবা বসে বসে মনে করতে চেষ্টা করে তার বাসার খুঁটিনাটি জিনিস পত্র গুলোর কথা ।
বিচারের সময় মার্শাল খুব শান্ত ও নির্লিপ্ত থাকে । প্রসিকিউটর একে ব্যাখ্যা করে তার মধ্যে অনুশোচনা বা অনুভূতি হীনতা বলে । সে আসল বিচারের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে তার মায়ের সৎকারের সময়ের নির্লিপ্ততা এবং অস্বাভাবিকতাকে হাইলাইট করে প্রমান করতে চায় যে সে কত বড় অমানুষ । আসল হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি যা ছিল সত্যিকারের একটি দুর্ঘটনা এবং আত্মরক্ষার সহজাত প্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ তা সে এড়িয়ে যেয়ে বার বার জেরা করে সেই স্বীকারোক্তি আদায় করার , কিন্তু ব্যর্থ হয় । মার্শাল তার আত্মকথনে প্রকাশ করে যে সে জীবনে কখনই কোন অনুশোচনা বোধ করতে বা কোন ব্যক্তিগত অনুভূতি ব্যক্ত করতে সক্ষম হয়নি । প্রসিকিউটর নাটকীয় ভাবে মার্শালকে চিত্রায়িত করে একজন হৃদয়হীন দানব হিসাবে, যে অনুশোচনা প্রকাশে অক্ষম সুতরাং তার অপরাধের একমাত্র শাস্তি হতে পারে মৃত্যুদন্ড ।
মার্শালের উকিল মারশাল কে বলে যে সে ধারনা করছে যে তার চরম শাস্তি হবার সম্ভাবনা নেই কিন্তু দেখা গেল তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে । তার আপিল খারিজ হয়ে যায় । তার মৃত্যুদণ্ডের কারণ যে তার প্রকৃত হত্যাকাণ্ড নয় বরং সে কি ধরনের মানুষ এবং সমাজ তাকে কি ভাবে দেখে সেই পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গীই যে মূল তা সে বুঝতে পারে । একজন মানুষ সমাজ স্বীকৃতি দিলেই শুধু বাঁচতে পারে আর স্বীকৃতি না দিলে তাকে মরতে হয় ।
কামুর এই লেখাটি আজ খুবই সত্য।সমাজ একজন ভাল মানুষের চরিত্র হরন করে অমানুষ দেখিয়ে আস্তাকুরে ফেলে দিতে পারে, একজন পিচাশকে মহান নেতা বানাতে পারে, একজন মননশীল মানুষকে নাস্তিক বলে জবাই করতে পারে। মানুষ এবং মানবতার প্রশ্নে সমাজ নির্বিকার ও একচোখা দানবের মত , নিরমম, হৃদয়হীন ,ক্রূর ।
সমাজে মানুষের অবস্থান ওই কুকুর ছানাগুলোর মত ছালায় বন্ধ, পায়ে পাথরবাঁধা এবং শ্বাসরুদ্ধকর । কামুর ওই বীক্ষা আজো কত সত্য। মানুষ এবং মানবতার প্রশ্নে সময় এগুয়না, থেমে থাকে।

শাহাব আহমেদ
জুন ৬,২০১৬

পাদটীকা
একটি কুকুর বিষয়ক গান – সেরগেই ইয়েসিনিন
“Stranger or outsider “ Albert Camu.
কামুর লেখাটি বুঝতে উইকির সাহায্য নিয়েছি

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন