পৃথিবীর সমস্ত শিশু মানবিক বিকাশের সমান অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তবে সব দেশে শিশু সমান পরিস্থিতিতে জন্মগ্রহণ করে না। শিক্ষিত ও অর্থশালী ঘরে জন্ম নেয়া শিশু পরম আহ্লাদে বেড়ে উঠে।মনে হবে যেন এই সব শিশু সোনার চামচ মুখে নিয়ে দুনিয়াতে এসেছে। আবার কেউবা অভাবী সংসারে জন্ম গ্রহণ করে এবং চরম অবহেলায় বেড়ে উঠে। অভাবী ঘরে জন্ম নেয়া শিশুর খবর কে রাখে, অনেকে নবজাত শিশুকে বোঝা মনে করে হাসপাতালে রেখে দিয়ে চলে যায়। নবজাতকদের বিকাশের সহজাত ক্ষমতার পার্থক্যগুলি তাদের পরিবেশের প্রভাব, বৈষম্যের মুখোমুখি দ্বারা আচ্ছাদিত হয়। নীতি, কাঠামো এবং সিস্টেমের প্রেক্ষাপটে এই পার্থক্যগুলি শিশুদের বৈষম্য এবং শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তি হয়ে ওঠে।

কানাডাতে শিশু জন্ম নেয়ার পর থেকে বেড়ে উঠার দায়িত্ব শুধু মাবাবার উপরই বর্তায় না , সরকারের ও দায়িত্ব রয়েছে। প্রতিটি শিশুকে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখে, নাম রেজিস্ট্রেশন করে , কেমন মাবাবা এই শিশু জন্ম নিয়েছে তা পর্যবেক্ষন করে। এ দেশে প্রতি বাচ্চার জন্য মাকে চাইল্ড বেনিফিট দেয়া হয় এবং সময় সময় এই বাচ্চাকে সমাজকর্মীরা বাসায় এসে দেখাশুনা করে। বাচ্চার বেড়ে উঠার সঙ্গে তার শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন একইভাবে পরীক্ষা করে দেখে। যদি কোনো বাচ্চা মাবাবা সঠিকভাবে লালন পালনের দায়িত্ব নিতে অক্ষম হয়, সে ক্ষেত্রে সমাজ কল্যাণ কর্মী রিপোর্ট করে এবং এ বাচ্চাকে বিশেষ অবস্থায় ফস্টার পেরেন্টস বা পালক পিতা-মাতাকে দায়িত্ব দিয়ে থাকে।

এ দেশের সামাজিক ব্যবস্থা শিশুদের বিকাশে জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি পরিবারে মাবাবা উভয়কেই কাজ করে সংসার চালাতে হয়,সে ক্ষেত্রে প্রারম্ভিক শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রে রেখে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। মাবাবার বাৎসরিক রোজগারের ভিত্তিতে মাসিক শিশু পরিচর্যা খরচ নির্নয় করা হয় । কাজের শেষে মাবাবা অথবা তাদের কেউ এসে শিশুকে ডে কেয়ার থেকে বাসায় নিয়ে যায়। সারা দিন এই শিশুকে দেখাশুনার দায়িত্ত্ব ডে কেয়ার ব্যক্তিদের উপর বর্তায় এবং ওরা অতি যত্ন সহকারে এই শিশুকে দেখাশুনা করে।

স্কুল সিস্টেম (বিদ্যালয় ব্যবস্থা):

স্কুলে প্রতিটি বাচ্চাকে অতি যত্ন সহকারে দেখাশুনা ও বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষা দিয়ে থাকে। কানাডার স্কুলগুলি তরুণ নবাগতদের জন্য বিশেষ সহায়তা প্রদান করে, বিশেষ করে যে সব বাচ্চা বাহিরের দেশ থেকে এসে স্কুলে যায় , স্কুল কতৃপক্ষ পরীক্ষা করে ওদের জন্য বিশেষ প্রয়োজন মোতাবেক পড়াশুনার ব্যবস্থা করে। এ দেশের স্কুল সিস্টেম একাধিক ভাষায় তথ্য সরবরাহ সামঞ্জস্য প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য স্বাগত প্রোগ্রাম রয়েছে।

শিশু কল্যাণ কর্মসূচীঃ

কানাডায় প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক সরকারগুলি শিশুদের নির্যাতন ও অবহেলা থেকে রক্ষা করার জন্য শিশু বিশেষ সহায়তার ব্যবস্থা রয়েছে। সব শিশুকেই ওরা সমান ভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। এ দেশে আমাদের মতো গরিব ধনী বলে শিশুদের আলাদাভাবে দেখে না, এখানে সব মাবাবা কাজ করে বা অবস্থাভেদে সমাজ কল্যাণ ভাতা নিয়ে সংসার পরিচালনা করে।

প্যারেন্টিং স্টাইল :

কানাডায় প্যারেন্টিং ভালবাসা, সমর্থন এবং উৎসাহের উপর জোর দেয়, তবে এটি অন্যান্য দেশের অনুশীলন থেকে পৃথক হতে পারে।কানাডিয়ান সমাজে সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় সংবেদনশীল এবং সামাজিক দক্ষতা বিকাশে শিশুদের সহায়তা করার ক্ষেত্রে পিতামাতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোনো বাচ্চাকে ঘরে মারধর করলে , সে বাচ্চা স্কুলে গিয়ে রিপোর্ট করলে সঙ্গে সঙ্গে সমাজ কল্যাণ কর্মী বাচ্চাকে মাবাবা থেকে আলাদা করে নিয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে সমাজ কল্যাণ কর্মী মাবাবাকে শিশু লালন পালন সংক্রান্ত ট্রেনিং দিয়ে থাকে।

সাশ্রয়ী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সেবা:

কানাডা সরকারের লক্ষ্য সকল পরিবারের জন্য সাশ্রয়ী, উচ্চমানের, নমনীয় এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রারম্ভিক শিক্ষা এবং শিশু যত্ন পরিষেবা সরবরাহ করা। কানাডায় শিশুদের বৃদ্ধি এবং বিকাশের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে একসাথে কাজ করে।

আমরা ছোটকাল থেকে দেখে বড় হয়েছি যে চৌধুরী সাহেব, মিয়া সাহেব,ভূইয়া সাহেব এবং তাদের ছেলেমেয়েরা ও একটা আলাদা মর্যাদা বা দাম্ভিকতা নিয়ে বেড়ে উঠে । কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে,তারা জন্ম থেকেই মাবাবা বা তার চারিদিকের আত্মীস্বজনকে ধোন দৌলত ও শিক্ষিত পরিবেশে দেখেছ। যে যেই পরিবেশে জন্ম ও বেড়ে উঠে, সে সেই পরিবেশ থেকে কথাবার্তা বা চালচলন শিক্ষা লাভ করে। ধনী ঘরের বা শহরে শিক্ষিত পরিবেশে বেড়ে উঠা ছেলেমেয়ে গরিব ঘরের ছেলেমেয়ের সঙ্গে অনেক পার্থক্য। আমাদের অবস্থাসম্পর্ণ লোকজন পয়সা খরচ করে ছেলেমেয়েদের বাহিরের টিউটর দিয়ে পড়াশুনা করিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষত করে। কিন্তু এ দেশে সব ছেলেমেয়ে নিজের চেষ্টায় পড়াশুনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেক মাবাবা ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার ব্যাপারে কোনো খবরই নেয় না। স্কুল ও পারিপার্শিক পরিবেশের কারণে ওরা নিজ থেকেই সুন্দরভাবে বেড়ে উঠে।

একটি বাচ্চা যদি ঢাকা শহরের কোনো বস্তিতে জন্মগ্রহণ করে, সে জন্ম থেকেই মাবাবার দুঃখ কষ্ট দেখে বড় হয় । সে দেখে তার মাবাবা ভোর হলে এ বাড়ি সে বাড়ি কাজ করে বা সকালে বাবা রিক্সা নিয়ে বের হয়, দুবেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খায়। একটা ছেলে বা মেয়ে যে পরিবেশে জন্ম , সে পরিবেশ থেকেই শিক্ষা লাভ করে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটির জন্য ছেলেমেয়েরা সঠিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়।


১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানী হানাদার , রাজাকার বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মহিলাদের উপর যে পাশবিক অত্যাচার করেছে , তার ফলে অবৈধ শিশু জন্ম নেয়। তৎকালীন সরকার কানাডা,নেদারল্যান্ড বা যে সব দেশে এই অনাথ শিশুদের পাঠিয়েছে -সে সব দেশের রক্ষণাবেক্ষন ও পরিবেশের জন্য ওরা সুন্দর ভাবে জীবন পেয়েছে। সুযোগ পেলে সব ছেলেমেয়ে ভালোভাবে পড়াশুনা করে বেড়ে উঠতে পারে। এ সব দেশে সব ধরণের সুযোগ রয়েছে যার কারণে প্রতিটি ছেলেমেয়ে সমান সুযোগ নিয়ে বেড়ে উঠে।

 

সমাপ্ত

পূর্ববর্তী নিবন্ধজেন-জি: এ জার্নি ফ্রম এক্স টু জেড
পরবর্তী নিবন্ধতৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রের রূপ-পর্ব ১৮
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলাম - জন্ম:- ১৯৪৮ সাল । এনায়েতপুর, কচুয়া, চাঁদপুর, বাংলাদেশ। শিক্ষা:- এম, কম ( ব্যাবস্থাপনা ), ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এম, এ (অর্থনীতি ) জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি। চাকুরী জীবন:-ইসলামাবাদ, পাকিস্তান,বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া,আমেরিকা ও কানাডা। বর্তমানে :- অবসর জীবন- কানাডাতে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত বই:-আমার সংগ্রামী জীবন,সাদা ঘোড়া,জীবন চক্র,শুচিতা ও জীবনের মুখোমুখি।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন