জীবনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমি অজ্ঞ। প্রিয়জনদের কাছে “পাগল” নামে পরিচিত এই আমি অনেক সহজ জিনিসের হিসেব ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। আর সেই হিসেব যদি অযৌক্তিক হয় তো কথাই নেই।চলমান জীবনের কোনও ক্ষেত্রে যদি একেবার সর্বনিম্ন নম্বর পেয়ে ফেল করে থাকি তা হল “সম্পর্ক”। তা সে যে কোনও সম্পর্ক হতে পারে, যেখানে একের অধিক মানবসন্তান জড়িত।মনব-সম্পর্কের উত্থান পতন আমার কাছে অসম্ভব জটিল ধাঁধা বলে মনে হয়।আমাকে থিওরিটাকাল ফিজিক্সের string theory নিয়ে প্রশ্ন করলে রিসার্চ করে বের করে দিতে পারব কিন্তু পাশের বাসার আন্টির কেন দোতালার ছেলেটার লম্বা চুল দেখলে গা চুলকায় তার কোনও যুক্তি আমি আজ পর্যন্ত খুঁজে পাই নি।
আমরা মানবকুল কিন্তু অসম্ভব জটিল। একটি ব্যাঙের জীবনের লক্ষ হল পোকা সংগ্রহ করা ক্ষুধানিবারন করার জন্য আর বর্ষাকালে বিয়ে-থা, সন্তানাদি ও সংসার পাতানোর জন্য ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ করে একে অপরকে আকৃষ্ট করা। মানুষেরও কিন্তু একই চাহিদা। কিন্তু জীবনের নির্দিষ্ট কোনও লক্ষ নেই।এক সাধারন ষষ্ঠ শ্রেণীর প্রথম বালিকার জীবনের লক্ষ্য থাকে একজন ডাক্তার কিংবা সমমানের কোনও পেশায় নিয়োজিত থাকতে। যদি কালক্রমে সে একজন ডাক্তার হয়েও যায়, তার জীবন নিয়ে সে কিন্তু সন্তুষ্ট নয়। তাকে আরও ডিগ্রী, টাকা, স্বামী, সন্তান ইত্যাদি নানাবিধ জিনিস করতে হয়।
তার উপরে সিন্দাবাদের ভুতের মত আমাদের উপরে সাওয়ার হয় লিঙ্গবৈষম্য। মেয়ে হয়েছ? স্বামী- সন্তান থাকতেই হবে, বেশি রাতে বাড়ী ফেরা যাবে না, রিক্সা চালানো যাবে না, ব্যাক্তিস্বাধীনতা থাকবে না, রাস্তা দাঁড়িয়ে আড্ডা মারা যাবে না।ছেলে হয়েছ? অর্থ উপার্যনের সকল দায় তোমার, পরিবারের দায়িত্ব তোমার মাথার উপরে, মায়ের কথাও শুনতে হবে, বৌ এর টাও।ইদুরদৌড়ে হেরে গেলে চলবে না। আর কিছু অযৌক্তিক সমস্যা রয়েছে যা আবার ছেলে মেয়ে ভেদাভেদ করে না, যেমন এখনকার যুগে ক্যারিয়ার, ডিভোর্স, টাকা পয়সা, ব্রান্ডেড গাড়ী- পোশাক- জুতা ইত্যাদি। বড় যন্ত্রনা হয় এইগুলি থেকে যৌক্তিকতা খুঁজে বের করতে।আমার মাথায় ধরে না কেন আমার জুতার ফিতায় সাথে কানের দুল ম্যাচ করতে হবে? কেন আমার গাড়ীর সামনে চারটা গোল্লা বলে দেবে যে আমি “আউডি” চালাই? কারনটা কি??
তোমরা কি কখনও ভেবে দেখেছ, আমরা কতখানি অযৌক্তিক জীবন যাপন করি? কিসের জন্য এত দৌড়ঝাপ, জীবন তো একটাই।
সাধারন দিনে একটি পরিবারে গৃহকর্তী ও কর্তা দুজন যে যার মত কাজে চলে যান। যদি কোনও একজন বাসায় গৃহণ(?) কিংবা গৃহিণী হন তবে সে বাসায় থাকেন। ছানাপোনারা স্কুলে যান। বেশি ছোট্ট বাবু হলে সে মা কিংবা বাবার সাথে দিন কাটায়। সোম থেকে শুক্র এই সময়ে গড়ে চার পাঁচ ঘন্টার বেশি একে অপরের সান্নিধ্যে থাকা হয় না। কিন্তু –
আইলে রে দিন করোনার
সবাই ঘরে থাকিবার
হয়তো জীবনে প্রথমবারের মত এক বাসায় সকল সদস্য সর্বক্ষন একে অপরের সাথে দিনের পর দিন। সময়টা কঠিন তো বটেই তার উপরে রয়েছে আসন্ন অর্থসঙ্কটের আশঙ্কা! বাবুগুলোর স্বাধীন চিত্ত আটকা পড়ে গেছে ঘরের কোনে, নিশ্চই তাদের কষ্ট হচ্ছে। আরও কষ্ট হচ্ছে প্রতিদিনের কাজে ব্যস্ত থাকা বড় হয়ে যাওয়া সদস্যদের। হঠাৎ করে জীবন যেন থমকে গেছে। প্রথমদিকে একে অপরের সঙ্গ খুব ভালো লাগলেও ধীরে ধীরে ছোট খাট খুঁতগুলো খুব বড় আকারে সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রতিদিন অফিসে চলে যাওয়া স্বামীটি হয়তো জানেনই না যে দুপুর ১২.০০ টায় তার স্ত্রী প্রায় ঘন্টাখানিকের জন্য স্কুলের বান্ধবীদের সাথে গল্প করেন। যে কথপকথনগুলো চোখের সামনে দেখে ও শুনে তার খুব খারাপ লাগে। আবার স্ত্রীটিও হয়তো জানেন না যে একই সময়ে স্বামীটির অফিসের সামনের টং এর দোকানের এককাপ চা খাওয়ার অভ্যেস। ভদ্রলোক কিন্তু জানেনই না কিভাবে চা বানাতে হয়। স্ত্রীটিও তাই স্বামীর উপরে বিরক্ত চা বানিয়ে দিতে হয় বলে। এরকম ছোট ছোট বিষয় অনেকবার হওয়াতে মেজাজ খারাপ হওয়াটা কিন্তু খুব স্বাভাবিক। একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে লন্ডনে ডমেস্টিক ভায়োলেন্স ৭০০% বেড়ে গেছে করোনাভাইরাসের সময়কালে। এ হল বিপদের উপরে আরও বড় বিপদ। আর চিন্তা কর, ঘরের মাঝে বাবা মা যদি বিবাদে লিপ্ত থাকে তবে বাবুগুলো কোথায় যাবে? তাদের মনে কি অশান্তি হবে?
ঐ যে বললাম, মানুষ বড় অযৌক্তিক প্রাণী। সবার আগে আমরা স্বার্থপর – তা বাবা, মা, সন্তান, ভাই, বোন যে সম্পর্কেই হই না কেন। আর বেশিরভাগ ঝামেলার এই উৎসটাই হল এই স্বভাব। কিন্তু ভাগ্যের কথা হল, আমরা কিন্তু অসম্ভব বুদ্ধিমান। যদি আমরা আমাদের এই সমস্যা সম্পর্কে জানি,সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ট জীব হিসেবে আমরা এর সমাধানটাও বের করতে পারব। আমরা যদি একে অপরের ছোট ছোট বিষয়গুলো জানি, একে অপরের বাউন্ডারী অতিক্রম না করি এবং পারসোনাল স্পেসকে সন্মান করি, তবে কিন্তু এই ঝামেলা অনেকাংশেই কমে আসবে। মনে রাখতে হবে, আমরা সৌভাগ্যবান যে আছি পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে প্রিয় মানুষগুলোর সাথে। নিজেকে যদি একটু সরিয়ে নিতে পারি, ইগোটা যদি একটু গিলে খাই আর ভাগাভাগি করে দায়িত্বগুলো নিয়ে নিই তবে একসাথে থাকার সময়টা সত্যিই উপভোগ করা যাবে। আর সবাই যদি দয়া করে একটি ঘন্টা কেবল নিজের উপরে ব্যায় করো তাহলে দেখবে সামনের দিনটা আরও বেশি চমৎকার হয়ে উঠবে।
বলতে পার, সম্পর্ক সম্পর্কে তুই কিচ্ছু জানিস না তাহলে এত প্যাঁচাল কেন পাড়লি? প্রথমত, দুইজন খুব প্রিয় মানুষ Nilema Jahan এবং Nasreen Khan আমাকে এর সম্পর্কে লিখতে বলেছেন।দ্বিতীয়ত, আমি অসম্ভব ঝগড়াইট্টা একজন বরিশাইল্ল্যা- তাই ঝগড়ার কারন সম্পর্কে আমার চেয়ে ভালো জানে এমন মানুষ খুব কম। তৃতীয়ত, একজন খাঁটি বাঙালীর মতই আমি জ্ঞান দিতে পছন্দ করি।যদিও জ্ঞানের পরিধী অত্যন্ত সীমিত।
পুনশ্চ: দাদাভাই এবং দিদিগন- চেস্টা করেছি পুরুষ কিংবা মেয়ে কারও পক্ষ না নিতে, কারন আমি নিজেকে এই দুই লিঙ্গের একজনও মনে করি না। তবু যদি কষ্ট পেয়ে থাকেন তবে পাগলের প্রলাপ মনে করে ক্ষমাভিক্ষা করবেন।