হোমলেসদের নিয়ে আমাদের মানে তথাকথিত সভ্য সুস্থ স্বাভাবিক মানুষদের মাঝে অনেক মিশ্র অনুভূতি থাকে, বিশেষকরে প্রবাসে এই বাংলাদেশী কমিউনিটিতে। সমাজের আর দশটি মানুষের মতো এঁদেরও থাকে সুখ/দুঃখ হাসি কান্নার কথা। অনেক বছর হোমলেসদের নিয়ে কাজ করার সুবাদে এইসব হাসি কান্না অনেক থেকে দেখেছি ও শুনেছি। নিজের অভিজ্ঞগতার আলোকে হোমলেস নিয়ে এর আগে আরোও দুটি পর্ব লিখেছিলাম। বেশ কয়েক মাস গ্যাপ দিয়ে আরেকটি পর্ব লিখলাম। আপনাদের মূল্যবান কমেন্টস এই ধারবাহিক লেখাকে আশা করি আরো বেগবান করবে। মনে রাখবেন, এই লেখার চরিত্র, ঘটনা সম্পূর্ণ লেখকের কল্পনা থেকে নেয়া।
( কেউ যদি আগ্রহ বোধ করেন আমাকে মেসেঞ্জারে লিখলে আমি আগের পর্ব গুলি পাঠানের চেষ্টা করবো – অথবা এই ব্লগে আমার নামে সার্চ করলে আগের লেখা পর্ব গুলি পাবেন )-
কানাডার ব্যাস্ত শহর টরেন্টোর ফিঞ্চ ও ওয়েস্টন রাস্তার পাশে ছোট্ট প্ল্যাজার পার্কিংলটে একটি ছোট খাটো জটলা তৈরী হয়েছে। জটলাটি আসলে হোমলেস নিজাম উদ্দিন ও তার মেয়ে নাজমা ওরফে নাজুকে নিয়ে। নাজু ওর পাকিস্তানি বন্ধু ইস্তিয়াক খানকে সঙ্গে করে এদিকটায় এই সাত-সকালে বাবার খোঁজে এসেছিলো। আজ যে বাবার জন্মদিন। কাল রাতেই ইশতিয়াকের সঙ্গে ওর প্ল্যান করা ছিল। ইসতিয়াক আর ও বাবাকে নিয়ে যাবে স্কারবোরোতে বেসমেন্টে এক রুমের ভাড়াকরা বাসায়। দুপুরে ইসতিয়াক আর ও মিলে বাবার পছন্দ করা খাবার রান্না করে বাবাকে খাওয়াবে। বিকালে বাবাকে স্কারবোরো টাউনসেন্টারে নিয়ে টুকটাক বাবার দরকারি কিছু কিনে দিবে। তারপরে, রাতে বাবাকে নিয়ে একটি ইন্ডিয়ান কোনো রেস্তোরায় ইসতিয়াক সহ একসাথে ডিনার খাবে। পরিকল্পনা মাফিক সবকিছুই ঠিক ঠাক ভাবেই এগুচ্ছিলো। গতকাল অর্থাৎ শুক্রবারের সন্ধ্যার মধ্যেই বাংলাদেশী গ্রোসারিতে যেয়ে বাবার প্রিয় ছোট মাছ, পালং শাক, পাঙ্গাশ মাছ ইত্যাদি কেনাকাটা শেষ হয়েছে। ভোর সোয়া ছয়টা নাগাদ ইসতিয়াক ওর টয়োটা নিয়ে চলে এসেছে। ভোর প্রায় সাড়ে সাতটার মধ্যে নাগাদ নাজু ও ইসতিয়াক নিজাম উদ্দিনের ডেরায় ঠিক ঠিক পৌছিয়ে যায়। প্রায় বছর খানিক আগে বাবার সাথে একবার সাবওয়ে ট্রেনে দেখা হয়েছিল. তখনি জেনে নিয়েছে বাবা ফিঞ্চ ও হাইওয়ে ৪০১ এর এক্সিটের কাছে কোথাও থাকে। সে ভাবেই ওরা এদিকটা আসতেই সৌভাগ্যবশতঃ কাছেই ব্রিজের নিচে বাবাকে পেয়ে যায়।
কিন্তু, গোল বেঁধেছে অন্য জায়গায়। নিজাম উদ্দিন গোঁ ধরেছে কিছুতেই যাবে না। ওদের দেখে নিজাম উদ্দিন সোজা উত্তর দিকে জোরে জোরে হাটতে থাকে। পিছনে পিছনে ছুটছে নাজু আর ইসতিয়াক। সে এক বিরল দৃশ্য। অবশেষে, প্রায় মিনিট বিশেক হাটার পরে এই প্লাজার পার্কিংলটে নিজাম উদ্দিনের নাগাল পেয়ে নাজু বাবাকে জাপ্টে ধরে। আসে পাশের লোকজন জড়ো হয়ে জটলার সৃষ্টি হয়েছে। নিজাম উদ্দিনের চেচাঁমেচিতে এক উৎসাহী মহিলা পুলিশে ফোন করায় দশ মিনিটের মধ্যে পুলিশ এসে হাজির। ইসতিয়াক পুলিশকে সবকিছু বুঝিয়ে বললেও পুলিশ নিজাম উদ্দিনকে জেরা করা শুরু করছে। অগত্যা, পুলিশের সমঝোতায় নিজাম উদ্দিন রাজি হয়ে যায় মেয়ের সাথে যেতে।
শনিবারের সকাল বেলা, হাই-ওয়ে ৪০১ খুব একটা যানজট নেই। ইসতিয়াক শা শা করে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে পূর্বদিকে। বাবা-মেয়ে বসেছে পিছনের ছিটে। নিজাম উদ্দিন জানালা দিয়ে উদাস ভাবে তাকিয়ে আছে বাহিরের দিকে। নাজু বাবার হাত কোলের মধ্যে নিয়ে নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,: “হ্যাপি বার্থ ডে বাবা”। নিজাম উদ্দিন এই পর্যায়ে আর নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে হু হু করে ডুকরে কেঁদে উঠে। একজন হোমলেস মানুষ হিসাবে জন্মদিনের উইশ কিভাবে গ্রহণ করতে হয় কান্না ছাড়া তাঁর জানা নেই। নিজাম উদ্দিনের জেনারেশনে এমনিতেই হ্যাপি বার্থ ডে-র চল তেমন নেই। তাঁর উপর আবার হোমলেস।
গাড়ি হাইওয়ে থেকে ভিক্টোরিয়া পার্কে এক্সিট নিয়ে এগুতে থাকে. নাজু হাতের ইশারায় ইশতিয়াককে দেখেই বাবাকে বলে :”বাবা, এর নাম ইসতিয়াক. আমরা খুব ভালো বন্ধু. ওর বাবা-মা দুজনেই পাকিস্তানি, তবে ইশতিয়াকের জন্ম এখানে” । নিজাম উদ্দিন, জানালাথেকে মুখ না ফিরিয়েই জবাব দেয়” ভালো”। নিজাম উদ্দিন মুখে ভালো বললেও, ভিতরে ভিতরে পাকিস্তানী শুনে কেমনযেন একটা অনুভব করে। মূহূর্তেই আবার নিজের জগতে ফিরে যায় নিজাম উদ্দিন। নিজে হোমলেস। মেয়ের ছেলে বন্ধু পাকিস্থানী হোক, বা আফ্রিকান হোক, তার কিইবা এসে যায়। তারপরেও হাজার হোক বাবা বলে কথা। মেয়ের ভালো/মন্দ বিচারতো তারই দেখার কথা।
নাজু যে বেজমেন্ট ভাড়া নিয়ে থাকে সে বাড়ির মালিক গ্রিক এলাকার. ব্যাবহার বেশ ভালো। বেজমেন্টে নাজু ছাড়াও আরেক রুমে আরেকটি ইন্ডিয়ান মেয়ে স্টুডেন্ট থাকে। পড়া লেখার পাশা পাশি মেয়েটি একটি স্টোরে কাজ জোরে। ওর নাম বিন্তি। বিন্তি ও নাজু পাশা পাশি দুই রুমে থাকে। একটি কমন কিচেন ও কমন ওয়াশ রুম শেয়ার করে থাকে। আজ বিন্তি বাসা নেই, গত কাল বলে গেছে এই আউইকেন্ডে সে বাসা ফিরবেনা, বান্ধবীর সাথে থাকবে। নাজু ও ইসতিয়াক কাল রাতেই পুরা বেসমেন্ট ঘষে-মেজে চকচকে করে রেখেছে। দৈনিক টেবিলের বাসে ওয়ালে বাবার পুরানো দিনের একটি ছবি ট্যাঙ্গানো হয়েছে.টয়লেটের ফ্ল্যাশ ভালো কাজ করছিলোনা. বাড়িয়ালাকে বলে চেঞ্জ করে নিয়েছে।
ইসতিয়াক ও নাজু নিজাম উদ্দিনকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরে। নাজু, জোরকরে বাবাকে টুলে বসিয়ে কাঁচি দিয়ে বাবার মাথার চুল ছেঁটে দেয়। নাজু বাবার হাতে সদ্য কেনা সাদা পায়জামা.পাঞ্জাবি, একটি তোয়ালে ও সেভিং ক্রোম, রেজার বাবার হাতে ধরে দিয়ে বলে :”বাবা চট করে, ওয়াশরুমে যেয়ে সেভ করে নাওতো, সুন্দর করে মাথায় শ্যাম্পু করে হট সাওয়ার নিবে। আমরা নাস্তা রেডি করছি”। নিজাম উদ্দিন কিছুটা ইতস্তত করলেও মন্ত্রের মতো নাজুর আদেশ পালন করে। ওয়াশরুমে অনেক সময় নিয়ে নিজাম উদ্দিন সেভ করে, গোসল ছেড়ে আয়নায় চুলছাঁটা এই নিজামুদ্দিনকে নিজের কাছে বেশ অচেনা মনে হয়। কবে লাস্ট টাইম গোসল করছিলো মনে করার চেষ্টা করে. নিজাম উদ্দিনের জীবন থেকে নিয়িমিত, গোসল, সকাল বেলা দাঁত মজা, তিন বেলা খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি ঘটনা হয়না বললেই চলে। রুপা চলে যাওয়ার পর থেকে সংসার থেকে ছিটকে পরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সংসারের নিয়ম-কানুন অনেকবছর আগেই লাপাত্তা হয়েছে. তাঁর উপর আবার সিজোফ্রেনিয়ার উপস্বর্গ।
আয়নায় নিজাম উদ্দিন লক্ষো করে সেভ করতে যেয়ে থুতনির নিচের দিকে অল্প খানিকটা কেটে ফেলেছে। আফটার সেভ লাগাতেই কিছুটা জ্বলন টের পায়। নতুন সাদা পাজামা পান্জাবী পরে নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা লাগে। বাথরুম থেকে বেরুতেই দেখে নাজু ও ইস্তিয়াক নাস্তার টেবিলে বাবার জন্য অপেক্ষা করছে। ইস্তিয়াক ভালো বাংলা বলতে পারেনা। নাজুর কাছ থেকে শুনে কিছুটা রপ্ত করেছে। নিজাম উদ্দিন কে দেখে ইসতিয়াক ভাঙা বাংলায় বলে উঠে,”তোমাকে খুবই সুন্দর লাগছে”। নিজাম উদ্দিনের মতো হোমলেস লোকেরা এজাতীয় কম্প্লিমেন্টসে খুব একটা অভ্যাস্ত নয়। অনেক বছর সংসারের বাহিরে থেকে থেকে নিজাম উদ্দিন প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো এধরণের কোথায় কি বলতে হয়। ইশতিয়াকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। নাস্তার আয়োজন তেমন কিছু না। যেহেতু দুপুরের রকমারি রান্নাবান্না হবে তাই হালকা নাস্তা। ডিম্ স্ক্রাম্বল করে ওর মধ্যে কেচাপ , হট সস দিয়ে ইন্ডিয়ান দোকান থেকে কেনা পাতলা রুটিদিয়ে মুড়ে অনেকটা রোলের মতো করে নিজাম উদ্দিনের প্লেটে সার্ভ করা হয়েছে। এ ছাড়াও বাটিতে দুধ ঢেলে পাশে সিরিয়াল রাখা হয়েছে। নিজাম উদ্দিন মন দিয়ে নাস্তা খেতে থাকে। কতদিন টেবিলে বসে নাস্তা খাওয়া হয়ে উঠেনি। নাজু পরিবেশ কিছুটা হালকা করার জন্য বাবাকে বলে,’বাবা বলতো আজ থেকে তোমার বয়স কত হলো?” নিজাম উদ্দিন কিছুটা থতমত খেয়ে ভাবতে থাকে আসলেইতো, বয়স কত হলো? আপনমনে ভাবতে থাকে নিজাম উদ্দিন, ১৩৬০ সালে বৈশাখ মাসের ৮ তারিখে প্রচন্ড ঝড়ের রাত্রে নিজাম উদ্দিনের জন্ম। নিজাম উদ্দিনের জামানায় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিন্ম মধ্যবিত্তের ঘরে ইংরেজিতে জন্ম তারিখ লিখে রাখার তেমন প্রথা ছিলোনা। বিয়ের পরে ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে ইন্টারনেট ঘেটে ইংরেজিতে কনভার্ট করে বাবার জন্মদিন বের করেছে এপ্রিল মাসের ২১ তারিখ। পর পর তিন কন্যার পরে নিজাম উদ্দিন। নিজাম উদ্দিন পরে শুনেছিলো, ওর জন্মের পর বাবা তমিজ উদ্দিন এতই খুশি হয়েছিল যে ছেলে নিজাম উদ্দিনের জন্মের পরে আজান দেয়ার সময় ইমোশনাল হয়ে ভুল করে ফেললেন। ‘হাই-আলাসসালা’ দুই বারের জায়গায় তিনবার বলে ফেললেন। পরে আজান শেষে দেখে মা মিনারা খাতুন পাশে দাঁড়িয়ে মিটি মিটি হাসছে। “কিরে তোমিজ্জা পোলা পাইয়া খুশিতে মাথাডাতো এক্কেবারে আওলায়ে ফেলসস। এই টাকা কয়ডা ধর। অনেক বছরের জমানো টাকা, প্রায় দুই হাজার টাকা হইবো। এইডা লইয়া বাজার থেইক্কা অধমন মিডা কিনা লইয়া আয় বাজান”। টাকা পেয়ে, বাবা তমিজ উদ্দিন সত্য সত্যি আধামন মিষ্টি কিনে ফেলে। তারপর সেই মিষ্টি প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, ফকির মিসকিনের মাঝে বিতরণ শেষে বৈশাখের ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় আঁতুড়ঘরের আসে পাশে ঘুড় ঘুড় করতে থাকে ছেলেকে দেখার জন্য। প্রচন্ড বাতাসে ছাতা উল্টিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে জবুথবু অবস্থা। নিজাম উদ্দিন এই গল্প ছেলেমেয়েদের সাথে অসংখ্যবার করছে। আজ নিজের জন্মদিনে নিজের জন্মের সময়ের পুরানো কথা মনে হতে থাকে। নিজাম উদ্দিনের মায়ের কথা হটাৎ করে মনে হয়। আচ্ছা মার্ মির্ত্যুবার্ষিকী যেন কবে? আসলেইতো, কিছুতেই মনে করতে পারেনা নিজাম উদ্দিন। মেয়ের কোথায় চমকে উঠে. ” বাবা, তোমার সাথে খুব জরুরি কথা আছে .মন দিয়ে শুনো।
” বাবা, ইশতিয়াককে আমি আজিই বিয়ে করতে চাই”। নিজাম উদ্দিন হকচকিয়ে যায়। মেয়েকে সে ভালোভাবে চেনে। একবার যখন মুখ থেকে বের করেছে, বিয়ে করেই ছাড়বে। অবিকল মায়ের মতো জেদ হয়েছে মেয়েটির. নিজাম উদ্দিন থতমত খেয়ে বলে, “তোমার মায়ের সাথে কোনো কথা হয়েছে”। কথাটি আসলে বোকার মতো বলা হয়েছে, কারণ নিজাম উদ্দিন ভালো করেই জানে রুপা সেই যে একরামের হাত ধরে চলে গেছে তারপর থেকে এই পরিবারের কারো সাথে কোনো যোগাযোগ রাখিনি। মেয়ে নাজু আর ছেলে রিফাত শুধু বাবার সাথেই কিছুটা যোগাযোগ মেলে চলে , তাও দুই এক বছরে এক আধবার।” না বাবা, মাকে বলার আমি কোনো প্রয়োজন দেখিনা”, বেশ চোয়াল শক্ত করে নাজু জবাব দেয়। রিফাতকে কিছু বলেছিস? ” দাদা কিছুটা জানে, তবে আজিই যে বিয়ে করছি সেটা জানেনা”।”নিজাম উদ্দিন ফিসফিসিয়ে বলার চেষ্টা করে, ” মা, তুই যে বললি , ওঁরা পাকিস্তানি…”. ইশতিয়াকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে নাজু বলে,” বাবা, তুমি হয়তো ওকে পাকিস্তানী বংশোভূত বলে মেনে নিতে পাচ্ছ না। আমি ওর সাথে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের বিষয় ডিটেলস বলেছি। ইসতিয়াক সে সময়ের পাকিস্তানের সরকারের ভূমিকার কথা ভেবে বেশ লজ্জিত। আর ও তো ওই সময়ে জন্মই হয়নি বাবা।
বাবা-মেয়ের কথা ইসতিয়াক পুরাপুরি না বোঝলেও অন্তত এটা বুঝেছেবুজেছে হয়ত বাবা মেয়ে বাংলাদেশ/পাকিস্তান নিয়ে কথা বলছে। ইসতিয়াক নিজাম উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,” আমি বাংলাদেশ ভালোবাসে”. ” বাবা-মেয়ে হেসে কুটি কুটি। অনেক বছর পরে হোমলেস নিজাম উদ্দিন হতবাক হয়ে ভাবতে থাকে, বহু বছর পরে সে স্বাভাবিক সংসারী মানুষেরমতো আচরণ করছে, দাড়ি সেভ করছে, শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করছে, নাস্তার টেবিলে বসে নাস্তা খাচ্ছে, এমনকি হেসে হেসে কথা বলছে। কিন্তু নিজাম উদ্দিনেই মাথাটা একটু ঝিম ঝিম করতে থাকে। না, না, সে কিছুতেই সংসারী জীবনে আর ফিরে আস্তে চায়না। তারপরেও, একজন বাবা হিসাবে মেয়ের বিয়ে তাকে কিছুটা ভাবিয়ে তোলে। নিজাম উদ্দিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে, মা রে, আমিতো অনেক বছর লোক সমাজের বাইরে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে বেড়াই, আমি কি করে তোর বিয়ে দিবো?” নাজু ঠান্ডা গলায় বাবাকে বলে,” তোমাকে কিছু করতে হবে না, দুপুর সাড়ে বারোটায় টেবিলে দুপুরের খাবার দেয়া হবে। আমরা সবাই এক সাথে খাওয়া দাওযা করবো বাবা। তারপর তুমি জোহর নামাজ পড়তে যাবে স্থানীয় মসজিদে এবং নামাজ শেষে মৌলানা সাহেবকে ডেকে আনবে। উনি বিয়ের সব ব্যবস্থা করবেন। কোনোরকম চালাকি করে পালাবার চেষ্টা করবে বাবা। তোমার যাতে মসজিদ চিনতে অসুবিধা না হয়, ইসতিয়াক যাবে তোমার সাথে।
নিজাম উদ্দিন আর কোনো আপত্তি করে না। “আচ্ছা ঠিক আছে বলে গভীর মনোযোগ দিয়ে নাস্তা খেতে থাকে। মেয়ে নাজু বেড়ে উঠেছে কানাডার আলোবাতাসে। এখানকার আর দশটা ছেলে মেয়ের মতো দিব্বি বয়- ফ্রেন্ড/গার্ল ফ্রেন্ড ফর্মে কাটিয়ে দিতে পারতো। মেয়ে ধর্মীয় ভাবে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে এক সাথে থাকতে চায়, এটা ভাবতেই মেয়ের জন্য নিজাম উদ্দিনের বাবা হিসাবে বেশ গর্ব হচ্ছে।”আহা !! মা ছাড়া মেয়ে আমার!! বাবাযে থেকেও নেই ! এই বিদেশ বিভূঁয়ে মেয়েটা যদি স্বামীকে নিয়ে সুখে থাকে থাকুক”। ইসতিয়াক বেচেরা নিজের বিয়ের খবরটি শুনে একেবারে হতবম্ব ! গতকাল নাজুর সাথে আজকের ব্যাপারে যেসব আলাপ করে ঠিক করা হয়েছিল, এই বিয়ের ব্যাপারটা ওদের গতকালের প্ল্যান এর মধ্যে একেবারেই ছিলোনা। অন্তত রাতে নাজু ওকে যদি কিছুটা ইঙ্গিত দিতে পারতো, তাহলে মা/বাবাকে হয়তো ম্যানেজ করতে পারতো। মা-বাবা যে একেবারেই নাজু সম্পর্কে জানেনা তা নয়, তবে ছেলে যে এত দ্রুত বিয়ে করবে সেটা ওঁদের ধারণার বাহিরে ছিল। ইসতিয়াক বাবা মায়ের কথা ভাবতেই ভয় পেয়ে ফ্যাকাশে মুখে বসে আছে। নাজু ইস্তিয়াকে কিছুটা সাহস দেয়ার চেষ্টা করে।”ভয় পাচ্ছ কেন? তুমি টরেন্টোর সেরা ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে সিটিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে গুরুত্বপূর্ণপদে কাজ করছো। তোমার মা বাবা তোমাকে পছন্দ করে। এখন সকাল নয়টা মতো বাজে. তোমাকে দুই ঘন্টা সময় দেয়া হচ্ছে। এই দুই ঘন্টার মধ্যে তোমার মা-বাবাকে এখানে নিয়ে আসবে। যাওয়া আসা এক ঘন্টা। সাড়ে বারোটার সময় আমরা সবাই মিলে এক সাথে এখানে লাঞ্চ করবো জোহর নামাজ দুপুর দেড়টায়। অর্থাৎ খাবার পরে তোমার হাতে আরোও এক ঘন্টা সময় থাকবে। ইসতিয়াক কোনিও কথা না বাড়িয়ে রওনা হলো ওঁদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
মোটামুটি আসরের ওয়াক্তের আগেই পুরাপুরি বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো। আরো আগে হতে পারতো, সমস্যা হয়েছিল ইশতিয়াকের। মা-বাবাকে নিয়ে সবে বাসা থেকে বের হয়েছে। হাই-ওয়ে তে ঠিক ঢোকার আগমুহূর্তে পিছনের ডানদিকের চাকা ফ্ল্যাট। এদিকে সি এ এ -এর মেম্বারশিপ রিনিউ করা হয়নি. অগত্যা, এক বন্ধুর বদৌলতে ওই বন্ধুর মেম্বারশিপ আই ডি ব্যাবহার করে ঘন্টা খানিকের মধ্যেই সব সমাধান।
রাতে ইশতিয়াকের মা/বা সহ সবাইমিলে মিসিসাগাতে একটি পাকিস্তানি রেস্টুরেন্টে মহা হৈহুল্লোড় করে খাওয়া-দাবার পর্ব সেরে ফেলে। খাবার টেবিলে নাজু বড় ভাই রিফাককে ভিডিও কল দেয়। রিফাত গত ৪/৫ বছর হলো আমেরিকাতে থাকে। ওখানে এক বাংলাদেশি মেয়েকে বিয়েকরে ওখানেই থিতু হয়েছে। নাজুর ভিডিও কলের সুবাদে অনেক বছর পরে রিফাত বাবাকে লাইভ দেখতে পায়। টুকটাক বাবার সাথে কোথাও হয়। খাবার শেষে নাজু নব্য শশুর-শাশুড়ির হাতে বক্সে করে অতিরিক্ত খাবার তুলে দিয়ে, উনাদেরকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানায়। ইসতিয়াক, নিজাম উদ্দিন, নাজু সবাই নাজুর বেজমেন্টের ফিরে আসতে প্রায় রাত এগারোটা বেজে যায়।
নিজাম উদ্দিনের থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছিল পাশের রুমে অর্থাৎ বিন্তির রুমে। বিন্তি গতকাল যাওয়ার আগে বলে গিয়েছে এই উইকেন্ডে ও ফিরবেনা। নিজাম উদ্দিন রুমে ঢুকে এক গ্লাস পানি খেয়ে সটাং হয়ে বিছানায় বাতি নিভিয়ে শুয়ে পরে। অনেক বছরের পুরানো অভ্যাস রাস্তায় ঘুমানো, তাই, রুমে নরম তোষকে শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসে না। নিজাম উদ্দিন ঝটপট পরবর্তী পরিকল্পনা করতে থাকে। রাত প্রায় পৌনে বারোটা বাজে। পাশের ঘরে কোনো সারা শব্দ নেই। নিজাম উদ্দিন মেয়ের দেওয়া পাজামা, পাঞ্জাবি খুলে আগের ময়লা পুরাতন কাপড়চোপড় পরে নিঃশব্দে দরজা খুলে সাবধানে বেরিয়ে পরে। তারপরেও, বেরুনের সময় দরজায় খুট করে একটু শব্দ হয়। নাজু মনে করে, বাবা হয়তো সিগারেট খাবার জন্য বেরুচ্ছে।
ঘন্টাখানিক এর মধ্যেই নিজাম উদ্দিন ডাউন টাউনের একটি বারে ঢুকে গলা অবধি ছাই /পাশ গিলতে থাকে। ভোর রাতে নিজাম উদ্দিন বার থেকে বের হয়ে কিছুটা বেতাল অবস্থায় ফিঞ্চ ষ্টেশন থেকে ৩৫ নং বাস চেপে বসে। বাসে ছুটে তন্দ্রার ভাব আসে গিয়েছিলো। তারপরেও পুরোনো জায়গা চিনতে মোটেও ভুল হয়না। ভোর প্রায় পাঁচটার দিকে পুরাতন হাম্বার রিভার হসপিটালের কাছে ওভার ব্রিজের কাছাকাছি স্টপেজে বাস থেকে নেমে পরে। নিজ ডেরায় ফিরে বেশ ভালো লাগে। মাথার নিচে পোটলা রেখে শুয়ে পরে একটি আস্ত সিগারেট ধরিয়ে মেয়ের বিয়ের কথা ভাবতে যেয়ে নিজের বিয়ের পুরানো কথা মনে পরে যায়। আজ প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা। নিজাম উদ্দিন কানাডা থেকে জামালপুরে নিজ বাসায় এসেছে বিয়ে করতে.সম্মন্ধ নিয়ে এসেছিলো দূর সম্পর্কের এক মামা। মেয়ের নাম রুপা সম্ভব রূপবতী, হয়তো সেই জন্যই নাম রাখা হয়েছিল রুপা। বাবা, জামালপুর শহরে ডিসি অফিসের পিওনের কাজ করেন। মেয়ের বিয়েতে, ডিসি সাহেব, টি এন ও সাহেব আরো কত সাহেব এসেছিলো। নিজাম উদ্দিন দুই হাত খুলে টাকা পয়সা খরচ করছে বিয়ে উপলক্ষে ইটা সেটা কেনা কাটার জন্য। বাড়ির সাথে লাগেনি প্রাইমারি স্কুল মাঠে বিশাল প্যাণ্ডেল বানানো হয়েছে. বিয়ের সব আয়োজন প্রায় শেষ. নিজাম উদ্দিন ছোট ভাই মন্টুকে ৫০০ টাকার দুটি নোট হাতে দিয়ে দায়িত্ব দিয়েছিলো কাজী অফিসে যেয়ে কাজী সাহেবকে ডেকে আনার জন্য। মন্টু আবার ৫০০ টাকার একটি নোট নিজের কাছে রেখে সেই দায়িত্বটি সাব-কন্ট্রাক্টরি দিয়েছে খুব কাছের এক বন্ধু বিরুকে। সেই বিরুকে কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না। বন্ধুর দেওয়া টাকা মেরে বিরু লাপাত্তা। এদিকে বর সেজে নিজাম উদ্দিন বসে আছে বিয়ের অপেক্ষায়। রাত প্রায় আটটার মতো হবে। ডিসি সাহেব বার বার ঘড়ি দেখছেন। নিজাম উদ্দিন মাথা থেকে পাগড়ি খুলে মন্টুর সন্ধানে বের হলো। বেশি দূরে যেতে হলোনা। প্যান্ডেলের পিছনে মন্টুকে পাওয়া গেলো মহা টেনশনে সিগারেট খাচ্ছে। ভাইয়াকে দেখে তাড়াতাড়ি সিগারেট ফেলে দিলো।”কি রে মন্টু কাজী সাহেব কোথায়?ভাইয়া, বিরু হারামজাদা যে এরকম বেইমানি করবে একেবারে বুঝতেই পারিনি। ওকে টাকা দিয়েছি কাজী সাহেবকে ডাকার জন্। টাকা নিয়ে ও পগারপার. নিজাম উদ্দিন সময় নষ্ট না করে মন্টুর গালে প্রচন্ড এক চড় মারে। “ওসব বুঝিনা, কুড়ি মিনিটের মধ্যে কাজী সাহেবকে চাই”। চড়ের বেশ কাজ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। মন্টু পনেরো মিনিটের মধ্যে কাজী সাহেব কে নিয়ে হাজির. আজ এত বছর পরে, টরেন্ট শহরের ওভার ব্রিজের নিচে শুয়ে মন্টুর জন্য, নিজাম উদ্দিনের কিছুটা মায়া হতে শুরু করলো। আহা, বেচারা মন্টুকে ওই রাতে এত জোরে চড়টা মারা ঠিক হয়নি। মদের প্রভাবে, নিজাম উদ্দিনের স্মৃতি রোমন্থন কিছুটা এলোমেলো হয়ে পরে। এবার আবার বাসর রাতে রুপার কথা মনে পরে। বাসর রাতে রুপার সাথে নিজাম উদ্দিনের ছোট্ট বিষয় নিয়ে কিছুটা ঝামেলা বেঁধে গেলো। নিজাম উদ্দিন ঘরের মধ্যে মশা মারার জন্য কড়া ধরণের কোয়েল জ্বালিয়ে রেখেছিলো। রুপা ঘরে ঢুকেই বললো,”কোয়েলের গন্ধে দম বন্ধ হবার মতো অবস্থা। সব জানা খুলে দাওতো।”নিজাম উদ্দিন কিছুতেই এই বাসর রাতে ঘড়ের জানালা খোলার পক্ষে না। দুইজনের খুঁটাখুঁটি লেগেগেল। খুঁটাখুঁটি আরো দীর্ঘ হতে পারতো, কিন্তু নিজাম উদ্দিন এর রাতবিরাতে একজন রূপবতী মেয়ের সঙ্গে জগড়া করার জন্য মন সায় যায় দিলো না। নিজাম উদ্দিনকে অবশ্য আপোষ করতে হলো অন্য আরেকটি কারণে। বাথ রুমে যাওয়ার সময় তাড়াহুড়া করে অনেকটা অসাবধানতার বসে পাজামার ফিতায় গিট্টু লেগে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও গিট্টু খুলতে পাছে না। অগত্যা, রুপা মুখ টিপে হেসে কি অনায়েসেই এক সেকেন্ডের মধ্যে গিট্টু খুলে ফেললো. সৃষ্টিকর্তা আই মেয়েকে শুধু রূপই দেয় নি গুণও দিয়েছে। আজ এত বছর পরে ব্রিজের নিচে শুয়ে শুয়ে রুপার আরো অন্যান্য গুনের কথা ভাবতে ভাবতে আরো একটি সিগারেট জ্বালায় নিজাম উদ্দিন। এই পর্যায়ে এবার হটাৎ করে মেয়ে নাজুর কথা মনে পরে গেলো আহা বেচারা মেয়েটি ভোরের উঠে দেখবে যখন বাবাবা নেই কি যে কান্না কাটি শুরু করবে। নিজাম উদ্দিনের মন কিছুটা দুর্বল হয়ে পরে. এবার নতুন করে সংসার বাধলে কেমন হয়? মুহূর্তেই, নিজেকে সামলিয়ে নেয় নিজাম উদ্দিন। না, সংসার, সুশৃঙ্খল জীবন-যাপন তার জন্য না। নিজাম উদ্দিন সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে আই জায়গাটি দ্রুত বদলে ফেলতে হবে. নাজু/ইসতিয়াক ওরা এই জায়গা চিনে ফেলেছে। উত্তরের দিকে অনেক ভিতরে কোনো ছোট্ট শহরে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে থাকে নিজাম উদ্দিন।
সকাল বেলায় নাজুর ঘুম ভেঙে দেখে বাহিরে যাওয়ার দরজা খোলা। বিন্তির রুমে যেয়ে দেখে বাবাকে দেওয়া নতুন পাজামা/পাঞ্জাবি মেঝেতে পরে আছে। নাজুর আর বুঝতে বাকি থাকে না বাবা পালিয়েছে। নাজুর ভীষণ খারাপ লাগে বাবাবার জন্য। নাজুর প্লান ছিল ২/১ দিনের মধ্যে বাবাকে নিয়ে ইসতিয়াক সহ একটি দুই রুমের এপার্টমেন্টে উঠবে। বাবা যদি স্কারবোরো-র এইদিকে থাকতে আপত্তি থাকে তাহলে অন্যকোথাও থাকবে। বাবার রুমটি সবসময় টিপটপ করে গুছিয়ে রাখবে। উইকেন্ডে বাবাকে নিয়ে ইসতিয়াক সহীহ ঘুরে বেড়াবে। বাবার আবার নতুন করে চিকিৎসা করবে। এখানে অনেক কমিউনিটি ভিত্তিক এন জি ও আছে যারা মানসিক রোগী, হোমলেস প্রভৃতি নিয়ে কাজ করে। নাজু ইশতিয়াকের সহায়তায় এরকম একটি সংস্থার সাথে যোগাযোগও করে রেখেছিলো। বাবা চলে যাওয়ায় সব ভেস্তে গেলো। নাজু জানে, বাবাকে খুঁজতে ওই জায়গায় যেয়ে আর লাভ নেই, বাবা অবশ্যই ওই জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে. তার পরেও চেষ্টা কড়া যেতে পারে. নাজু, ইশতিয়াকের কাছে যায়. ইসতিয়াক কে নিয়ে আবারো বাবার ডেরায় যাবে, ইসতিয়াক এখনো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। এর আগে মানুষের নাক ডাকার সাথে নাজু কোনো দিন পরিচিত ছিল না. কাল রাতে টের পেয়েছে।
ইশতিয়াককে এই মুহূর্তে গ্রাম বাংলার বর্ষা কালের ব্যাঙের মতো দেখাচ্ছে। ইশতিয়াকের মতো শান্ত ষষ্ট ভদ্র ছেলেরা যে নাক ডেকে ঘুমোতে পারে নাজুর জানা ছিলোনা। বিয়ের আগে ছেলেওদের আরো কত কি অজানা থাকে। ধীরে ধীরে স্ত্রীদের সব মেনে নিতে হয় যেমন মেনে নিয়েছিল মা তার বাবাকে।
নাজুর বেজমেন্টে কোনো জানালা নেই ছাদের কাছে একটু ভেন্টিলেটারেরে মতো ফাঁকা অংশই আছে। নীলু ওই ফাঁকা দিকটায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে পুরা সকাল হওয়া দেখলো। কি অদ্ভুত ভাবে শেষ রাতের আধার কেটে ফুস করে ভোরের এল ফুটে উঠলো। . নাজুর শখ, ওদের যখন অনেক টাকা পয়সা হবে একটি ব্যাংলো টাইপের বাসা কিনবে । সেই বাসার সামনে পিছনে মনের মতো বাগান করবে । সেই বাসার বেড রুমে বেডের পাশে থাকতে হবে প্রকান্ড জানালা। সেই জেলা দিয়ে আরো সুন্দর করে ইসতিয়াক সহ পূর্ণাঙ্গ ভোর হওয়া দেখবে। লম্বা বারান্দায় বেতের সফা থাকবে। সেই সোফায় ইসতিয়াক আর ও জোস্নার রাতে পাশা পাশি বসে চা খাবে। নাজু খুব কষ্ট হচ্ছে বাবার জন্য. সেলফোনের ইউটিউব থেকে একটি গান উপলোড করে মন দিয়ে শুনছে:
সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।যা-কিছু পায় হারায়ে যায়, না মানে সান্ত্বনা।।সুখ-আশে দিশে দিশে বেড়ায় কাতরে-মরীচিকা ধরিতে চায় এ মরুপ্রান্তরে।।ফুরায় বেলা, ফুরায় খেলা, সন্ধ্যা হয়ে আসে-কাঁদে তখন আকুল-মন, কাঁপে তরাসে।।ফুরায় বেলা, ফুরায় খেলা, সন্ধ্যা হয়ে আসে-কাঁদে তখন আকুল-মন, কাঁপে তরাসে।।কী হবে গতি, বিশ্বপতি, শান্তি কোথা আছে-তোমারে দাও, আশা পূরাও, তুমি এসো কাছে।।
:নাজুর দুগাল বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। নাজু টেরিই পায়না পাইনি, ইসতিয়াক কখন ওর পাশে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে ওর সাথে গান শুনছে। বেচারা, বাংলা গানের হয়তো কোনো অর্থ বুঝতে পারিনি, তবে এত টুকু হয়তো বুঝেছে এটা একটি দুঃখের গান।
অনেক বছরের ধরে নিজাম উদ্দিন প্রবাসে টরেন্ট শহরে বাঙ্গালীদের থেকে কিছুটা দূরে জেন /ফিঞ্চের কাছে এই দিকটায় প্রায় বছর পাঁচেক হলো থাকতে শুরু করেছিল। জায়গাটি হাইওয়ের পাশেই হওয়ায় ইনকাম মন্দ হতোনা। হাই ওয়ে থেকে বের হওয়া গাড়ি রেড লাইট ট্রাফিকে পড়লে গাড়ির কাছে এগিয়ে যেত কিছু ডলার, কিছু ভাংতি কয়েনের জন্য। কিন্তু এ এলাকায় আর না। মেয়ে এলাকাটি চিনে ফেলেছে। মনে তীব্র ইচ্ছা জাগে এলাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে টিমহর্টনের অবিকল রুপার মতো দেখতে সেই পরিচিত মহিলাটির হাত থেকে কফি নিতে। আবারো মন শক্ত করে নিজাম উদ্দিন। হোমলেসদের মধ্যে মায়া-মমতা ভালোবাসা এসব থাকতে নেই। এসব তোলা থাকুক সমাজের উপরতলার তথাকথিত সভ্য মানুষদের জন্য। ভোরের আলো ভালো করে ফুটে উঠার আগেই নিজাম উদ্দিন পোটলা-পাটি গুছিয়ে রওনা দেয় নতুন গন্তব্যে। (চলবে)