মাইকেল মুরের সাড়া জাগানো ডকুমেন্টারী ফিল্ম ”SICKO” এর কথা অনেকেরই হয়তো মনে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “মুনাফা নির্ভর স্বাস্থ্য সেবা“র সাথে কানাডা, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং কিউবার “অলাভজনক, সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা”র তুলনামূলক আলোচনা এবং এর কার্যকারিতা ফুটে উঠেছে SICKO ফিল্মে। কানাডা এবং অন্য তিনটি দেশে যেখানে সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত, তাদের প্রসঙ্গ টেনে মুর বলেন, “They take care of each other, no matter what their disagreements. They live in a world of ‘we’, not ‘me’. We’ll never fix anything until we get that one basic thing right”। বলাবাহুল্য, ‘শুধু আমিই না, স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার অধিকার আমাদের সবার’ এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে কানাডার স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম। কানাডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ হেলথ ইনফরমেশন (CIHI) এর তথ্য অনুসারে ২০১৭ সালে স্বাস্থ্য খাতে কানাডায় প্রত্যাশিত ব্যয়ের পরিমান ছিল ২৪২ বিলিয়ন ডলার যা জাতীয় জিডিপির এগারো দশমিক পাঁচ শতাংশ। এই ব্যয়ের ২৮.৩ শতাংশ হাসপাতালের জন্য. ১৬.৪ শতাংশ ঔষধ খাতে এবং ১৫.৪ শতাংশ ব্যয় হয় চিকিৎসকদের জন্য। একই প্রতিষ্টানের হিসাব মতে কানাডিয়ানদের জন্য স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় ছিল মাথাপিছু ৬৬০৪ ডলার। কানাডার স্বাস্থ্য সেবার ব্যাপ্তি এবং অর্থনৈতিক ভিত্তি বুঝার জন্য এই মৌলিক পরিসংখ্যান জানা থাকা দরকার। পরিসংখ্যানে প্লাবিত না হয়ে ফিরে আসি মূল প্রসংগে।
কানাডার দশটি Province এবং তিনটি Territory তে স্বাস্থ্য সেবার পুরো কার্যক্রমটি পরিচালিত হয় সরকারি সহায়তায় এবং ১৯৮৪ সালে প্রণীত “কানাডা হেলথ এক্ট” এর অধীনে। ‘কানাডা হেলথ এক্ট’ এর মূলনীতিমালায় বলা হয়েছে যে প্রাদেশিক স্বাস্থ্যবীমার সব প্রশাসনিক প্রয়োগ হবে একটি ‘পাবলিক অথরিটির’ অধীনে এবং অলাভজনক ভিত্তিতে। মূলনীতির আর এক অংশে নিশ্চিত করা হয়েছে যে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সব সেবা বীমাকৃত থাকবে এবং সব ‘রেসিডেন্ট’ একই রকম স্বাস্থ্যসেবা পাবেন। এরকম পাঁচটি মূলনীতি নিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘কানাডা হেলথ এক্ট, ১৯৮৪’। এখানে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা এবং এর গুণগত মান একই রখম। কানাডায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাসরত এক বাংলাদেশী ভাইয়ের কাছ থেকে শুনা যে তিনি অটোয়াতে তার ফ্যামিলি ডাক্তারের চেম্বারে অপেক্ষারত রুগীদের মাঝে কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পারকেও একই ভাবে বসে থাকতে দেখেছিলেন। তারমানে এখানে একজন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অতি সাধারণ একজন মানুষও একই রখম সেবা পান। পদবি বা সামর্থ্যের কারণে কারো স্বাস্থ্যসেবার মানের কোনো ব্যতিক্রম হওয়ার সুযোগ নেই, সম্ভাবনাও নেই। সেবাগত বৈষম্য না থাকলেও কানাডায় স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ‘Equity’ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠী, শারীরিক বা মানসিক সমস্যা পীড়িত মানুষ এবং প্রবীণদের জন্য বিশেষ সহায়তার ব্যবস্থা রয়েছে।
এখানে পঁয়ষট্টি বছর বা তদুর্ধ বয়স্ক প্রবীণরা Ontario Drug Benefit (ODB) প্রোগ্রাম নামে একটি বিশেষ সুবিধা ভোগ করেন। পঁয়ষট্টি বছর পূর্ণ হওয়ার তিন মাস আগেই মন্ত্রণালয় থেকে প্রবীণদের কাছে ODB সংক্রান্ত চিঠি আসে যাতে উল্লেখ করা থাকে কখন থেকে এই বেনিফিট কার্যকর হবে। এই ড্রাগ বেনিফিট এর আওতাধীন চার হাজার চারশো এর অধিক prescription drugs রয়েছে। তীব্র এলার্জিজনিত প্রতিক্রিয়ার জন্য এপিপেন, কিছু ডায়াবেটিক সামগ্রী এবং যারা সলিড খাবার খেতে পারেন না, তাদের জন্য নির্ধারিত কিছু পুষ্টিকর খাবারও ODB এর আওতাভুক্ত। এই সুবিধাটি বিনা পয়সায় পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট প্রবীণ ব্যক্তির বাৎসরিক আয় এবং বৈবাহিক অবস্থার উপর। উদাহরণের সুবিধার জন্য প্রয়াত গাজী শামসুর রহমান সাহেবের সাহায্য নেই। ধরা যাক নিঃসঙ্গ দবির সাহেবের বাৎসরিক আয় ১৯৩০০ ডলার। এক্ষেত্রে প্রতি প্রেসক্রিপশন বাবদ তাকে পরিশোধ করতে হবে দুই ডলার এবং কোনো বাৎসরিক ‘Deductible‘ তাকে পরিশোধ করতে হবে না। একই ভাবে সাবেত সাহেব এবং তার স্ত্রীর বাৎসরিক আয় যদি ৩২৩০০ ডলার হয় তাহলে তারাও একই রকম (কোনো deductible ছাড়া এবং প্রতি প্রেসক্রিপশন বাবদ দুই ডলার পরিশোধ সাপেক্ষে) সুবিধা পাবেন। বাৎসরিক আয়ের নির্ধারিত সীমা ছাড়িয়ে গেলে দবির এবং সাবেত সাহেব দুজনকেই বাৎসরিক deductible হিসেবে ১০০ ডলার এবং প্রতি প্রেসক্রিপশন বাবদ সর্বোচ্চ ৬.১১ ডলার পরিশোধ করতে হতে পারে। ODB এর বেনিফিট শুরু হয় ১লা অগাস্ট থেকে। Seniors Co- payment Program নামে পরিচিত এই বিশেষ সুবিধার জন্য মিনিস্ট্রি অফ হেলথ এন্ড লং টার্ম কেয়ার এ আবেদন করতে হয়। এখানে মনে রাখা দরকার যে ODB এর এই বিশেষ সুবিধা শুধু প্রবীণদের জন্যই সীমাবদ্ধ নয়, যারা লং টার্ম কেয়ার হোম বা নার্সিং হোমে থাকেন অথবা যারা Ontario Works, Ontario Disability Support Program এর উপর নির্ভরশীল – তারা ড্রাগ বেনিফিট এর এই বিশেষ সুবিধাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পেয়ে যান। অন্টারিও প্রভিন্সে যারা দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক প্রতিবন্দিতাজনিত সমস্যায় আক্রান্ত এবং ছয়মাস অথবা তার বেশি সময় ধরে কোনো হুইল চেয়ার বা এজাতীয় জিনিস ব্যবহার করেছেন, তারা Assistive Devices Program নামে আরো একটি আর্থিক সুবিধা প্রদানকারী কর্মসূচিতে আবেদন করতে পারেন। যোগ্য বিবেচিত হলে assistive device যেমন হোম অক্সিজেন, হুইল চেয়ার বা শ্রবণ যন্ত্রের মূল্যের শতকরা পঁচিশ ভাগ বহন করবেন সংশ্লিষ্ট ক্রেতা আর বাকি পঁচাত্তর ভাগের মূল্য পরিশোধ করবে মিনিস্ট্রি অফ হেলথ এন্ড লং টার্ম কেয়ার।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রবীণরা একসময় শারীরিক এবং মানসিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন, বাসা বাধে বিভিন্ন রখম অসুখ বিসুখ। প্রয়োজন পড়ে তাদের সার্বক্ষণিক পরিচর্যার। অনেক প্রবীণ আছেন স্বাস্থ্যগত কারণে যাদের নিরবিচ্ছিন্ন, জটিল সেবা (Complex Continuing Care) এর দরকার হয়। পরিবারের সদস্যদের পক্ষে অনেক সময় এই পরিচর্যা করা সম্ভব হয়ে উঠে না। এরকম পরিস্তিতিতে প্রবীণ বা তার পরিবারের সদস্যরা ফোন করতে পারেন Local Health Integration Network বা LHIN এর কেস ম্যানেজার বা কেয়ার কোঅর্ডিনেটরকে। আগে এই বিভাগটি পরিচিত ছিল Community Care Access Centre বা CCAC নামে। কেয়ার কোঅর্ডিনেটর তখন সংশ্লিষ্ট প্রবীণ বা যার সহায়তা দরকার, তার সাথে বসে উপযুক্ততা যাচাই করার পর কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সেবা পাওয়ার উপযুক্ত মনে করলে কেয়ার কোঅর্ডিনেটর তাকে লং টার্ম কেয়ার হোম বা নার্সিং হোমে রেফার করতে পারেন যদিও এখানে অপেক্ষার লম্বা এক তালিকা থাকে। কেয়ার কোঅর্ডিনেটর যদি মনে করেন রুগীকে তার বাড়িতে অথবা কমুনিটিতে রেখেই সেবা দেওয়া সম্ভব সে ক্ষেত্রে কেয়ার প্ল্যান তৈরী করে রোগীর জন্য তার বাড়িতেই নার্স. ফিজিও থেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, পার্সোনাল সাপোর্ট ওয়ার্কার পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় পরিচর্যার বন্দোবস্ত করেন। প্রবীণদের সহায়তার জন্য ছোট ছোট আরো অনেক কর্মকান্ডের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। প্রবীণদেরকে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে সক্রিয় রাখার জন্য শারীরিক অনুশীলন এবং বিনোদনের সমন্বয়ে বিভিন্ন রকমের Adult Day Program চালু আছে বিভিন্ন এলাকায়। যে যার পছন্দমাফিক অনুশীলনে অংশ নিতে পারেন। যে সমস্ত প্রবীণ শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্দ্বিতা বা অন্য কোনো কারণে পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করতে পারেন না, তাদের জন্য “Meals On Wheels” নামে খাবার সরবরাহের একটি কর্মসূচি রয়েছে। একসময়ে স্থানীয় চার্চ কতৃক শুরু হলেও এই উদ্যোগটি এখন ব্যাপক এক কর্মকান্ডে রূপ নিয়েছে। মিনিস্ট্রি অফ হেলথ এন্ড লং টার্ম কেয়ার এর অর্থায়নে অন্টারিও প্রভিন্সে এই কাজে সম্পৃক্ত আছে প্রায় দেড় শতাধিক অলাভজনক প্রতিষ্টান। আমার জানামতে অন্টারিও প্রভিন্সে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক অতি সাম্প্রতিক সংযোজন হচ্ছে OHIP+: Children & Youth Pharmacare। জানুয়ারী ২০১৮ থেকে চালু হওয়া এই বিশেষ কর্মসূচিতে ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত সব শিশু, কিশোরে এবং যুবকরা ODB এর আওতাভুক্ত প্রায় ৪৪০০ ঔষধের যেকোনো ঔষধ বিনামূল্যে পাবে। এরজন্য আলাদা কোনো আবেদনের দরকার হবে না। OHIP (Ontario Health Insurance Plan) কার্ড প্রাপ্ত যে কেউ (২৪ বছর বয়স পর্যন্ত) এই সুবিধাটি পাবেন। শুধু যথাযথ প্রেসস্ক্রিপশন থাকতে হবে।
পৃথিবীর কোনো দেশেরই স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাকে শতভাগ ত্রুটিমুক্ত বলা যায় না। কানাডা ও এর ব্যতিক্রম নয়। এখানেও অনেক জায়গায় অর্থায়ন, জনবল বৃদ্ধি এবং আরো অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়নের পরিসর খুঁজে পাওয়া যায়। বিভিন্ন হাসপাতালের জরুরি সেবা বিভাগকে আরো চৌকষ করে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। তা সত্ত্বেও যেদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যয়ের পরিমান ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং অস্ট্রেলিয়াকে ছাড়িয়ে যায়, যেখানে সবার জন্য একই রকম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়, যেদেশে ফোন করার ছয় থেকে আট মিনিটের মধ্যে জীবন রক্ষাকারী এম্বুলেন্স এবং প্যারামেডিক্স দোর গোড়ায় এসে হাজির হয়,- একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে এরখম একটি দেশের স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে গর্বিত ও পুলকিত না হওয়ার কোনো কারণ আমার জানা নেই।
সৈয়দ মসিউল হাসান
টরোন্টো থেকে
ধন্যবাদ হাসান ভাই ,,,একটি জনগুরুত্বপূর্ণ ও তথ্য বহুল লেখার জন্য। হাসপাতালে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করা ও সামান্য কিছু অসঙ্গতি থাকলেও কানাডার স্বাস্থ্য সেবা বিশ্ব সেরা তাতে কোনো সন্দেহ নাই। ……মনির
কলেবর বৃদ্ধি এবং পাঠকের ধৈর্যচ্যুতির আশংখায় আরো অনেক তথ্য সংযোজন করতে পারিনি। মনির ভাই, সময় নিয়ে এই দীর্ঘ পোস্টিংটি পড়া, মন্তব্ব্য ও অনুপ্রেরণার জন্য অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।