মরমী সংগীত এবং লোকগীতির প্রতি কোনো এক অজানা কারণে সব সময়ই অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভব করি। আমার প্রপিতামহ সৈয়দ আব্দুন নূর হোসাইনী চিশতী (র) “দীনহীন” ছদ্মনামে অসংখ্য মরমী সংগীত রচনা করেছেন। উনার অনেক গানেই রাসূলে পাকের নামের মহিমা এবং রাসূল (সাঃ) কে ভালোবাসার রশি ধরে আল্লাহকে পাওয়ার বিষয়টি উচ্চারিত হয়েছে অনেকভাবে। কে জানে, নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ এই নীরব সাধকের আধ্যাত্বিকতার কিছুটা ছিটে ফোটা হয়তোবা আমাদের রক্তেও মিশে আছে। সেজন্য বুকের ভেতর উথাল পাথাল করা ঢেউ তৈরী হয় কিছু কিছু গান শুনলে। স্রষ্টা যে মানুষের মনের গহীন কোণে লুকিয়ে আছেন, তা উপলব্দি করি নুতন ভাবে। তার নৈকট্য লাভের বাসনা আরো প্রবল হয়ে উঠে। জীবন ধরা দেয় অপার্থিব নুতন এক সুরে। যে অবস্থাতেই থাকি তন্ময় হয়ে শুনে যাই প্রিয় সে সব গান। মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিত জায়গাতেও এরকম গান শোনার সুযোগ তৈরী হয়। কিছুদিন আগে ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশন থেকে সিলেটগামী পারাবত এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠে বসেছি। পাশের সিটের আরেক সহযাত্রী দেখি তার মোবাইল ফোনে গান শুনছেন। মন এমনিতেই খারাপ, তার উপর লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে “লারে লাপ্পা‘ টাইপের গান শুনে। ভেবে মন আরো খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু না, কিছুটা বিস্মিত হয়ে দেখলাম ভদ্রলোক শুনছেন রফিকুল আলমের দরাজ কণ্ঠে গাওয়া গান;
“দয়াল কি সুখ তুমি পাও?
যে জন তোমার দয়ার কাঙ্গাল, তারে কান্দাও“
মাটির পরশ মিশ্রিত গ্রাম বাংলার সহজ সরল মানুষের স্রষ্টাকে নিয়ে অভিমানী হৃদয়ের আকুতি ভরা এক গান। খুব সাধারণ কথার গান হলেও এর মর্মার্থ সাধারণ নয়। বিশেষ করে জীবনের কঠিন সময় পার করা কোনো মানুষের জন্য। সব সময় তার অপার করুনা চাইলেও আল্লাহপাক নিগূঢ় রহস্যে কিছু কিছু মানুষকে হঠাৎ কোনো এক কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দেন। ব্যাখ্যা করা যায়না এমন এক শূন্যতা ঢেকে ফেলে তাদের চারদিক। এটি এমন এক শূন্যতা যা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বুঝতে পারেন। বাস্তবতাকে মেনে নেয়া সেই মানুষগুলোর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। জীবন ও মৃত্যুর মাঝে যে আসলে কোনো দূরত্বই নেই সেই সত্য উদ্ভাসিত হয় নুতন আলোয়। ভাবি কত অনিশ্চিত, সীমাবদ্ধ জীবন আমাদের ! আব্বার হঠাৎ চলে যাওয়ার আগে জীবনের অনিবাৰ্য এই পরিণতিকে এত অন্তর্দাহের মধ্য দিয়ে আগে কখনো অনুভব করিনি। হৃদপিন্ডের একটা অংশ অকস্মাৎ হারিয়ে ফেলার কষ্ট যে কতটা বেদনাদায়ক হতে পারে সেই অনুভুতি কাউকে বুঝানোও সম্ভব নয়। “স্রষ্টা তোমাকে সুখ দুঃখের এক অনুভূতি থেকে আরেক অনুভূতির স্তরে নিয়ে যান বৈপরীত্যের মাধ্যমে শিক্ষা দেবার জন্য, – যাতে আকাশে উড়ার জন্য তোমার দুটি পাখা থাকে, একটি নয়।” মাওলানা জালালউদ্দিন রুমীর তাসাউফ বিষয়ক এই বাণীর মধ্যে সান্ত্বনা খুঁজলেও মনকে প্রবোধ দেয়া খুব সহজ বিষয় ছিল না।
ট্রেনেই বসে আছি। বিস্তীর্ণ প্রান্তর, ক্ষেত খামার, নদী নালা পেরিয়ে পারাবত ছুটে চলেছে সিলেটের পানে। কিছুক্ষন পরপর ট্রেন এক একটি স্টেশনে থামে কিছু সময়ের জন্য। একদল মানুষ হুড় হুড় করে ট্রেন থেকে নেমে যান, আবার আরেক দল বাক্স পেটরা নিয়ে ট্রেনে উঠে বসেন। ট্রেন আবার চলতে শুরু করে। আমি অবাক হয়ে ভাবি আমাদের জীবনটাও ট্রেনের যাত্রীদের মতোই। কারো গন্তব্যের শুরু, কেউ মাঝপথে আবার কারো গন্তব্যের শেষ। মহাকালের ট্রেনে নির্দিষ্ট স্টেশনে নির্দিষ্ট সময়েই নামতে হবে আমাদের। এর ব্যতিক্রম হবার কোনো সুযোগ নেই, সম্ভাবনাও নেই। কি বিচিত্র ভাবনা মানুষের ! আমরা সীমাবদ্ধ জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগের ব্যস্ততায় পরকালের অন্তহীন জীবনের ভাবনাকে অবজ্ঞা করি। আবার এক মিনিট বেঁচে থাকার ভরসা নাই জেনেও আটঘন্টা পরে ঘুম থেকে জেগে উঠার জন্য অ্যালার্ম ক্লক সেট করে রাখি। এই আশা-নিরাশা, আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখের দরিয়ায় অবিরাম সাঁতার কেটে যাওয়া, বেঁচে থাকার নামই হয়তো ‘মানব জীবন’।
সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে