সন্তানের জীবনে মায়ের ভূমিকা কখনো বলে বা লিখে শেষ করার নয়। আমরা সবাই আমাদের মাকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসার চেয়ে সত্য আর স্বচ্ছ বোধ হয় আর কিছু হয় না। মায়ের তুলনা শুধুই মা। আজ আমার দুই মাকে নিয়ে লিখতে খুব ইচ্ছে হলো. একজন আমার জন্মদাত্রী মা আর অন্যজন আমার শাশুড়ি। ছোটবেলা থেকে আমাদের পড়াশুনার ব্যাপারে আম্মার চেষ্টার অন্ত ছিল না। বলতে গেলে আম্মার চেষ্টা আর অনুপ্রেরণাতেই আমরা পাঁচ ভাই বোন পড়াশুনা শেষ করে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্টিত হতে পেরেছি.আমার আম্মা ছিলেন স্কুলের শিক্ষিকা. পাঁচ সন্তানের বড় সংসার সামলিয়েও আম্মা পঁয়ত্রিশ বছর স্কুলের শিক্ষকতা করেছেন. ছোটবেলা প্রত্যেক দিন সকালে আমরা গাড়ি ভর্তি হয়ে সবাই স্কুলে যেতাম আবার একসাথে বাড়ি ফিরতাম। সন্ধ্যার পর আবার আমাদের ডাইনিং রুমে মিনি স্কুল খোলা হতো. আমরা সবাই একসাথে পড়তে বসতাম। আমার এখনো মনে আছে আমরা যখন স্কুল পড়ি আম্মা তখন কুমিল্লা থেকে দূরশিক্ষনে বি এড করেন। সে সময় আম্মা ও আমাদের সাথে সন্ধ্যায় পড়তে বসতেন।
আমরা স্কুলে পড়ার সময় প্রত্যেক ক্লাস পাশ করার জন্য বছরে তিন বার পরীক্ষা দিতে হতো। পরীক্ষার সময় হলেই ভীষণ ভয় লাগতে শুরু করতো, কারণ পরীক্ষা একটু খারাপ হলেই আম্মার কলিগ মানে আমাদের টিচাররা আম্মাকে সাথে সাথে বলে দিতেন। কনফিডেনটিয়ালিটি বলে কিছু ছিল না। বন্ধুরা বকা খেত পরীক্ষার খাতা পাওয়ার পরে আর আমাদের বাসায় সেটা শুরু হয়ে যেত প্রথম সপ্তাহ থেকে। তখন মনে হতো কেন যে শিক্ষিকার সন্তান হতে গেলাম। আমার মনে হয় স্কুলে ভালো রেজাল্ট করা, বিভিন্ন ক্লাসে বৃত্তি পাওয়া সবই ছিল আম্মার জন্য মানে তার বকা থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু যখন কলেজে উঠলাম তখন থেকে পড়া শুনার গুরুত্ব বুঝতে শুরু করলাম.মনে মনে স্থির করলাম স্বাবলম্বী হতে হবে, দাঁড়াতে হবে নিজের পায়ে। এর পেছনে ছিল আম্মার সব সময়ের অনুপ্রেরণা। আম্মা সব সময় বলতেন, “পড়াশুনা করে তুমি আমাকে খাওয়াবে না, তুমি তোমার সন্তান, সংসারের জন্যই ব্যায় করবা.” আজ এই সব কথার মূল্য সত্যিকার ভাবে বুঝতে পারি। আম্মার এই নিরলস উৎসাহ এবং সহযোগিতা না থাকলে আজ আমাদের সব ভাই বোনদের শিক্ষা এবং স্বাবলম্বী হওয়ার প্রতি আগ্রহ থাকতো না. আমরা ভাই বোনরা আজ সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্টিত। অনেক বছর পর পেছন ফিরে তাকিয়ে যখন দেখি, তখন ফিরে যাই শৈশবে, দেখি আম্মা তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে যাচ্ছেন, “পড়াশুনা কি আমার জন্য, পড়াশুনা করে কি আমাকে খাওয়াবা ————–?”
এবার আসি আমার আর এক মা, আমার শাশুড়ির প্রসঙ্গে. মা হলেন খুবই সাধারণ, সহজ সরল একজন মানুষ- আমাকে সংসারী করে তোলা এবং সত্যিকার মা হিসেবে গড়ে তোলার পিছনে তার ভূমিকা অনেক ব্যাপক। বিয়ের পরে মা যখন প্রথম ঢাকায় বেড়াতে এলেন, তখন একদিন আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন যে আমার সংসারে মন বসেছে কিনা। আমি উত্তর দিলাম, “না”. কারণ অনেক ভাই বোনের ব্যস্ত সংসার থেকে আসার কারণে আমাদের দুজনের সংসার খুব নীরব, নিরস মনে হতো. তিনি আমাকে খুব সুন্দর করে সহজভাবে বুঝাতেন সংসারের গুরুত্ব, ধৈর্যের প্রয়োজনীয়তা. সময় পেলে শিখাতেন রান্না। শহরের যান্ত্রিকতা, স্বার্থপরতা এসব উনার মধ্যে দেখিনি. নিজের সন্তান আত্মীয় স্বজন ছাড়াও অনেক অসহায় মানুষকে তিনি নিজের বাড়িতে রেখে, পড়াশুনা করিয়ে প্রতিষ্টিত করে তুলেছেন। নিজের শাশুড়ি বলে নয়, এতো বড়, মুক্তমন, মাতৃসুলভ মনোভাব খুব কম মায়ের মধ্যেই দেখা যায়। বাড়িসুদ্ধ মানুষের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত উনাকে খেতে দেখতাম না। আমি কখনোই তাকে ছেলে বৌদের নিয়ে কথা বলতে শুনিনি। ছেলেদের কাছেও তার কখনোই কোনো চাওয়া ছিলোনা। আমাকে সব সময় বলতেন তোমরা সুখে থাকলেই আমি খুশি। সবাইকে সমান ভাবে ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছেন অথচ কোনো অভিমান, অভিযোগ কখনো শুনিনি তার কণ্ঠে। নিজে মা হয়ে বুঝি সবাইকে নিজের সন্তানের সমান ভালোবাসা সত্যিই কত কঠিন। আল্লাহ্পাক আমার দুই মা কে দীর্ঘজীবী করুন. পৃথিবীর সকল মায়ের প্রতি রইলো আমার অগাধ শ্রদ্ধা।.
নওশিন হামিদ চৌধুরী
টরন্টো থেকে