টরোন্টোতে বসবাস করেন আমার প্রিয় দুজন লেখক। একজন অনেকগুলো গল্প, উপন্যাস লিখেছেন, অন্যজনের প্রকাশিত কোনো বই এখনো নেই। একজন হচ্ছেন জসিম মল্লিক ভাই। তিনি লিখেন নিয়মিত। তার লেখার একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে তার মা। আমি মাঝে মাঝে ভাবি বুকের মধ্যে কতটা মমতা লুকিয়ে থাকলে একজন মানুষ দিনের পর দিন লিখে যেতে পারেন তার মাকে নিয়ে। তিনি হয়তো মানস চোঁখে প্রতিনিয়ত খুঁজে বেড়ান তার মাকে। অন্য লেখকটি হচ্ছেন সালাহউদ্দিন সৈবাল ভাই। প্রচারবিমুখ এই মানুষটি লিখেন হৃদয় দিয়ে, তার ফেসবুকের দেয়ালে। খুব সাধারণ বিষয় অসাধারণ হয়ে উঠে তার লেখায়। জীবনের খুব ছোট ছোট ঘটনা, স্মৃতি এমনভাবে উঠে আসে তার লেখায় যে পাঠকের হৃদয়ের একুল – ওকুল দুকূল আবেগে প্লাবিত হতে পারে নিজের অজান্তেই। ‘রাত সাঁতার’ নামের তার ফেসবুকে লেখার সংকলনটি যে কোনো পাঠক তন্ময় হয়ে পড়বেন বলে আমার বিশ্বাস। আবেগের, ভালোবাসার নদীতে সহসাই জোয়ার বইয়ে দিতে পারেন এই দুই লেখক। পাঠক হিসেবে বা মানুষ হিসেবে আমরাও সবাই হয়তো বয়ে বেড়াই ভালোবাসার কোনো এক নদী। কারো জীবনে ভালোবাসার এই নদী সগর্জনে বয়ে চলে, আবার কেউ কেউ এই নদী হৃদয়ে ধারণ করেন নীরবে, নিঃশব্দে। এই নদীর ঢেউ কেউ দেখে না, বুঝতেও পারে না। আমার বাবা আমাদের জীবনে এমনি এক নদী। জীবন জীবিকার তাগিদে দেশ ছেড়েছি চৌদ্দ বছর আগে। এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, টরোন্টোর উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়ার আগে বিদায়ের মুহূর্তে আব্বা বলছেন “তোমরা সুখে থাকলেই আমরা খুশি“। সন্তান হিসেবে বুঝতে পারছিলাম তার ভিতরে বইছে কোনো এক ঝড়ো হাওয়া, কিন্তু আমরা পিছিয়ে যাবো ভেবে নিজের কষ্ট নিজের ভিতর পুষে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অনেক বছর পরে এখনো দেখি সন্তানের জন্য ধরে রেখেছেন একই মায়া, স্নেহাশীষ। আমরা ছেড়ে এসেছি বলে আমাদের জন্য তাদের ভালোবাসা কখনো ছেড়ে যায়নি। দুহাত তুলে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনার সময়ও সন্তানের মঙ্গল কামনাই তাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠে। কেউ কি কখনো ভেবে দেখেছেন ভালোবাসার এই নদীর গভীরতা কত ? কেউ কি জানেন কোন পাল্লায় এই ভালোবাসার পরিমাপ করা যায় ?
আমাদের বসবাস কঠিন এমন এক সময়ে যখন মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার প্রয়োজন অনেক বেশি। অথচ এর জায়গা এখন দখল করে আছে অবিশ্বাস, ঘৃণা আর বিদ্ধেষ। একদল দেখি ধর্মের মর্মার্থ না বুঝেই ধর্ম নিয়ে উন্মাদনায় ঝাঁপিয়ে পড়ছেন, নিজেকে আগে পরিবর্তনের চেষ্টা না করে চেষ্টা করছেন অন্য মানুষকে হেদায়েতের মহান দায়িত্ব সম্পাদনের। অন্যদিকে দেখি আর এক দল ধর্ম নিয়ে অযথাই সুড়সুড়ি দেয়ার কাজে ব্যস্ত। অবাক হবার বিষয় হচ্ছে যে অন্য কোনো ধর্ম নিয়ে তাদের কোনো প্রশ্ন নেই, মাথা ব্যাথাও নেই। সব গাত্রদাহ শুধু ইসলামকে নিয়ে। দুই দলই একই কাজ করছেন, ছড়াচ্ছেন ঘৃণার বিষবাস্প। বুঝতে পারিনা এতে কার লাভ, কি লাভ ? অনন্তকাল বেঁচে থাকার সার্টিফিকেট নিয়ে আমরা কেউই পৃথিবীতে আসিনি। আসুন ঘৃণা, বিদ্ধেষের পাহাড় না বানিয়ে ভালোবাসার এই ক্ষীণ নদীটিকে জিইয়ে রাখি। এই নদীটিই কিছদিন হলেও বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগাবে আমাকে, আপনাকে – সবাইকে।
(ছবি:-সৌজন্যে freepik)
সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে