পার্থ, অস্ট্রেলিয়া থেকে :-
আফ্রিকার অধিবাসীরা কঠিন সময় পার করেছিল যখন ইউরোপীয়রা পৃথিবীজুড়ে উপনিবেশ শুরু করেছিল। ক্ষমতাধর সেই ঔপনিবেশিকরা জাহাজে করে আফ্রিকানদের দাস হিসাবে ধরে নিয়ে যেত ক্যারিবিয়ান, দক্ষিণ আমেরিকা ও উত্তর আমেরিকা অঞ্চলে। তাদের ওপর চলতো বর্বর নির্যাতন। সেই দাসপ্রথা আজ বিলুপ্ত। এখন ‘বর্ণবাদ থাকলেও নেই’ ধরনের একটা অবস্থা বিরাজ করছে পৃথিবীতে।
বর্ণবাদের ছোঁয়া আমাদের দেশে সেই সময় বা এ সময় না লাগলেও সমাজে শ্রেণী-বৈষম্য সুস্পষ্ট। হাজার বছর আগেও ছিল, এখনও আছে। এ শুধু সমাজবিজ্ঞানে পড়া ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-শূদ্র নয়; এই বৈষম্য দেশে আরও ব্যাপক এবং দৃশ্যমান। কাজের মেয়ে বা ছেলের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের আচরণ তার একটা দৃষ্টান্ত। দেশে নিজের সংসার শুরু করার সুযোগ না হলেও অনেক বাসায় গিয়ে তা অনুভব করতাম।
আমি ভালো বেতনের চাকরি পেয়ে মেস ছেড়ে মোহাম্মদপুরে দুই বেডরুমের একটা ফ্লাট ভাড়া নিয়েছিলাম। বাড়িওয়ালাকে বলেছিলাম – সবে বিয়ে করেছি, বউ শ্বশুরবাড়ি এবং কমাস বাদেই আসবে। বাড়িওয়ালা শুনে রাজি হলেন। কথা সত্যি, আমার স্ত্রী তখন ঢাকার বাইরে তার বাসার কাছে একটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেছিল।
বাড়িওয়ালা হাজী সাহেব আমাকে পছন্দ করতেন। কারণ হিসেবে বলেছিলেন যে, আমার বাড়ি যে জেলায় সেই জেলার লোকজন নাকি ভালো হয়। কথা ঠিক নয়। আমাদের এলাকায়ও কুখ্যাত লোকজন ছিল। হাজী সাহেবকে সেসব না বলে ঝটপট বাসার চাবি নিয়ে নিয়েছিলাম যেন তিনি মত না পাল্টান! বাড়িওয়ালাকে বউ না দেখিয়ে সেকালে বাসাভাড়া পাওয়া দুরুহ ছিল। হাজী সাহেব আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন।
হাজী সাহেব বাসা দেওয়ার সঙ্গে বোনাস হিসাবে রান্না করে দেওয়ার জন্য একজন খালাও ঠিক করে দিলেন।
খালার বয়স পঞ্চাশ থেকে ষাট, খাটো এবং শীর্ণদেহ, চোখে কম দেখতেন। রোজার মাসে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। একদিন রান্না করতে করতে ইফতারের সময় হয়ে গেল, আমি বললাম – ‘খালা ইফতার করে যান’। তিনি বললেন, আইচ্ছা। বাজারে কেনা ইফতার আমি ডাইনিং টেবিলে দুই প্লেটে সাজালাম। তিনি রান্না শেষ করছিলেন। ইফতারের কমিনিট আগে তাকে বললাম, ডাইনিং টেবিলে বসে আমার সঙ্গে ইফতার করতে। তিনি বসবেন না। বললেন, ‘কি যে কন কাকা! আমি পাকঘরে (রান্না ঘরে) বইয়া দুইডা মুহে দিমুনে’। আমি তাকে জোর করে বসালাম। তিনি চেয়ারের পুরো জায়গা ফাঁকা রেখে সামনের প্রান্তের একটু জায়গা নিয়ে বসলেন, হেলান দিয়ে বসা তো দূরে থাক। সরবত এবং একটু ইফতার মুখে দিয়ে চলে যেতে চাইলেন যেন আমি তাকে অনেক ঝামেলায় ফেলে দিয়েছিলাম। আমি বাঁধা দিলাম না। সঙ্গে তার ভাগের ইফতার দিয়ে দিলাম।
তিনি ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আসতেন। তার ধারণা ছিল রান্না না হলে আমাকে না খেয়ে থাকতে হবে।
কোনোদিন বিকালে অফিস শেষ করে বন্ধুদের সঙ্গে কাবাব বা মোঘলাই ধরনের কিছু খেতাম। আড্ডা দিতাম। বাসায় এসে আর খেতাম না অথবা একটু খেতাম। সকালে তিনি নাস্তা বানাতে এসে দেখতেন সব রান্না রয়ে গেছে। তিনি বলতেন, ‘কাকা লবণ কি বেশি অইছিল? স্বাদ অয় নাই তরকারি? তরকারিতে ময়লা পাইছেন? চোহে কম দেহি’ ইত্যাদি। আমি বলতাম, সব ঠিক আছে, বন্ধুর দাওয়াত ছিল। মাঝে মাঝে তিনি মনঃক্ষুন্ন হয়ে বলতেন, ‘আমার পাক না খাইতে পারলে আরেকজন দেহেন, আমার রাইন্দা কাম কি? আমার পুলায় (ছেলে) কয় সব কাম বাদ দিতে।’
তার ছেলে মোহাম্মদপুর বাজারে মাছ বিক্রি করতো, আমার সঙ্গে কোনদিন দেখা হয়নি। সেই ছেলের চাপে তিনি সব কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাকে হাজার সালাম তার মায়ের প্রতি ভালবাসার জন্য। এমন ছেলে যেন দেশের ঘরে-ঘরে জন্মায় – সে মাছ বেচুক আর ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-জজ-ব্যারিস্টার হোক। সেই ছেলে অবশ্য পারেনি তার মাকে আমার কাজ থেকে ছাড়াতে। খালা তাকে বলেছিল, ‘হেইহানেও (সেখানেও) আমার একটা পুলা আছে, আমি না গেলে হে খাইব কি?’
সন্তানতুল্য ভালবাসা তার মনে ছিল, কিন্তু কোনোদিন তিনি আমার সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসতেন না, চেয়ারের সামনে প্রান্তে বসতেন যেন তার কাপড় থেকে চেয়ারে ময়লা লেগে যাবে। একটা অদৃশ্য পর্দা ছিল দুজনের সম্পর্কের মাঝে, এটার উৎস বোধহয় আমাদের দেশের শ্রেণী-বৈষম্যের সংস্কৃতি।
আমার ধারণা সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যদি হয় শ্রদ্ধা আর ভালবাসার, শ্রেণী-বৈষম্য অনেকটা দূর করা সম্ভব। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, শ্রেণী-বৈষম্য দূর করে হবে কি? দেশ কি উন্নত হয়ে যাবে? দেশে কত বিরাট বিরাট সমস্যা, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? সমাজের নানা অবক্ষয় দূর হয়ে যাবে?
হয়তো হবে, হয়তো কিছুই হবে না – সমাজবিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন। আমি মনে করি প্রতিটি মানুষ সন্মান নিয়ে বাঁচার অধিকার রাখে। সমাজ-সংস্কৃতি-রাষ্ট্রব্যবস্থা কেউ তাকে সম্মান না দিক – আমার দিতে অসুবিধা কোথায়?
আরও এখনও কি করে নিজেদের বাসাতেই অনেকটা ঔপনিবেশিকদের মতোই দাসপ্রথা রেখেছি তাই ভাবি। মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালবাসার অভাব? ভালবাসা পাওয়ার মতো আনন্দের আর কিছু নেই। ভালবাসলে ভালবাসা পাওয়া যায় – অন্য পন্থা আছে বলে জানা নেই।
আপনার লেখায় সব সময়ই অন্য রখমের একটি আমেজ থাকে, এই লেখায় ও তার ব্যতিক্রম হয়নি. অনেক ধন্যবাদ ফারুক ভাই. প্রার্থনা করি ব্যবসায়িক ব্যস্ততায় আপনার অসাধারণ লেখনী যাতে ব্যাহত না হয়.