রক্তের সম্পর্ক সবচে’ বড় সম্পর্ক। আপনজন যত দূরেই থাকুক, সম্পর্ক চিরকাল অটুট থাকে। কখনো ছিন্ন হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্নভাবে থাকার কারণে সম্পর্কের গভীরতা ধীরে ধীরে কমে আসে। আগের মতো অন্তরের টান তেমন আর থাকে না। তদ্রুপ অনাত্মীয়া, অচেনা অপরিচিত মানুষের সাথে অগাধ মেলামেশা এবং উদয়াস্ত মুখ দর্শণে সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ এবং অজানা একটা আর্কষণ গড়ে ওঠা খুবই স্বাভাবিক। যার সূত্র ধরে অচীরেই আমাদের কোমল হৃদয়ে জন্ম নেয়, স্নেহ মায়া-মমতা, আদর ও ভালোবাসা। যে ভালোবাসায় কোনো স্বার্থ নেই, কোনো চাহিদা নেই, নেই কোনো ঈর্ষা, ক্রোধ, পারস্পরিক অসামঞ্জস্যতা, মান-অভিমান, অভিযোগ কিছুই নেই। যার সাথে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই।
বলছিলাম, আমার এক বান্ধবী পারুলের কথা। কয়েক বছর আগে আমাদের নবাগতা প্রতিবেশী হয়ে মাত্র দু’দিনের আলাপচারিতায় ওর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পারুল খুবই মিশুকে এবং মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে। কথায় কথায় ওর টোলপড়া গালে একরাশ মুক্তাঝরা অনিন্দ্য সুন্দর হাসি ফুটে উঠতো। আর হাসিটা আমার একটা ছোঁয়াচে রোগ। কাউকে হাসতে দেখলে আমিও হাসতে শুরু করি। যাই হোক, আবেগপ্রবণ ও সরলমনা পারুল প্রথম দর্শণে এমন অন্তরঙ্গভাবে আমায় ‘দিদি’ বলে সম্বোধন করলো, ও’ যেন আমার কত দিনের চেনা! কত আপন, বহুদিনের সম্পর্ক। যেদিন ভাই-বন্ধু, স্বদেশ-স্বজন, আত্মীয়-পরিজনের সান্নিধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে এসে প্রবাস জীবনে গহীন অনুভূতি দিয়ে প্রথম অনুভব করেছিলাম, যেন স্বদেশের কোনো এক প্রান্তরে বসবাস করছি।
যাযাবরের মতো জীবন পারুলের। স্বামীর চাকুরির সুবাদে ওরা সপরিবারে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। প্রবাস জীবনে শত ব্যস্ততা এবং প্রতিকুলতার মধ্যেও আমরা অবসর যাপন করতাম টেলিফোনের মাধ্যমে কুশল বিনিময়ে। পারুল গল্প করতো মিডল-ইষ্টের। আমি উন্মত্ত চিত্তে শুনতাম, জানা দেশের অজানা কথা। এভাবেই আমাদের প্রাত্যহিক দিনগুলি কেটে যেতো। এছাড়া প্রত্যেক উৎসব-অনুষ্ঠানে, পূজা-পার্বনে একসাথে সবাই মিলে আনন্দ করতাম। কখনো প্রকৃতির মন মাতানো রূপবৈচিত্র্যে নিমজ্জিত হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত মনে সংসারের সকল বন্ধন তুচ্ছ করে, কক্ষচ্যুত উল্কার মতো বেরিয়ে পরতাম, বাইরের প্রাণোৎচ্ছল রঙ্গিন পৃথিবীতে। বিদেশী পর্যটকদের মতো আমরা দু’জন প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে শহরের বিভিন্ন মনোহরণকারী দর্শণীয় স্থানগুলি একে একে প্রদক্ষিণ করতাম।
সেদিন ছিল বাংলা নববর্ষ। বাচ্চা-বুড়ো-জোয়ান সকলেই প্রাণবন্ত উচ্ছাসে মেতে ওঠেছিল বর্ষবরণ উৎসবের আনন্দ মেলায়। অথচ সকাল থেকে দিনটা কেমন নীরব, নিরুচ্ছাস, বিষাদাচ্ছন্ন হয়ে আছে। মেঘলা আকাশ। সম্পূর্ণ কালো মেঘে ঢাকা। সূর্য্য দশর্ণের কোনো সম্ভবনাও ছিল না। কখন যে বেলা গড়িয়ে অপরাহ্ন পেরিয়ে গেল, টের পাই নি। গোধূলীর পূর্বেই ঘনিয়ে আসে অন্ধকার। মনে হচ্ছিল, এক্ষুণি ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি নামবে। এতে মানব মনেও প্রচন্ড প্রভাব পড়ে, প্রতিক্রিয়া ঘটে। মানুষের জীবনকেও করে নিয়ন্ত্রিত। প্রকৃতির সাথে মানব মনের এ এমন এক নিবিড় সর্ম্পক, সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে যার দৃষ্টান্তসরূপ সেদিন আমি নিজেই প্রকৃতিতে নিমজ্জিত হয়ে বিষন্ন মনে বসে বসে টি.ভি দেখছিলাম।
হঠাৎ টেলিফোনটা ঝন্ঝন্ করে বেজে উঠতেই মনটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আমি একরাশ উৎসুক্য নিয়ে দৌড়ে রিসিভারটা তুলতেই বুকের ভিতরটা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠলো। আহাল্লাদে গদ্ গদ্ হয়ে পারুলের ‘দিদি’ শব্দের উচ্চারণের সাথে সাথেই এক অভিনব অনুভূতির তীব্র জাগরণে আমার কোমল হৃদয়খানি আচমকা স্নেহ-মমতায় ভরে ওঠে। তৎক্ষণাৎ মনঃশ্চক্ষে উদ্ভাসিত হয়, পুতুলের মতো আমার ছোট্টবোন মিনুর শুভ্র গোলাপগালের তুলতুলে নরম দুষ্টুমিষ্টি সেই মুখমালা। আমি হারিয়ে গেলাম, কৈশরের হাজার মায়া জড়ানো সোনাঝরা দিনের অম্লান স্মৃতির মণিমেলায়। যখন মখ্মলে স্নিগ্ধ সবুজ ঘাসের প’রে প্রস্ফূটিত লাল-নীল-হলদে-বেগুনী ফুলের বিকশিত পাঁপড়িগুলিতে উড়ে এসে বসা রংবেরংএর ফড়িং, প্রজাপতি দেখলেই মিনু উর্দ্ধঃশ্বাসে ওদের হাতের মুঠোয় ধরতে ছুটে যেতো। ততক্ষণে বুদ্ধির চাতুর্য্যে ওরা চোখের পলকে ফাঁকি দিয়ে ফুরুৎ করে উড়ে পালাতো। মিনুও নাগাল পাবার আশায় দু’হাত প্রসারিত করে ওদের পিছু পিছু মরিয়া হয়ে ধাওয়া করতো।
কিন্তু কতক্ষণ, পুষ্পবাগিচার এমাথা ওমাথা বার ক’য়েক প্রদক্ষিণ করে মিনু হাঁপিয়ে উঠতো। ব্যর্থতায় ঠোঁটদুটো ফুলিয়ে, হাতের আঙ্গুলগুলি কাঁমড়ে ধরে পা-দু’টো বাঁকা করে, অশ্রুসিক্ত চোখে এমন এক অদ্ভুদ দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকতো, কিছুতেই হাসি চেপে রাখা যেতো না। ততক্ষণে মিনুর তুলকালামকান্ড শুরু হয়ে যেতো। তখন ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে, গালে চুম্বনে চুম্বনে ওর মলিন-ম্রিয়মান মুখমালায় খিল্খিল শব্দে বয়ে যেতো রাশি রাশি হাসির ঝর্ণা।
সেই দিনের পর থেকে কখন যে পারুলকে ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে ফেলেছিলাম বুঝতেই পারি নি। হঠাৎ একদিন শুনি, অবিনার্য কারণবশতঃ পারুল সপরিবারে দেশান্তর হচ্ছে। আমি তো শুনেই বিদ্যুতের শখ্ খাওয়ার মতো সারা শরীরে এমন একটা ঝটকা লাগল, মেঘের আড়ালে সূর্য ডুবে যাবার মতো মনটা আমার বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। আমি বাক্যাহত হয়ে পড়ি। চেয়ে থাকি শূন্য দৃষ্টিতে। বলে কি পারুল! কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু না, ক’দিন পরই দেখলাম, পারুলের যথাযথ প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে।
অগত্যা, করণীয় কিছুই নেই। অচিরেই ঘনিয়ে আসে স্মৃতিপটে ধরে রাখার মতো একটি বিশেষ স্মরণীয় মুহূর্ত, অর্থাৎ বিদায়ের পালা। কিন্তু বিদায় মানেই তো বিচ্ছেদ। আর বিচ্ছেদ মানেই বেদনা। যা আমার কোমল হৃদয়কে বড্ড বেশী কষ্ট দেয়। সেদিন সারারাত দু’চোখের পাতা কিছুতেই এক করতে পারিনি। পারেনি নিদ্রাদেবীর বাহুমন্ডলে গভীর তন্ময় হয়ে পরিবেষ্টিত হতে। ভিতরে ভিতরে ক্ষণপূর্বের বেদনাময় গহীন অনুভূতিগুলি নদীর ঢেউ-এর মতো বার বার মস্তিস্কের স্নায়ূকোষে এসে দংশন করতেই আমার অন্তরের কষ্ট-বেদনাগুলি তরল হয়ে দুচোখ বেয়ে নি:শব্দে বইতে থাকে। তখন মনে পড়ে, ঠিক এমনি করেই অদৃশ্য মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে, অশ্রুজলে হৃদয়ের দুকুল প্লাবিত করে চিরদিনের মতো বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছিল আমাদের বুলবুল।
বুলবুল ছোট্ট একটি পাখী। একদিন হঠাৎ প্রবল ঝড়ের মুখে কোথা থেকে উড়ে এসে আমাদের রান্নাঘরের চাল ঘেঁষা বিশাল পেঁপে গাছের ডালে চুপটি করে বসে থরথর করে কাঁপছিল। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল ওর সারা শরীর। কোন এক প্রাণী কাঁমড়িয়ে ঘা করে দিয়েছিল। তাড়া করলেও যাচ্ছিল না!
অবশেষে মিনুর একান্ত পীড়াপীড়িতেই পাখীটিকে আশ্রয় দেওয়া হলো, দো-তলা ঘরের সিঁড়ির কোণায় এবং যথাযথ সেবা-শুশ্রূষায় সুস্থ-সবল হয়ে দু’দিনেই একটি ফুটফুটে ছোট্ট শিশুর মতো পাখীটি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তখন ছেড়ে দিতে আর মন চায় কখনো! বুলবুল নামকরণেই রয়ে গেল আমাদের পোষা হয়ে। থাকতো খাঁচার ভিতর। আর অব্যক্ত আনন্দে উতলা হয়ে মিনু নাওয়া খাওয়া ছেড়ে সারাদিন খাঁচা ধরে বসে থাকতো। বুলবুলকে কখনো একা থাকতে দিতো না। অথচ নিজে অবোধ শিশু, আর বুলবুল একটা অবলা প্রাণী। মিনু সারাক্ষণ আবোল-তাবোল বকতো ওর সাথে। বুলবুলের মা-বাবা কোথায়? হারিয়ে গ্যাছে কি না! ওর মন খারাপ হচ্ছে কি না! ওর ঠোঁটটা এতো লম্বা কেন? ওর দাঁত নেই কেন? খাবার চিবোয় কিভাবে? হাজারটা প্রশ্ন মিনুর। আর বুলবুলও যেন কত বুঝতো! ক্ষণে ক্ষণে পাখনা মেলে নেচে উঠতো আর কানে তালা লাগিয়ে কর্কশকন্ঠে ওর ভাষায় গেয়ে উঠতো, “টিরিট্টি, টিরিট্টি!”
একদিন খাঁচাটা বারান্দার কার্ণিশে ঝুলিয়ে রাখতে গিয়ে মাটিতে পড়ে খাঁচার দরজাটা বেঁকে যায়। শক্ত তার দিয়ে বেঁধে দেওয়া সত্ত্বেও কিছুতেই খাঁচার দরজাটা আর বন্ধ হতো না। ভয় হতো, জন্তু-জানোয়ারের কি ভরসা! বুলবুল উড়ে না পালিয়ে যায়!
কিন্তু তার পরেও প্রায় নয়মাস প্রভুভক্তের মতো পোষা হয়ে ছিল। ভাবলাম, বুলবুলও বোধহয় আমাদের মতো মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছে। ওদের অন্তরেও মায়া-মমতা-ভালোবাসা আছে। কিন্তু ওযে একটা পশু-পাখী, মানুষের আদর ভালোবাসার মর্ম কখনোই বুঝবে না। যার মূল্য কোনদিনই দিতে পারবে না। আর সেটাই দৃষ্টান্তসরূপ প্রমাণিত করে, একদিন দিগন্তের প্রান্তরে উষার প্রথম সূর্য্যরে উজ্জ্বল আলো উদ্ভাসিত হবার পূর্বেই বুলবুল কখন যে খাঁচা থেকে বেরিয়ে উড়ে পালিয়ে গেল, আমরা কেউই টের পেলাম না। ভাবলাম, এমন আনন্দময় হাস্যেজ্জ্বল নির্মল সকাল, বাইরের মুক্ত গগনে বিশুদ্ধ বাতাস কিছুক্ষণ উপভোগ করে নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। কিন্তু বুলবুল আর ফিরে আসে নি। হয়তো ভুলে গিয়েছিল ফিরে আসার পথ। কিংবা বিগতদিনে প্রবল ঝড়ের বেগে হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ওর সঙ্গী-সাথীদের পুণর্মিলনের আনন্দে নিশ্চয়ই ভুলে গিয়েছে, সদ্য ফেলে আসা অনাকাক্সিক্ষত বন্দী জীবনে ক্ষণিকের পাওয়া মাবনপ্রীতি এবং একটি অবোধ শিশুকন্যার আদর ও তার হৃদয় নিঃসৃত কোমল ভালোবাসা। কে জানে!
বেচারী মিনু নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে প্রতিদিন ছাদে গিয়ে বুলবুলের পথ চেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতো। কোন সিঙ্গেল পাখী উড়ে যেতে দেখলেই হাতদু’টো নেড়ে বলতো,-“এই তো বুলবুল, আমি এইখানে! আয়, শীগগির নীচে নেমে আয়।”
কিন্তু কোথায় বুলবুল! আকাশের গায়ে অন্ধকার ঢলে পড়লেই মনবেদনায় কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলতো মিনু। ওর ওই দূরাবস্থায় আমরাও মর্মাহত হতাম। কিন্তু কতদিন! দিন যায়, মাস যায়, কেটে যায় বছরের পর বছর।
ততদিনে শৈশবের ধূলোবালি ঝেড়ে ফেলে মিনু কৈশরে, আমি যৌবনের চৌকাঠে পৌঁছেই একসময় হৃদয়পটভূমি থেকে একটু একটু করে মুছে যেতে লাগল, বুলবুলের স্মৃতি। অপসারিত হয়ে গেল, হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা বুলবুলের প্রতি আদর ও ভালোবাসা। ছিন্ন হয়ে গেল আমাদের বন্ধন।
হয়তো এমনি করেই একদিন পারুলও আমাদের ভুলে যাবে। ভুলে যাবে ঋতুর মতো পরিবর্তিত জীবন যাত্রার অন্তবিহীন পথ চলতে চলতে পিছনে ফেলে আসা ক্ষণিকের হৃদয় স্পর্শ করা আনন্দঘন মুহূর্তের কিছু স্মৃতি। ভুলে যাবে, বর্ষণমুখর একাকী নির্জন সন্ধ্যায় টেলিফোনে ওর উচ্ছাসিত আলাপন, হাসি-গুঞ্জরণ ও ভালোবাসার অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। যা প্রাত্যহিক জীবনে আমার স্মৃতির পথে অম্লান পাথেয় হয়ে থাকবে।
সমাপ্ত
যুথিকা বড়ুয়া : কানাডার টরোন্টো প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।