মেয়েরা স্কুলে এডজাস্ট করার চেষ্টা করছে । ইংরেজী শেখার জন্য ওদের কে ( E SL )English as a second Language ক্লাশে দিল । বন্ধু , পরিবেশ , শিক্ষক ,ভাষা সব ই নতুন কিন্তু তাতে কি ! মাত্র তিন মাসেই ভাষা রপ্ত করে ফেলল । এখন আর ESL ক্লাশ লাগে না । কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের । আমরা দেশে থাকতে কি সুন্দর করে বাচ্চাদের পড়াতে পারতাম আর ওরাও ভাজা ভাজা করে উত্তর দিত । এখানে বাসায় কোন পড়া দেয় না যদিও ২/১ পৃষ্ঠা ফটো কপি করে দেয় হোম ওয়ার্কের জন্য , বই দেয় না । আমি নিজেও বুঝিনা ,কোথা থেকে পড়াব , বই নাই । আমি অনেক টা আশা নিয়ে টিচারকে বলতে গেলাম সমস্যার কথা , আমাকে বললো বাচ্চাদের পড়া টা এঞ্জয় করতে দাও । আর তুমি রিলাক্স করো ।
আমি ইতিমধ্যে ইংরেজী ক্লাশ বাদ দিয়ে বাচ্চাদের স্কুলেই ভলান্টারি শুরু করি ওখানকার সেটেলমেন্ট ওয়ার্কারের সাথে ( new comer দের জন্য) আস্তে আস্তে আমি ওদের ফান্ড রাইজিং কমিটি থেকে শুরু করে স্কুলের উন্নয়ন মূলক সব কাজে জড়িয়ে পড়ি । আমি সে জন্য ব্রাজিলিয়ান এক মেয়ে যে কিনা নর্থ ইয়র্কের হেড অফ দি ডিপার্মেন্ট ( লিনেট ইনো )তার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ । আসলে নিজেকে চরম ভাবে ব্যস্ত রাখি আর আশা করি আমার হাজব্যান্ডের একটা ভালো চাকুরী হবে । ইতিমধ্যে দেশ থেকে খবর আসলো আমার শ্বশুর খুব অসুস্থ্য । আমাদের সাথেই উনি ছিলেন ১২ বছ র । আমরা চলে আসাতে অনেক ডিপ্রেসড হয়ে যান , শেষে হার্ট এটাক । এই রকম পরিস্থিতি দেশে ফোনও করতে হয় খুব হিসেব করে । প্রতি মিনিটে ১ ডলার চার্জ করত বেল কানাডা । ফোন কার্ড যে পাওয়া যায় তাও জানতাম না । কিন্তু অবশেষে সেই খারাপ খবর টি আসলো ।
এখানে একটু বলি কানাডায় আসার পর কানাডিয়ানদের কাছ থেকে যত সহযোগিতা পেয়েছি তেমন বাংগালীরা সাহায্য দূরে থাকুক একটা ইনফরমেশনও দিত না যারা আগে এসে কোন কাজ পেয়েছে তারা তো মহাজ্ঞানী । তাতে কি দেখা গেল এই চাকুরী না পাওয়া দলই মাশাল্লাহ অনেক বড় ! দিনে দিনে অনেক বাংগালীদের সাথে পরিচয় হলো যদিও তারা দূরে থাকত । সারাদিন ইমিগ্রেশন এর গুষ্ঠী উদ্ধার হচ্ছে কিন্তু সান্ত্বনা আর বাস্তবতা কারোরই মনের মত চাকুরী নাই । কানাডা যেহেতু ওয়েলফেয়ার কান্ট্রি যে কেউ চাকুরী না করলে সরকারী সাহায্য পেতে পারে কিন্তু যারা সরকারী সাহায্য নিবে তারা পরবর্তীতে ফ্যামিলি ইস্পন্সর করতে পারে না ( তাই অনেকে সরকারী সাহায্য নেয় না ), সাথে চাইল্ড ট্যাক্স পায় , সুতরাং স্ট্যান্ডার্ড মেইন্টেইন করেই সবাই চলতে পারে । ( আমি আসলে এখানকার সিস্টেম টা জানাতে চাইছি )
ডিসেম্বর মাস এসে গেল আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত স্নো আর আসে না । কিন্তু প্রচন্ড ঠান্ডা বাইরে ।আসার সময় আমার ছোট ভাই খুব আফসোস করছিল সে যদি আসতে পারত তবে স্নো চিনি দিয়ে খেতে পারত!! আমার মেয়েরাও সেই আসায় আছে । ডিসেম্বরের শেষে প্রচন্ড তূষার ঝড় হলো ৩ দিন ব্যাপী আর সেই বরফ গলতে সময় লাগলো এপ্রিল পর্যন্ত । আমাদের ও সাধ মিটে গেল এ জিনিষ দেখার । ইতিমধ্যে আমার হাজব্যান্ডের এক জুনিয়র কলিগ সস্ত্রীক দেশ থেকে এসে আমাদের বাসায় ঊঠেছে ।ওরা আলাদা বাসা নিতে চাইলেই আমার মেয়েদের চোখে পানি চলে আসে । অবশেষে মাস দুয়েক পরে ওরা মন্ট্রিয়েল চাকুরী নিয়ে চলে গেল । এই প্রথম দেখলাম কেঊ নিজের লাইনে কাজ পেয়েছে ।
আমরাও এখান কার জীবন ধারার সাথে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করছি । সব কাজ নিজে হাতে করি বাইরে ও কাজ ,সব সামাল দিয়েও আমার মনে হয়, না ভুল করিনি এখানে এসে । বাচ্চাদের স্কুল , লাইব্রেরী , বিশাল খেলার মাঠ ,আর রাস্তা ঘাটে নিরাপত্তা ,উপরন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থা ফ্রি, কোথাও গিয়ে ঠেলাঠেলি নাই । অফিসে যার যার মত কাজ করছে । ঘুষ , দেন দরবারের বালাই নাই , লাইনে দাড়ালে নির্দিষ্ট সময়ে ডাক পড়ছে , স্কুল ফ্রি । এ তো সব পাওয়ার মাঝে শুধু একটা চাকুরীর জন্য আফসোস করে লাভ কি ! পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ভালো কিছু হবে এই আশায় অনেকে প্রফেশনাল চাকুরীর আশা না করে যে যেখানে পায় কাজ খুজতে লাগলো । আমার হাজব্যান্ডও গাড়ী চালাবার লাইসেন্স নিল । খুব আশা করে বেচারা একটা গাড়ী কিনেছে , প্রথম দিন বাচ্চাদের নিয়ে আমাকে কাজ থেকে আনতে গিয়েছে , বাসা থেকে ১৫ মিনিট হাটা পথ। গাড়ী আর চলে না । লোকজন ঠেলা দিল কাজ হয় না । বাসা পর্যন্ত গাড়ী আসল, কিন্তু গাড়ীর বয়স এতো হয়েছে যে কোন দাওয়াই তার কাজে লাগবে না । অবশেষে ২ দিন পরে যার গাড়ি সে টাকা ফেরত দিয়ে গাড়ী টো করে নিয়ে গেল ।
সব কিছুই সুন্দর মত ই চলছিল জুন মাসের প্রথম দিকে এক অপ্রাত্যাশিত ঘটনা ঘটল । প্রতিদিনের মত বেলা ১১ টার শিফটে ্মেয়েকে স্কুলে দিয়ে অন্য দুটো বাচ্চাকে ম র্নিং শিফট থেকে নিয়ে বাসায় আসছি । চাবি দিয়ে লক ঘুড়াই দরজা খুলতে পারি না । আবার ও চেষ্টা করি , না কাজ হচ্ছে না । স্পষ্ট শুনতে পারলাম ঘরের ভিতর দৌড়া দৌড়ী্র শব্দ , ভিতর থেকে দরজা ধরে রেখেছে কেউ । আমি বাচ্চা ( একটা চাইনিজ একজ ইন্ডিয়ান) দূটোকে নিয়ে করিডোরে দাড়ালাম । আশে পাশে সাহায্য পাব না বলেই ধরে নিয়েছি , কারন সব তামিলদের আড্ডা খানায় আমরা । তারা বীর দর্পে বেড়িয়ে গেল , চেয়ে চেয়ে দেখলাম । ভিতরে ঢুকেই তছনছ অবস্থায় সব পেলাম । আমি ও পুলিশ কে ফোন দিলাম । আমার যত টুকু গহনা ছিল আর কিছু নগদ টাকা সব নিয়েছে । কেমন যেন অসহায় লাগতে থাকলো । বিশ্বাস হতে চাইছিল না । কান্না চলে আসলো । কিন্তু ভুলে গেলে চলবে কেন তামিল টাইগার , গায়ানিজ এইসব গাঞ্জা খোর সব দেশেই আছে । আর এরা নিজেদের পায়ে নিজেরা কূড়াল মারে । এই সব জানি দোস্তরা একসাথে ঘুরে, ড্রাগস নেয় আবার গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে মারামারি করে । এ সুন্দর একটা দেশ কে নষ্ট করার জন্য এমন কিছু লোক থাকলেই হলো ।
( চলবে )