নরওয়ে থেকে:-
নরওয়ে, ইউরোপের স্কান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলের একটা দেশ। নরওয়ের রাজধানীর নাম ওসলো , অসম্ভব সুন্দর সুন্দর গ্রাম এবং শহরের সমষ্টিতে নরওয়ের গঠিত। নরওয়ে সম্মন্ধে বাংলাদেশী মানুষ , বাংলাদেশী পত্র পত্রিকা, টিভি মিডিয়া ও অন্নান্য মিডিয়ার অনেক ভুল ধারণা আছে। অনেক সুশিক্ষিত বাংলাদেশিও আছেন যারা নরওয়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্মন্ধে কি, পৃথিবির মানচিত্রে নরওয়ের জিওগ্রাফিক অবস্থান কোথায় তাও ভালো করে জানেন না।
১৯৭০ সালের পর থেকে নরওয়ে খুব তাড়াতাড়ি ধনীরাষ্ট্রে পরিণত হতে থাকে, আর এর একটাই কারণ , আর তা হলো নরওয়ের অয়েল সম্পদ ও অয়েল টেকনোলজি। আটলান্টিক সাগরের তীরবর্তী দেশ হওয়ায় লক্ষ্ লক্ষ টন মৎস বিক্রি থেকে প্রতি বৎসর নরওয়ের সরকার অনেক অনেক ইনকাম করে থাকে। নরওয়ের মোট জনসংখ্যা মোট ৫০ লক্ষ এবং এর সম্পদের পরিমান ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ক্রোনার।
নরওয়েজিয়ানরা তাদের নিজ ভাষা নরওয়েজিয়ানে কথা বলে এবং ১৭ ই মে হচ্ছে এদের জাতীয় দিবস। বাংলাদেশের সাথে নরওয়ের ভালো একটা সম্পর্ক আছে এবং বাংলাদেশের নানা উন্নয়ন মূলক কাজে নরওয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা দিয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশের রাজশাহী শহরের সাথে নরওয়ের ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড শহরের বিশেষ বন্ধুত্বের সম্পর্ক এবং সে জন্য প্রতি ৩ বৎসর পর পর ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড সিটি কর্পোরেশন বন্ধুত্ব হিসাবে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনকে বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজে অনুদান দিয়ে থাকে। বন্ধুত্ব স্বরূপ প্রতি বৎসরের ১৭ ই মে তে বাংলাদেশের রাজশাহী শহর থেকে ৩ জন শিল্পী এবং ২ জন কর্মকর্তা নরওয়ের ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড শহরে আসেন ওদের জাতীয় দিবসে পারফর্মেন্স করতে। যেহেতো বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল দেশ এবং কোনো যুদ্ধ বিদ্ধস্ত অবস্থাপন্ন নয় তাই বাংলাদেশিরা সাধারণতো নরওয়েতে এসাইলাম পাননা। বর্তমানের নতুন প্রজন্মের স্তায়ীভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশী ছেলেমেয়েদের বেশির ভাগেরই স্বামী কিংবা স্ত্রী ইউরোপিয়ান , আর স্পাউস ইউরোপিয়ান হওয়ার কারণেই নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশিরা নরওয়েতে স্থায়ি হতে পেরেছেন। সম্মানের বিষয় হচ্ছে অনেক বাংলাদেশী অধ্যাপক নরওয়েজিয়ান ভিবিন্ন উনিভার্সিটিতে দক্ষতার সাথে শিক্ষকতা করছেন এবং অনেক বাংলাদেশী ইঞ্জিনিয়ার রা আছেন যারা নরওয়েতে মাল্টি ন্যাশনাল ভিবিন্ন কোম্পানিতে ভালো ভালো পদে অধিষ্ট আছেন। নরওয়েতে ভালো ডাক্তাদের অনেক অভাব, তাই বাংলাদেশী ডাক্তারদের জন্য নরওয়েতে জব করার বিরাট সুযোগ আছে বলে আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি।
যেহেতু নরওয়ের পৃথিবির অন্যতম ধনী দেশগুলোর একটা তাই অন্নান্য ধনী দেশগুলোর মতো নরওয়েতে অনেক ইম্মিগ্রান্টদের বসবাস। এখানে পাকিস্তানী, সুমালিয়ান, টার্কিশ, সার্বিয়ান, রোমানিয়ান,পোলিশ, থাই, ভিয়েতনামি, এবং ব্রাজিলিয়ান ইম্মিগ্রান্টদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। সাউথ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানিরা সংখ্যার দিকে অনেক অনেক বেশি এবং নরওয়ের রাজধানী অনেক অংশে পাকিস্তানিদের দখলে বললেই চলে। নরওয়ের বর্তমান ভাইস প্রাইমিনিস্টার আবিদ রাজা পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত।
মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে সামান্য সামান্য করে বাংলাদেশিরা স্কান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে আসতে থাকেন, এবং বেশির ভাগই হয়তোবা সুইডেন অথবা ডেনমার্কে বসবাস গড়ে তুলেন। তবে যে কোনো কারণেই হোক ওই সময়ে স্কেন্ডিনেভিয়ান অঞ্চলে আসা বাংলাদেশিদের কাছে নরওয়ের চাইতে সুইডেন ও ডেনমার্ক অনেক বেশি আকর্ষণীয় ছিল।
১৯৭১ থেকে এখন পর্যন্ত নরওয়েতে বিভিন্ন কারণে যতই বাংলাদেশিরা আসেন নাই কেন, নরওয়েতে স্থায়ি কিংবা অস্থায়ী সর্বমোট বাংলাদেশিদের সংখ্যা কোনোদিনই ৮ হাজারের উপরে উঠেনি। এখন পর্যন্ত নরওয়েতে স্থায়ি ভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশি আছেন সর্বমোট ৫০০০। বাকি যারা ৩০০০ আছেন তারা হয় ইল্লিগ্যালি আছেন নয়তোবা পড়াশুনা করছেন বলে আছেন। নরওয়েতে ৪টা বড়ো শহরে সবচে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশিদের বসবাস আর শহরগুলো হচ্ছে অসলো, বের্গেন, স্টাভাঙ্গার এবং ট্রোমসো। নরওয়েতে বসবাসকারী ৯০% বাংলাদেশীই মোটামোটি উচ্চ শিক্ষিত এবং তুলনা করলে অন্নান্য দেশীয় ইম্মিগ্রান্টদের থেকে বাংলাদেশীরা মোটামোটি ভালোই আছেন।
নরওয়েতে বসবাসকারী ইম্মিগ্রান্টদের একটা বিরাট অংশ বর্তমানে কাজহীন বেকার এবং সরকারের দেওয়া সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। তবে একটা ভালো জিনিস যে এখানে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের ৯০% ভাগ বাংলাদেশীই কাজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ত এবং নিজেদের গাড়ি বাড়ি নিয়ে ভালোই আছেন। আমাদের বাংলাদেশিদের মধ্যে অনেক কিছু কমতি থাকলেও একটা খুব ভালো জিনিস আছে আর তা হচ্ছে কাজ করে করে উপরে উঠবার মন মানুষিকতা। যেখানে অন্নান্য দেশীয় ইম্মিগ্রান্টরা একটা নির্দিষ্ট পরিমান অর্জনেই খুশি ও ভুগে বিলাসে লিপ্ত সেখানে বাংলাদেশিরা নির্ভার কর্মময়। আমার দশ বৎসরের নরওয়ের জীবনে খুব কম সংখ্যক বাংলাদেশিদের সাথে দেখা হয়েছে যারা অল্পতেই সন্তুষ্ট। আর এই জিনিসটার একটা পজেটিভ দিক আছে, আর সে কারণেই যেখানে অনন্যানোরা বেকার দিন কাটায় সেখানে আমরা বাংলাদেশিরা দিন রাত কাজ করে যাচ্ছি। খুশির ব্যাপার যে বর্তমানে নরওয়ে সম্মন্ধে বাংলাদেশী ছাত্র ছাত্রীরা অনেক বেশি জানেন এবং প্রতি বৎসর আগস্টে বাংলাদেশ থেকে বেশি বেশি সংখ্যক ছাত্র ছাত্রী নরওয়েতে আসছেন। তবে যেকোনো নতুন দেশে আসবার আগে ওই দেশ এবং সমাজ সম্মন্ধে জেনে আসাটাই ভালো। নরওয়ে যেহেতো অনেক অনেক ব্যায়বহুল একটা দেশ এবং নরওয়েজিয়ান জানা না থাকলে এবং পরিচিত কেউ না থাকলে এখানে যেকোনো কাজ পাওয়া দুস্কর তাই দেশে পারিবারিক ভাবে অর্থনৈতিক অবস্থা মজবুত না থাকলে নরওয়েতে ছাত্র ভিসায় না আসাটাই ভালো।
নরওয়ের ম্যান্ডাল শহর থেকে সবাইকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো। সবাই ভালো থাকবেন, দেশ, জাতি ও পরিবার পরিজনদের প্রতি যত্নবান হবেন।
ছবি : শরীফ সাদর । সিলেটের ছেলে এবং সাউথ নরওয়ের বাসিন্দা। পারিবারিক কারণে নরওয়েতে আসা।