কোনো বিশেষ দিনকে ভালোবাসা দিবস হিসেবে উদযাপন করা আর বাকি তিনশত চৌষট্টি দিন এর বহিঃপ্রকাশ না থাকা ভালোবাসার হিসাব নিকাশের মধ্যে পড়ে কিনা তা জানা নেই। হিসাব নিকাশ করে সম্ভবত ভালোবাসা হয়ও না তা সন্তানের জন্যই হউক অথবা স্ত্রী, মা বাবা, ভাই বোন বা বন্ধু বান্ধবের জন্যই হউক । মনের গহীন কোণে বাস করা বর্ণনাতীত, কল্যানকর এক অনুভূতিই ভালোবাসা । এটি না থাকলে জীবন ও জগৎ হয়তো নিস্প্রান, নিষ্প্রভ ও “রোবটিক” হয়ে উঠথো, মানুষ হয়তো হারাতো বেঁচে থাকার প্রেরণা । একটু খেয়াল করলে ভিন্ন ধাঁচের ভিন্ন ভিন্ন ভালোবাসার অস্তিত্ব অনুভব করা যায় । কোনো কোনো ভালোবাসায় আমরা প্রতিদান আশা করি আবার কিছু ভালোবাসা আছে যেখানে প্রতিদানের বিন্দুমাত্র প্রত্যাশা নেই । যেমন মা বাবার ভালোবাসা । নিদারুন দুঃখ কষ্টের মধ্যে প্রতিপালন করলে ও তারা প্রতিদানের আশায় এটি করেন না । প্ৰতিদানহীন এই ভালোবাসায় তারা বুকের মধ্যে চেপে রাখেন কষ্টের পাহাড় কিন্তু সন্তানের কাছে সারাজীবন হয়ে থাকেন বরফ গলা নদী । এই ভালোবাসার তুলনা নেই. তুলনা করার চেষ্টাও বৃথা।
ছেলেমেয়েদের বেলায় আবার ভালোবাসার ভিন্ন ভিন্ন রূপ প্রত্যক্ষ করি। বিশেষ বয়সে ছেলেমেয়েদের মা বাবার প্রতি বিশেষ একটি ভালোবাসা কাজ করে । বিশেষ করে এরা যদি বয়সে ছোট হয়। উদাহরণ দেই, হয়তো আমি একান্তে বসে টিভি দেখছি, মেয়ে এসে হঠাৎ করেই গলা জড়িয়ে ধরে বাবার খুব ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা শুরু করলো। বুঝতে পারছি তার আকস্মিক এই আদর এবং বিনয়ের অবতার হওয়ার পিছনে গূঢ় রহস্য কিছু একটা আছে। একটু পরেই হয়তো আবিষ্কার করলাম বিশেষ কোনো জিনিস কেনার জন্য এটি মন গলানোর একটি প্রয়াস । সব সময় না হলেও মাঝে মাঝে আমরা অনেকেই হয়তো এরখম ভালোবাসায় সস্নেহে বাধা পড়ি। যে আবদারের ভালোবাসার কথা ভেবে এখন হাসি, একসময় হয়তো এর জন্যই কাঙাল হয়ে প্রতীক্ষায় থাকবো। আমাদের মেয়ে হয়তো এক সময় ভালোবাসার প্রদীপ জ্বালাতে অন্য কারো গৃহে, জীবনে প্রবেশ করবে। সময়ের বিবর্তনে একসময়ের ছোট ছোট এই স্মৃতি গুলোই অম্লান হয়ে থাকবে আমাদের জীবনে। এক সময়ে কোনো এক অলস মুহূর্তে এগুলোই হয়তো চোঁখে বয়ে আনবে অন্য রকম ভালোবাসার বাঁধ ভাঙা স্রোত. প্রকৃতি তার অমোঘ নিয়মে জীবনের এক এক পর্যায়ে ভালোবাসার এক এক রূপ নিয়ে হাজির হয়। এর নিগূঢ় রহস্যের স্বরূপ উদঘাটন আমাদের সাধ্যের বাইরে।
প্রবাস জীবনে আমি নিজে এমন কিছু বৈরী সময় অতিক্রম করেছি যখন স্ত্রীর নিরন্তর ভালোবাসা, অনুপ্রেরণা ছাড়া জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়া কঠিন ছিল । সংসারকে শান্তিময় করে তুলতে স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসার কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বাস, আস্থা আর পারস্পরিক সম্মানবোধের ভিত্তিতে গড়ে উঠা এই সম্পর্কে নিখাদ ভালোবাসাই জীবনের সব ঘাত প্রতিঘাতকে প্রতিহত করতে সাহায্য করে, গড়ে তুলে এমন এক বন্ধন যা ছাড়া সুখ, শান্তি ও সার্থকতা আসে না জীবনে।
ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এক এক জনের এক এক রকম। কেউ ঘটা করে এর প্রকাশে আনন্দ পান, আবার কেউ একে আনুষ্টানিক ভালোবাসা মনে করে অনাড়ম্বর, নিভৃত বহিঃপ্রকাশেই স্বস্তি খুঁজে বেড়ান। বহিঃপ্রকাশ যাই হউক, স্বর্গীয় এই অনুভূতিকে হৃদয়ে লালন এবং পরিচর্যা করার করার মধ্যেই সত্যিকারের সুখ এবং কল্যান নিহিত। শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, সামষ্টিক জীবনেও এর প্রয়োজনীয়তা কখনো ফুরিয়ে যাবে না । আমাদের ত্রস্ত,ব্যস্ত যান্ত্রিক জীবন আর সংঘাতময় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব নিয়ে নুতন করে ভাবনার অবকাশ আছে। শান্তি এবং সম্প্রীতি স্থাপনে এর অন্য কোনো বিকল্প নেই। মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির ভাষায়, “ভালোবাসার আলোয় প্রতিটি মুহূর্তই বিমূর্ত হয়ে উঠতে পারে”. কামনা করি নির্মল, অকৃত্তিম ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক সবার জীবন । শুধু চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি নয়, মঙ্গলময় এই অনুভূতি আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখুক আজীবন, বয়ে আনুক অনাবিল, অন্তহীন প্রশান্তির ছোঁয়া । মহাজাগতিক কোনো এক মায়াবী আলোয় আলোকিত হয়ে উঠুক আমাদের ভুবন।
সৈয়দ মসিউল হাসান
টরন্টো থেকে