ফ্লোরিডা থেকে:-
আমাদের এই জীবনের খন্ড ক্ষুদ্র আশা ভালোবাসা গুলো,
আকাশের ছেড়া ছেড়া মেঘের মত ,কখনও পরিপাটি কখনও অগোছালো । এই যে আজকের এই পূর্ণিমার চাঁদ , আমি কোথায় রাখি তারে , কি করি ? এই যে আমার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে চাঁদের এই তরল অংশুময়তায় আমি কি করে আমার মনের কণা গুলোকে একসাথে করি জড়ো ?
সের্গেই ইয়েসিনিনিনকে আমি ভালোবাসি কিন্তু সে এক বোবা ভালোবাসা, আমি তার শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাইনে , সে যখন এমন চাঁদনী রাতকে “অস্বস্থিকর চন্দ্রীমার তরলতা ” (не уютная лунная жидкость) জাতীয় একটা কিছু বলেন তখন আমার মাথা পুরোপুরি বিগড়ে যায়। আমার এই বোবা ভালোবাসায় আমি টের পাই আমার বিড়াল মাসা যেমন ভালোবাসে আমাকে
ঠিক তাই অথবা আমার কুকুর মেল ভালোবাসতো যেমন। মেল আর নেই , মরে গেছে । যেমন আজই মৃত্যু সংবাদ এসেছে এক বন্ধুর। আমার বন্ধুরা বা বন্ধুর বন্ধুরা চলে যেতে শুরু করেছে , আমার মন এই সব চলে যাওয়ায় প্রতিবাদ করে কাঁচের মতই ভেঙে চুরমার হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
মৃত্যুর সাথে সাথেই যে ভালোবাসা শেষ হয়ে যায় তার জ্বলজ্যান্ত প্রমান আমার কুকুর মেল। আমি যেদিন চলে যাবো যা কিছু অনুভূতি আমাকে জীবিতের সার্টিফিকেট দেয় আমি বাক্সে ভরে নিয়ে যাবো সাথে করে। হ্যা , আমার দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয় আমার জন্যে নয় আমার ভালোবাসার মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য ।
বয়স যখন অল্প ছিল ভালোবাসার ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ির পর্যায়ে ছিল, মনে হতে ভালোবাসা ছাড়া বাঁচা সম্ভব নয় মোটেই, এখন বুদ্ধি বেড়ে ভালোবাসার আমিষ নিরামিষ গুলো কিছুটা স্বচ্ছ হতে শুরু করেছে, তারপরেও মনে হয় সেই একই রকম । বয়েস বেড়ে লাভ কি হল বুদ্ধিই যদি বাড়লোনা? তারপরেও চাঁদ ও সূর্যের মাঝের শূন্যে ওড়ে যে প্রজাপতি সে ইথারের কম্পন ফোনে অভিযোগ করে ,”তুমি আগে খুব ভালোবাসতে এখন আর বাসোনা!”
আমি ছোটকালে লেনিনকেও খুব ভালোবাসতাম, কারন মনে হয়েছিল মানুষে মানুষে সাম্যের মধ্যে দিয়েই মুক্তি আসতে পারে। তারপরে বয়েস বাড়লো আমি গ্যাটের ড. ফাউস্টের সংস্পর্শে এসে বুঝলাম জীবনের সমীকরন এত সরল নয়। তাই বার্লিন ওয়ালে যখন ফাটল ধরল আমি হাইড পার্কে মার্কসের সমাধীতে গেলাম অশ্রু সিক্ত যৌবনের স্বপ্ন বিসর্জন দিতে। কবরখানার বৃদ্ধ দ্বার রক্ষক আমার পাশে এসে বসে গল্প করলো :” আগে বহু লোক আসতো, এখন খুব কেউ আর আসেনা।”
আগে আমার মনে হতো ঈশ্বর নেই, এখনও তাই মনে হয় , মানুষের এবং মানবতার মুক্তির সাথে ঈশ্বরের যেন কি একটা ইনভার্স সম্পর্ক রয়েছে । অথচ কি যেন একটা গোঁজামিল কোথায় : ঈশ্বরের না থাকায় যেমন , আবার তার থাকায়ও তেমনই।
আমাদের পাল রাজারা সেই প্রাচীন যুগে বৌদ্ধধর্মের মানবতার বাণী হিমালয়ের বাঁধা অতিক্রম করে পৌঁছে দিয়েছেন সুদূর চীন ও মঙ্গোলিয়ায় । যে ধর্মপালকে নিয়ে আমাদের এক রত্তি মাথা ব্যথা নেই সেই তারই নাম মঙ্গোলিয়ায় বৌদ্ধ মন্দিরে কত শ্রদ্ধাভরে নিতে দেখে এলাম । আমার তখন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের শুধুমাত্র একজন বাংগালী হতে বাঁধা লাগলো, আমার তখন সেই পাল রাজাদের মতই এক মহান ভারতীয় হতে দ্বিধা লাগলোনা। পালেরা স্রষ্টা: সামান্য কাদা মাটি থেকে কত সুন্দর সুন্দর পাত্র ও ফিগার তৈরী করে, মূর্তি বানায় , এক কথায় ঈশ্বরের মত সৃষ্টিতেই তাদের আনন্দ।
অথচ অ্যাসেরিয়ার অসুরবনিপাল ছিল যে সেই পাল নয় ; একে তো অসুর তার ওপরে বনি ( বন্য) । সে যখন তার শকটে চড়ে রক্তের শহর নিনেভে ঘুরে বেড়াত তার চাকার সাথে বাঁধা থাকতো তার দ্বারা বিজিত রাজ্যগুলোর রাজারা । কি নৃশংস , ওরা শত্রুর কর্তিত মাথা গুনে গুনে নিজেদের বীরত্বের পরিমাপ করতো। এই অসুরবনিপাল পাল রক্তের গঙায় ভাসিয়ে দিয়েছে দুনিয়া । অথচ সে-ই আবার অ্যাসেরিয়ার প্রথম সম্রাট যে লিখন পদ্ধতি আবিস্কার করেছে, শুধু তাই নয় , মাটির ব্লকে বই লিখিয়ে তাদের সংরক্ষন করেছে মানব ইতিহাসে প্রথম লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা করে । এবং তার এই কীর্তির কারনেই আমরা জানতে পেরেছি প্রাচীন সুমেরের ইতিহাস, সাহিত্য, জীবন যাপন, ধর্ম বিশ্বাস, ম্যাথমেটিক্স এবং এস্ট্রোনমী সম্পর্কে।
লাইব্রেরি অবশ্য মসজিদ, মন্দির , গির্জা, বা প্যাগোডা নয় , সংসদ ভবন বা শুরিখানাও নয় , সুতরাং কাজটা সে ভালে করেছিল কিনা আজকের বাস্তবতায় ভিন্ন মূল্যায়ন হতেই পারে । “অতি ধার্মিক” ও “অতি বেধার্মিক” দের যে হৈ চৈ সারা দুনিয়া তটস্ত করে রেখেছে এখন বলাই মুসকিল , কে কার পূজা করে আর কে কারে সিন্নি বিলায় । কে তালগোল পাকায় আর কে পাকানো তালগোলে বাছুরের মত লেজ নাড়ায় বা লাফ মারে ।
সাইথিয়ানরা ছিল বীর ও বর্বর । ওদের যুদ্দ্ধ দেবতা ছিল পাহাড়ের চুড়ায় মাটিতে প্রথিত এক মস্ত বড় তলোয়ার, ওরা প্রতি শততম যুদ্ধ বন্দীর ঘাড়টা ঘ্যাচাং করে ঘষে দিত ওই তলোয়ারে । মনুষ্যকূলে ইনিই সবচেয়ে দীর্ঘজীবী দেবতা, প্রেমের দেবী মরেছিলেন ট্রয়ের যুদ্ধে অথবা কোন সতীদাহের চিতায়। এই সাইথিয়ানরা এক জঘন্য বর্বরতা দেশে দেশে রপ্তানী করেছিল। অন্যসব দেশে তা স্বল্প স্থায়ী হলেও আমরা সভ্য ভারতীয়রা যাদের কাছে গো মাতা নারী মাতার চেয়ে ছিল বেশী মূল্যবান আমরা সেই সহমরণ প্রথাটিকে রেখে দিলাম কয়েক হাজার বছর । আগুনের প্রতি সনাতন এই ভালোবাসা জরথস্তুর পারস্য থেকে আসলেও তবু একটি যুক্তি পাওয়া যেত যে অগ্নী পূজারই এটা অংশ এবং এর মাধ্যমে ধর্ম রক্ষা হচ্ছে । কিন্তু তা ভারতবর্ষে এল পার্সিয়ানদের চির শত্রু সাইথিয়ানদের কাছ থাকে। আমরা যারা বিদেশে পাঠাই শান্তির ধর্ম আর ওরা আমাদের দিয়ে যায় সহমরণের নিষ্ঠুরতা , আর আমরা কত যত্ন করে আমাদের নারীদের জ্যান্ত আগুনে ফেলে দিয়ে তার গুনগান গাই।
যখন সিঁদুরী গিলগামেশকে বলে ” তোমাকে ক্লান্ত ও বিষন্ন দেখাচ্ছে । তুমি ফিরে যাও, আর সামনে যেওনা , সেখানে মৃত্যু সাগর ,কেউ সেই সাগর পার হয়ে উত্নাপিশতিমের কাছে পৌঁছাতে পারেনি ” তখন সিঁদুরীকে আমার একজন প্রাচীন নারী মনে হয়না বরং মনে হয় আপন ঘরের খুব কাছের কেউ , যত্নশীলা , শাশ্বতা স্নেহ ও ভালোবাসার আধার।
নারীকে আমার ফার্নিচার হিসেবে দেখতে ভালো লাগেনা, এর বেশী কিছু বলবো না কারণ আমার কাছে নারী স্বাধীনতা কোন দামাদামির বিষয় নয় ।
যে গাছ ছায়া দেয় তা কেটে ফেললে রোদ খা খা করে, জল দেয় যে নদী তা বাঁধ বেঁধে জলহীন করে দিলে সেখানে থাকে শুধু চর আর চর , শুকনো ও বিরান। বসন্তের গাছে মুকুলের উদগম হয় কিন্তু যে অনুভূতি গুলো মরে যায় ( বা মেরে ফেলা হয় ) তাতে মুকুল খোঁজা কতটা যুক্তিযুক্ত ?
আমার কেন যেন মনে হয় কিছু কিছু মানুষ কেবল মিথ্যে কথা বলে। কোন কারণ নেই । কিছু কিছু মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বা 6th sense খুব সূক্ষ্ণ , তারা চট করে মেকি গুলো ধরে ফেলতে পারে ;আমার ঐ ইন্দ্রীয়টি নেই এবং আমি স্বীকার করছি যে ,এটা একটা সাংঘাতিক অনুভূতি যখন আমার মনে হয়
খুব একজন পরিচিত কেউ মিথ্যে পরিবেশন করে সত্যের সুন্দর ক্যাপসূলে ভরে অতি নিপুন ভাবে। ফাঁসীর আসামী জানে যে তার ফাঁসী হবে এবং সে কিছু করতে পারেনা । আমার কখনো কখনো ফাঁসীর আসামীর মত সময় কাটে। আমার ঘুম আসে না।
আমার শিয়রে তখন স্বদেশ থেকে বিতাড়িত অতি বৃদ্ধ একজন সন্ত এসে দাঁড়ায় , ফিস ফিস করে বলে :”there is no evil out of which some good is not born”.Voltaire.
শাহাব/ এপ্রিল ২১,২০১৬