ফ্লোরিডা থেকে:-


অগ্নি গোলার মত এক নারী আমাকে বললো,”আমার চাঁদে যেতে ইচ্ছে করে”
আমি বলি,” তাই? আমাকে কেউ হাত পা বেধে, মাথা ছালায় ঢুকিয়েও ওখানে নিতে পারবেনা।”
“কেন? চাঁদ এত সুন্দর , আপনি সেখানে যেতে চাননা?”
“সেটাই তো কারণ , আমি চাঁদের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হই, এই আপনার মত কারো মুখের পাশাপাশি সেই চাঁদ হাজার গুন সুন্দর হয়ে ওঠে।”

মানুষহীন চাঁদে শুধু ধুলো আর ধুলো,ন্যাড়া পাহাড়, গাছ নেই , ঘাস নেই, ঘাসফুল নেই, নদী নেই।
আমার নদীকে এই পৃথিবীতে ফেলে আমি পৃথিবীর চাঁদ তো দূরের কথা বৃহস্পতির চাঁদেও যাবোনা।
“বৃহস্পতির চাঁদ আবার কি?”
“ইওরোপা , খুব সুন্দরী এক নারী যাকে জিউস অপহরণ করে নিয়ে চাঁদ বানিয়ে দিয়েছে, সেখানে নাকি জল আছে, প্রানও।”
“নদী কে?”
“এক অর্বাচীন ভালোবাসার নাম”
“নারী , দেশ, প্রকৃতি, ভালোবাসা সব যদি একই বুকের গহীন এটমিক রিয়েক্টরে বসিয়ে দেয়া যায় সেখানে ফিউশন বিভাজন শেষে যে সত্তাটির তৈরী হয়, তার নাম নদী। তাকে পেত্রাকা বলেছে লরা, দান্তে বিয়াত্রিচ আর বিনয় মজুমদার গায়ত্রী।”

“নারী ম্যাগাজনের ” বর্ষপূর্তি হবে , আমরা পাঁচজন বিদগ্ধ ও দ্রোহী নারীকে সম্মাননা দেব , শাহাব তুমি আসো ” – মাসীর ফোন।
( পূরবী বসু )
“হ্যা শাহাব আসো ,আসো” মেশোর প্রতিধ্বনি ( জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত)।
“না মাসী ,পুরো তিন সপ্তাহ বাইরে ছিলাম, মাত্র ফিরে এসেছি, রোগীরা অপেক্ষা করে আছে , পারবোনা।”
আরও একটু কথা বলে ফোন রেখে দিই ।
পরের দিন ইমেইল, “দেখো চেষ্টা করে ,তুমি আসতে পারলে খুব ভালো হতো”
দুদিন পরে টেকস্ট, “আমরা ডেনভার থেকে যাচ্ছি, আরে চলে আসো না ”
প্রিয় জনের ডাকে সময়ে সাড়া দিতে হয়, কারণ সময় বসে থাকেনা।
টিকিট কাটলাম।
ভাবতাম ইট, কাঁচ , গ্লাস, বাতির উঁচু উঁচু টাওয়ারের শহর নিউ ইয়র্ক, কিন্তু ওই টাওয়ার গুলোর চেয়েও উঁচু উঁচু কিছু মানুষ ওখানে আছে। আমার তাদের সাথে দেখা হল।
এই শহরটি বহু মানুষের খুব আপন , এমন কি আমার দুহিতা এই শহরের বাইরে শ্বাস নিতে কষ্ট পায় , অথচ আমি ভুগি শ্বাসহীনতায়। খুব বেশী বড় এই শহর, খুব বেশী কুতুব সারা দুনিয়া থেকে এসে জমেছে এখানে , অথচ এতো সত্যই এই শহর কখনও ঘুমায়না, এই শহর অর্থনীতির চাকা ঘুরায় অহর্নিশি।

২০০১ সালে আমি ম্যানহ্যাটানের মেমোরিয়াল স্লোওন ক্যাটেরিন হাসপাতালে এক সারারাত কোন এক শিশুর সেবা করছিলাম ।সারা রাতই সে মুহুর্ত মুহুর্ত পরে মৃগী রোগে কেঁপে কেঁপে মৃত্যুর সাথে গালগল্প করছিল । ওর মগজটাকে ট্রাম্পলিন ভেবে কিমো ও রেডিয়েশন নন্ রেসপনসিভ একপাল দুষ্ট লুসিফার হৈ রৈ করে যে লাফা লাফি করছিল আমরা তাদের টিকিটিও পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারছিলামনা। ওর মা সারারাতই বিছানার পাশে বসে বসে বাইবেল পড়ছিল ,আর তার চোখের ধারাটি আস্তে আস্তে সেই বাইবেল, তারপরে হাসপাতালের ফ্লোর , তারপরে ম্যানহ্যাটানের রাস্তা পার হয়ে মিশে গিয়েছিল হাডসন নদীতে ।
পরের দিন সকালে যখন ওর চোখ দুটো বুজিয়ে দিলাম ঠিক তখনই হাসপাতালের বিশাল টিভি স্ক্রিন থেকে বের হয়ে এল একটা পেট মোটা ডাইনোসরের মত এরোপ্লেন ,আমাদের মাথার উপরে কয়েক বার চক্কর দিয়ে সেই মৃত শিশুটি বা মন্যুমেন্ট হয়ে যাওয়া মা টির প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে সে হঠাৎ আঘাত করলো আকাশ চুম্বী একটি টাওয়ার এবং তা হুরমুর করে ভেঙে পড়লো আমার যৌবনের এক এক ষষ্ঠাংশ পৃথিবীর জমি জেঁকে থাকা বিশাল তাসের সংসারের মত। এর পরে এল ২য় প্লেনটি অবিকল প্রথমটির মত করে এবং সেও তার হারপূণে বিদ্ধ করলো দ্বিতীয় টাওয়ারটিকে নিপুন দক্ষতায়।
আমি তার ধুলোয় কাশতে কাশতে, শ্বাস নিতে যুদ্ধ করতে করতে, চোখে লু হাওয়ার ক্যকটাসের কাঁটা অনুভব করতে করতে এমন এক দৌড় দিলাম যে জ্ঞান হলে আমাকে আবিস্কার করলাম সাউথ ডাকোটার পবিত্র কালো পাহাড়েদের পাদদেশে এবং দেখলাম লক্ষ কোটি নিহত আদিম আমেরিকানের আত্মা আমার দিকে অপলক চেয়ে আছে। আমি চোখ খুলতেই ওরা সবাই ফিস ফিস করে বলতে লাগলো “সব হত্যাই সমান”, “সব হত্যাই সমান…”
আমি ভাবলাম আমি মৃত।
ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার মৃত কুকুরটি আমার গায়ে এসে ঘষা দিল।
মৃত মানুষ মৃত কুকুরের স্পর্শ কখনই অনুভব করতে পারেনা।


শুক্রবার ২৮ অক্টোবর রাতে পপি চৌধুরী সম্পাদিত “নারীর” সুন্দর অনুষ্ঠানটি হলো। এসে ভালোই হল। এই মহামিলনরের আগুনের পরশমনির ছোয়া প্রানে লেগে প্রান সমৃদ্ধ হল।

নারী নেত্রী ও লেখিকা নুরজাহান কাদের, কথা সাহিত্যিক দিলারা হাশেম,নাট্যভিনেত্রী রেখা আহমেদ, লেখিকা নুরজাহান বোস ও তাহমিনা জামানকে সন্মানিত করা হলো তাদের অবদানের জন্য।
তাদের কথা শুনতে পাইনি, যদিও কাজই সব কথার শ্রেষ্ঠ কথা এবং তারা তা ইতিমধ্যেই দ্বার্থ্যহীন ভাবে বলে দিয়েছেন জগতের আনন্দযজ্ঞ মন্চে । আমার অতি ছোট্ট শহর পর্যন্ত তার প্রতিধ্বনির সবটাই এখনও পৌঁছে সারেনি। কিন্তু এই তো পৌঁছা শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে আসা শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী, এবং আমাদের শ্রদ্ধেয় কথা সাহিত্যক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, পূরবী বসু, চুম্বক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বেলাল বেগ , নারী ম্যাগাজিনের সম্পাদিকা পপি চৌধুরী সহ নিউ ইয়র্কের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাথে দেখা হল। এরা প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন । এমন এক দল মানুষের উপস্থিতিতে কাটল এক অনবদ্য সন্ধ্যা।

আমি একজন দিনক্ষণ ও দিকহীন প্রজাপতি প্রেমিক। যখন নারীরা সুন্দর সেজে সুন্দর হাসির বিভায় চারিদিক আলোকিত করে দেয় আমি তাদের চোখে তাকিয়ে দেখি বাংলার বিস্তীর্ণ প্রজাপতির মাঠ এবং আমি তন্ময় হয়ে পথ হারিয়ে ফেলি। এই রোগ আমাকে কোনদিন ছাড়লোনা। আমি “নারীর” উৎসবে এসে আবারও প্রজাপতির মাঠে হারিয়ে গেলাম।
কিন্তু নারী কি শুধুই প্রজাপতি ? আর কিছু নয়?
সত্যকে স্বনামে ডাকাই ভালো :রাহুল সাংকৃত্যায়নের “গঙা থেকে ভোলগা” তীরের পুরুষের দৃষ্টি দিয়ে দেখলে নারী আসলে অপরূপ ও অনিন্দ্য পাখনার প্রজাপতিই । এবং আমরা হয়তো ওই নদী গুলোর তীর বদলিয়ে অন্যসব নদীর তীরে গিয়েছি কিন্তু দৃষ্টি সেই শ্বাপদ অরণ্য অতিক্রম করতে পেরেছে কি?
আসলেই কি নারী শুধু প্রজাপতি?


“কেমন আছেন?”
“আমার কি খারাপ থাকার সময় আছে?”
হাসি ।
সেই হাসির প্রতিধ্বনী ফ্লোরিডায় শুনতে পেয়েছিলাম । এই প্রথম সামনা সামনি শুনলাম সেই একই হাসি , যা উন্মুক্ত আকাশে মুক্ত ইকারুশের হাসির শব্দের মত ইথারে ইথারে বিদ্রুত হয়ে বাংলার মাঠে ঘাটে বাতাসে অনুরনণ তুললো “জয় বাংলা ” ।

এই “জয় বাংলা ” আমাদের সবার মুখে ফেনা তুলে যে শ্লোগান , তা নয় । এই “জয় বাংলা ” হল একটি জীবন দর্শন , বাংলার গ্রাম থেকে উঠে আসা ইওরোপের রেনেসা পূর্ব যে বিশ্ব মানবতার মেনিফ্যাস্টো :
“সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই ” সেই সত্যের অন্তর্নিহিত অর্থটি নিয়ে শেখ মুজিবের অপরাজেয় কবিতার জয় বাংলা।

বেলাল বেগ তার পৃথিবীর সমান বিশাল বুকটিতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন , “বাহ্ ,আপনি তো আমার মত দেখতে!”
আসলে বেলাল বেগের চোখে তারই মত দেখতে মানুষের অভাব হবার কথা নয়, কারণ অন্য মানুষ হলো তার সামনে আয়নার মত, তিনি সেই আয়নায়
তাকিয়ে তারই প্রতিবিম্ব দেখতে পাবেন এই স্বাভাবিক ।

আমি নিৎসে- জরাথুস্তুর বনে বনে থাকি । ঘাস, পাখী, ঘোড়ার কথা বুঝি কিন্তু মানুষের কাছে সেই কথা পৌঁছাতে পারিনা। মানুষ আমার কথা বুঝতে পারেনা। আমার বোধ নেই, আমার ভাষা নেই। শুধু আমার ঘাড়ের মাংস পেশীগুলো শিথিল হয়ে আসে বিরাটের সান্নিধ্যে এলে এবং এবার নুয়ে এল মাথাটি বিশাল শিশু , সাত্বিক এই ব্যক্তিত্বের কাছে ।

অনুষ্ঠান হলো, সম্মাননা প্রাপ্তদের কীর্তি ও কৃতিত্বের কথা জানলাম, গান বাজনা , কবিতা আবৃত্তি হল।
যে মানুষ গুলো আলো ছড়ায় , যে মানুষ গুলোর রয়েছে অনিন্দ্য অভিকর্ষন আমি তাদের অপটিক ইলেক্ট্রো- ম্যাগনেটিক বলয়ে ভারশূন্য একটি অনিন্দ্য সন্ধ্যায় কিছু স্বর্ণকণা কুড়িয়ে বেরিয়ে এলাম মধ্যরাত ছুঁই ছুঁই করে।

শেষাংশটুকু ২য় পোস্টে দেখুন


শনিবার রাতে ছিল শব্দগুচ্ছ পত্রিকা ও কবি হাসানাল আবদুল্লাহ ও নাজনীন সিমন আয়োজিত কবি শহীদ কাদরী ও সৈয়দ শামসুল হক স্মৃতি সমাবেশ। নিউ ইয়র্ক শহরে কবি শহীদ কাদরীর স্মৃতি অনেক। নিউ ইয়র্ক শহর তাকে মিস করবে। আসলে মিস করবে সমস্ত বিশ্ব সংসার। তাকে নিয়ে হলো অনেক আলোচনা ,অনেক স্মৃতিচারণ।

আলোচনার আলপথ বেয়ে এলেন সৈয়দ শামসুল হক। তিনিও চলে গেলেন আমাদের পরানের গহীন ভিতর। আমি তাকে একবারই মাত্র দেখে ছিলাম কাছ থেকে এই বছরের একুশে ফেব্রুয়ারীর সাহিত্যানুষ্ঠানে । তার চুম্বক বক্তব্য আমাকে মুগ্ধ করেছিল । প্রথম দেখা প্রথম চেনা নয়, যদিও প্রথম দেখা কখনও কখনও শেষ দেখা হয়।

বাংলার দুই বিরল প্রতিভা; চলে গেলেন , তাই লোকে বলে, অথচ আমার মনে হল তারা আমার ঘাড়ের পেছনে বসে শ্বাস নিচ্ছেন এবং আমি তা শুনতে পাচ্ছি । আমার এমন হয় , প্রায়শই, চলে যাওয়া সৃজনশীল মানুষ গুলোর আত্মা আমার মনের গহীন গাঙে স্নান করে , সাঁতরায় , হাসে , কথা কয়।

বাংলা যতদিন শ্বাস নেবে তারা কি বাংগালীর আড্ডার বাইরে থাকতে পারবেন ? সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ, কৌশিক আহমেদ, বেলাল বেগ, কবি হাসানাল আবদুল্লাহ, নাজনীন সিমন, শামস আল মমিন, পূরবী বসু, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও অন্যেরা স্মৃতি চারণ করলেন।

ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ বলেই উঠে এসেছে কত অজানা মানবিক স্মৃতি ! মানুষের গল্প হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গল্প! শ্রেষ্ঠ মানুষের গল্প আরও সুন্দর!

কবিতা পড়লেন কবি ধনন্জয় সাহা, লুবনা কায়জার, কাজী আতিক আরও কেউ কেউ। নাট্যাভিনেত্রী লুৎফুন্নাহার লতা অদ্ভুত মমত্বের ধ্বনি প্রতিধ্বনী দিয়ে ইথার পূর্ণ করে পাঠ করলেন নুরুলদীনের সারাজীবনের অংশ বিশেষ।
তারপরে এল গান, শফি ভাই এবং আরও কয়েকজন কানায় কানায় পূর্ণ করে দিলেন সেই সন্ধ্যা-বাটি।


মেধা ও বন্যতার সংমিশ্রণে পিতৃহীন তিক্ত মধুর ইন্দ্রনাথীয় যে জীবন, তার সৃষ্টি আবু রায়হান। তার কথাসাহিত্যিক না হয়ে উপায় কি? তুঁতে বা চিরতা চিপড়ে মধু বের করায় তার চেয়ে বেশী মুন্সীয়ানা কে দেখাতে পারে? তাই তার “বসত পারের নিউইয়র্ক”, “নিউইয়র্ক বসতি”, “প্যারেড নগরী”, “রমনা মেইল”, “রাজা দরশন” প্রতিটি বই হয়েছে স্বকীয়তায় ভাস্বর ! শনিবার দিনটিতে আবু রাহয়ান তার যত কাজ ব্যাগে পুরে জিপার বন্ধ করে গাড়ীর ট্রান্কে তুলে রাখলেন।
তারপর আমাকে নিয়ে গেলেন টুইন টাওয়ারের ধংসস্তুপে গড়ে ওঠা ফ্রিডম টাওয়ার দেখাতে, না সেই যে শিশুটিকে আমরা সেই রাতে রক্ষী করতে পারিনি, সেই যে অগুনিত মানুষের লাশের উপর দিয়ে বিষাক্ত ধোয়া উড়ছিল , তারপরে আমি আর ওখানে যাইনি, ইচ্ছা করেনি । ব্যাটারী পার্কের পাশ ঘুরে ব্রুকলিন ব্রিজ পার হয়ে আবু রায়হান আমাকে নিয়ে গেলেন এক শপিং সেন্টারের ছাদ পার্কিং( রুফ টপ) এ ।
এক চাইনিজ রেস্টুরেন্টে লান্চ সেরে বসলাম যেয়ে
গাড়ীতে । ওখান থেকে আকাশ ও ইমারতের আলিঙ্গনাবদ্ধ শহরের দিকে তাকিয়ে আমার উন্মন হওয়ার কথা ছিল কিন্তু কবি রায়হান তার ব্যাগ থেকে একটি চকচকে তীক্ষ্ণ ছুরি বের করে আমার বুকটিকে চিরে ফেললেন । পৃথিবীতে অনেক ছুরি আছে, কিন্তু এই ছুরির দ্বিতীয়টি নেই কারণ এটি তারই তৈরী। (পুঁথি পাঠের আসর, আবু রায়হান)।


মহানবী যখন মক্কা ছেড়ে মদীনায় যাচ্ছিলেন তার কন্ঠে নাকি ছিল স্বর্গীয় আয়াত এবং তাকে ধাওয়া করছিল যে কুরাইশ যুবক ,সে যতই কাছে এগিয়ে আসছিল তার নাঙ্গা তলোয়ার হাতে ,ততই তার বুকে জমাট হয়ে থাকা হাজার বছরের সংস্কৃতি, কুসংস্কার ও বিশ্বাসের পাথরটি আস্তে আস্তে গলতে শুরু করেছিল। বরফ যখন গলে তাতে বিস্ময়ের কিছু থাকেনা, পাথর যখন গলে তাই হয় বিস্ময়কর ইতিহাস। আমি অপূর্ব সেই প্রাচীন কিন্তু চিরায়ত কন্ঠটির মতই শুনতে পেলাম একটি কন্ঠ , সেকি আলাওল, আমির হামজা না অন্য কেউ বুঝে উঠতে পারলামনা।

যখন বোধ ও অবোধের মাঝখানের সীমারেখা বিলীন হয়ে যায় তখন চোখে হয় অপার্থিব গঙার বর্ষণ, আর মহাদেব কি সব গঙার ধারা জটা জালে বেধে রাখতে পারেন?
আমার চোখ থেকে ঝর ঝর করে ঝরে পড়লো অনুভূতি , আমি বাংলাকে কতটুকু জানি ? কতটুকু ভালোবাসি?
যেই বাংলার কিশোরীকে রেখে এসেছি অগ্নীসমা, সে এখন যৌবন যাই যাই নারী , যে শিশুকে রেখে এসেছি এক্কা দোক্কা খেলার মাঠে সে এখন জীবন যুদ্ধের হলুদ শর্ষের ক্ষেতে গড়াগড়ি যায়।

সেই কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে ছেড়ে আসা গ্রামীন সৌন্দর্যের সুষমার দেশ এখন উন্নতি, নগরায়ন, হিংসা, সংকীর্ণতা, গোঁড়ামি, ও পাশবিকতার ক্ষয়-কাশি রক্ত-কফে জর্জরিত।


মাটি ও আকাশের মাঝখানের পার্কিংএ গাড়ীতে বসে, শত সহস্র প্রান হীন গাড়ীর নৈশব্দ ভেদ করে আমি চলে গেলাম আবহমান বাংলার ভুতুরে রাতের গ্রামে , যেখানে গোল হয়ে বসে আছে আলাওল, দৌলত উজির, আমির হামজা , শাহাব আহমেদ , তার পিতা, তার বড় ভাই, মেঝো ভাই, কাকা, খালু আর কত কত মানুষ আর একজন আবু রায়হান পাঠ করে চলেছেন পুঁথি । তার কন্ঠে ভেসে আসছে দূর থেকে । স্বর্গে থেকে ঈশ্বর বেড়াতে বেরিয়েছেন, ভুলে গেছেন দরজাটি বন্ধ করে যেতে , মৃদু হাওয়ায় সেই দরজা আধা বন্ধ হয়েও যে ফাঁকটুকু রয়ে গেছে সেই ফাঁক গলেই আসছে কন্ঠ , আবু রায়হানের কন্ঠ আর আমাদের চোখ গুলো ঝর ঝর করছে।

আমি কি চাঁদে যেতে চাই?

না, যেখানে বাংলার হৃদয়ের গল্প নিয়ে পুঁথি পাঠ মানুষ ভুলে গিয়েছে আমি সেই বাংলায় ফিরে যেতে চাই শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক, আবু রায়হান ,বেলাল বেগ, সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ, পূরবী বসু, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের মত হাজারো মানুষের খোঁজে।

অক্টোবর ৩০,২০১৬
শাহাব আহমেদ

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন