আমাদের এবারের ডেস্টিনেশন উইটলি প্রভিন্সিয়াল পার্ক। দলের সদস্য সংখ্যা প্রতিবারের চাইতে বেশী। এবার আমরা ২৩ জন। দলের সাথে আছে নতুন দু’টি ফ্যামিলি, একটি মরিশাস থেকে আসা আরেকটি এখানকার বাঙালী ফ্যামিলি। আর অতিথি হিসেবে আছে বাংলাদেশ থেকে আসা ৩জন সদস্যের একটি দল। এদের সবাইকে মিলিয়ে দলের পরিধি প্রতিবারের চাইতে অনেক বড়। উইটলি প্রভিন্সিয়াল পার্ক অন্টারিওর দক্ষিন-পশ্চিম পাশে লেক ইরির পাড়ে অবস্থিত। টরোন্টো শহর থেকে পার্ক এর দূরত্ব প্রায় ৩৩০ কিলোমিটার। ড্রাইভিং ডিস্ট্যান্স প্রায় ৩ ঘন্টা ১৫ মিনিট। ২৪১ হেক্টর জমির নিয়ে এই পার্কটি। এই পার্কটিতে ৪টি ক্যাম্প-গ্রাউন্ড আছে। Highlands, Boosey Creek, Middle Creek আর Two Creeks camp ground। টোটাল ক্যাম্প-সাইট আছে ২২০টি। ইলেক্ট্রিক ক্যাম্পসাইট আছে ৯৬টি, গ্রুপ ক্যাম্পসাইট আছে ২টি। এছাড়া পার্কটিতে আছে একটি ডে-পিকনিক এরিয়া, আর ডে-পিকনিক এরিয়ার সাথে জুড়ে আছে ২ কিলোমিটার লম্বা একটি স্যান্ডি বিচ। ক্যাম্পটির এ্যাকটিভিটির মধ্যে আছে হাইকিং, ক্যানুইং, সুইমিং, ফিশিং, বাইকিং আর বার্ড ওয়াচিং এর সুবিধা।
সব প্রস্তুতি শেষে অবশেষে এলো আমাদের সেই কাংখিত যাত্রার দিন। সকাল ন’টায় সবাই হাজির হলো আমার বাড়িতে। পরবর্তী ১ ঘন্টায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষে আমাদের যাত্রা শুরু হলো সকাল ১০টার একটু পরে। সবাইকে একটি করে রুটম্যাপ এর কপি দেওয়া হলো আর যাত্রাবিরতির একটি স্থান নির্ধারন করে দেওয়া হলো।
নির্দিষ্ট স্থানে যাত্রা বিরতির পরে দুপুর দুটোর দিকে আমরা আমাদের ক্যাম্প গ্রাউন্ডের গেটে পৌঁছলাম। রেজিস্ট্রেশনের নিয়মাবলি শেষ করে আড়াইটার দিকে আমাদের নির্ধারিত ক্যাম্পসাইটে পৌঁছালাম। আমাদের সাইটে ইতোমধ্যেই রেন্টাল কাম্পানী দুটি ট্রেলার স্থাপন করে দিয়ে গেছে, এই দুটি ট্রেলারের একটি মহিলা ও শিশুদের জন্য আরেকটি মরিশাস থেকে আসা ফ্যামিলির জন্য। বাকি দুটি সাইটে আমরা আমাদের টেন্টগুলি খাটিয়ে নিলাম।
দুপুরে খাবার পর আমরা বেরিয়ে পড়লাম আমাদের পার্কটি ঘুরে দেখতে। ঘুরলাম ডে-পিকনিক এরিয়াতে, বিকেলের সময়টা কাটালাম ফুটব্রিজের ওপর আর বিচে ঘুরে। অনেকে পানিতেও নামল। সূর্যাস্তের আগেই ফিরে আসলাম ক্যাম্পে। এবার শুরু হলো সবার প্রিয় ক্যাম্প ফায়ার। আর একপাশে আমাদের প্রিয় হুমায়ুন ভাই শুরু করলেন আমাদের ডিনারের প্রস্তুতি তার BBQ। এই বিষয়ে হুমায়ুন ভাই আমাদের স্পেশালিস্ট, তাই এই দায়িত্ব সবসময় উনিই পালন করেন। সেই সাথে চলতে থাক জমজমাট আড্ডা। এ আড্ডা চলল মধ্যরাত পর্যন্ত।
এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, রাত ১১টার পর শুরু হয় “কোয়ায়েট টাইম” বা “নিরব সময়”। অর্থাৎ, রাত ১১টার পর বাইরে কোনোরকম জোরে আওয়াজ করা যাবে না। আপনি বাইরে থাকতে পারবেন, তবে কথাবার্তা আস্তে বলতে হবে, যাতে আপনার পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পারদের কোনো অসুবিধা না হয়। এটাই এখানকার একটি নিয়ম।
পরেরদিন আমাদের প্রোগ্রাম পার্শ্ববর্তী শহর ঘুরে দেখা। যারমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল উইন্ডসর শহর। এটি ডেট্রয়েট নদীর পাড়ে অবস্থিত। ডেট্রয়েট নদীর এক পাড়ে কানাডার উইন্ডসর শহর, অন্য পাড়ে আমেরিকার ডেট্রয়েট শহর। আর এই দুই শহরকে যুক্ত করেছে একটি সেতু এই ডেট্রয়েট নদীর ওপর দিয়ে। আমরা সারাদিন পার্কে পার্কে কাটালাম এবং সাথে করে আনা খাবার দিয়ে দুপুরের লাঞ্চ শেষ করলাম।
বিকেলে ফেরার পথে থামলাম সিডরক্রীক বীচে। সিডরক্রীকে অনেক্ষন সময় কাটাবার পরে অনেকেই গোছল করল, তারপর সূর্য্যাস্তের আগেই ফিরে আসলাম ক্যাম্পগ্রাউন্ডে। এরপর সন্ধ্যায় যথারীতি BBQ, ক্যাম্পফায়ার আর আড্ডা চলল প্রায় রাত দেড়টা পর্যন্ত।
তৃতীয়দিন আমাদের কর্মসুচীর প্রধান ছিল পয়েন্টপীলি ন্যাশনাল পার্ক। এটি কানাডার মূল ভূখন্ডের দক্ষিনের শেষ সীমানা। ১৯১৮ সালে এটিকে ন্যাশনাল পার্ক হিসাবে সংরক্ষনের ঘোষনা দেওয়া হয়। সকাল থেকে হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। তা সত্বেও বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আমরা সময়মতই বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের ক্যাম্পগ্রাউন্ড থেকে এই পার্কটির দূরত্ব মাত্র ২০ কিলোমিটার। আজ অবশ্য আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে টরোন্টো থেকে গতরাতে আসা আরো ৮ জন। এখন আমাদের সদস্য সংখ্যা সব মিলিয়ে ৩১ জন।
বৃষ্টি উপেক্ষা করেই আমরা চলতে লাগলাম। হেঁটে হেঁটেই পৌঁছে গেলাম কানাডার মূল ভূখন্ডের দক্ষিন প্রান্তের শেষ সীমানায়। লেক ইরিতে কিছুটা সময় কাটানো অনেকেই বেশ উপভোগ করল। যদিও লেক ইরির পানি ছিল উত্তাল। প্রচন্ড ঢেউ, তাই পানির কাছে যাওয়া ছিল বিপদজনক, এব্যাপারে আগে থেকে সতর্কবানী দিয়েছিল পার্ক কর্তৃপক্ষ।
এরপর আমরা আসলাম মার্স ব্রডওয়াকে। এটি ১ কিলোমিটারের একটি LOOP। হেঁটে আসতে ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট সময় দরকার। এখানে আছে ক্যানুইং এর ব্যাবস্থা। বাচ্চাদের মধ্যে অনেকেই ক্যানুইং করল। অনেকেই ব্রডওয়াকে । চারিদিকে বাংলাদেশের মত কাশবন। এ এক অপূর্ব সৌন্দর্য্য। ব্রডওয়াকে হাঁটার পরে আমরা চলে আসলাম ব্লাক উইলো বিচে। এখানে আমরা সাথে করে আনা খাবার দিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করলাম। অনেকে পানিতে নামল। বিকেল সাড়ে ৪টা নাগাদ ক্যাম্পে ফিরলাম।
বিকেলের চা-পর্ব শেষ করে, এবার খোকন ভাইয়ের সাথে আমাদের ৪ জনের একটি ছোট্ট দল ফিশিং এর জন্য হারবারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। খুব একটা দূরে নয়, ১০ মিনিট ড্রাইভের পরেই আমরা পৌছুলাম নির্দিষ্ট ফিশিং স্পটে। কিন্তু ভাগ্য আজ সুপ্রসন্ন ছিলনা। তাই প্রায় ২ ঘন্টার চেষ্টা শেষে খালি হাতেই ক্যাম্পে ফিরলাম সন্ধার আগে আগে।
আজ রাতের ক্যাম্প ফায়ারটা আরো জমজমাট। কারন আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছে টরোন্টো থেকে গতরাতে আসা নতুন টিম এর সদস্যরা। রাত প্রায় দুটো পর্যন্ত জমিয়ে আড্ডা দিলাম। তারপর যার যার টেন্টে ফিরলাম, কারন কাল সকালেই আমাদের ফিরে যেতে হবে।
আজ সকালটা অন্য রকম। আজকে ফিরে যাবার পালা। সকালে উঠেই সব জিনিষপত্র গুছাবার কাজ শুরু হয়ে গেল। ক্যাম্প সাইট থেকে সবগুলো টেন্ট খুলে নেওয়া হলো, গুছিয়ে ফেলা হলো। ব্রেকফাস্ট শেষে সকাল সাড়ে ১১টায় আমরা ক্যাম্প গ্রাউন্ড ছাড়লাম। আমাদের গাড়ীর বহরে তখন ৭টি গাড়ির কাফেলা। একসাথে চলছি সবাই, প্রথম যাত্রাবিরতী নিলাম লুটনের কাছে Onroute। তারপর আবার চলার শুরু। পরবর্তী যাত্রাবিরতী হলো ডোভার কোর্ট বীচ। বিকেল সাড়ে ৪টা নাগাদ যখন বিচে পৌঁছলাম তখন সেখানে বসার জন্য কোনো যায়গা খালি ছিলনা। কারন অন্টারিওর বিচগুলোর মধ্যে এটি একটি জনপ্রিয় বিচ।
তাই বাধ্য হয়েই পার্শ্ববর্তী একটি পার্কে বসে আমরা লাঞ্চ সারলাম। লাঞ্চের পরে অনেকেই ফিরে গেল বিচে, ঘুরলো বেড়ালো। তারপরে আবার ফেরার পালা। শুরু হলো ফিরতি পথে যাত্রা, বাড়ির উদ্দেশ্যে। সূর্যাস্তের আগেই বাড়ী ফিরলাম। শেষ হলো আমাদের ক্যম্পিং-২০১৫।