নওগাঁ যাওয়ার পথে আমাদের ঢাকা-নওগাঁ বাসটি সাময়িক বিরতি নেয়ার জন্যে ফুডভিলেজে থামতেই হুড়মুড় করে যাত্রীরা বাস থেকে নেমে যাচ্ছে। কেউ বা অনেক্ষন সিগারেটের নেশা চেপে রেখেছিলেন তাই বাস থেকে নেমেই সিগারেট ধরিয়েছেন, কেউ বা চা এর নেশায় রেস্টুরেন্টের উপর তলায় যাচ্ছেন। আমি যথারীতি ছোট বাথরুম চাপায় মিতাকে রেস্টুরেন্টে বসিয়ে রেখে বাথরুমের দিকে ছুটলাম। এক দিন আগেই প্রায় সাত বছর পরে দেশে ফিরেছি। সারা রাস্তা প্রাণ ভরে গ্রামবাংলার নজরকাড়া দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে প্রায় গন্তব্যের কাছাকাছি চলে এসেছি মনেই হয়নি ।

ফুডভিলেজের রেস্টুরেন্টে আগেও যাত্রাপথে অনেকবার থেমেছি। এবার দেখলাম, অল্পবয়সী কিশোর ছেলেরা ইউনিফর্ম পরে খাবার টেবিলে দৌড়ে দৌড়ে যেয়ে অর্ডার রিসিভ করছে, পরম যত্নে খাবার সার্ভ করছে। একেকজন নানরুটি দিয়ে মাংস খাচ্ছে, ডাল খাচ্ছে। টাটকা খাবারের সেসব বাটি থেকে ধুঁয়া উঠছে। কেউ বা পরম তৃপ্তি নিয়ে বগুড়ার দই খাচ্ছে। কেউ বা চায়ে চিনি বেশি দেয়া হয়েছে বলে যে কিশোরটি চা সার্ভ করেছিল তাকে ধমক দিচ্ছে। ম্যানেজার সাহেবের প্রচন্ড ব্যাস্ততা। বিশেষকরে ঢাকা-উত্তরবঙ্গের বাসগুলো যখন যাত্রাপথে এখানে সাময়িক বিরতি নেয়, তখন এই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারসহ সবার ব্যাস্ততা হাজার গুনে বেড়ে যায়, দম ফেলার সময় থাকে না। পাঠক, আপনারা যারা বাবা দিবসের সময়ে আমার গল্পের হেডিং দেখে আমার গল্প পড়া শুরু করেছেন, নিশ্চয় ভাবছেন এক বাবার গল্প বলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমি ফুডভিলেজ রেস্টুরেন্টের বর্ণনা শুরু করলাম কেন। পথে-ঘাটে, যেমন ঔষুধ বিক্রেতারা সাপের খেলা, ম্যাজিক ইত্যাদি দেখিয়ে ঔষুধ বিক্ৰী করেন, তেমনি লেখকদেরও পাঠকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য অর্জনের জন্যে ইনিয়ে বিনিয়ে গল্প শুরু করতে হয়।

তো যা বলছিলাম, আমি এগুচ্ছি ফুডভিলেজের রেস্টুরেন্টের বাথরুমের দিকে। বাথরুমের প্রধান দরজা পার হতেই দেখলাম একজন মাঝবয়সী লোক বাথরুমের মেঝে ধোয়া -মোছা করছেন। প্রচন্ড গরমে ও পরিশ্রমে লোকটির মুখাবয়ব তামাটে রং ধারণ করেছে। বয়সের তুলনায় কপালে ভাল কয়েকটি ভাঁজ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেই কপাল থেকে ঘাম টপ টপ করে পড়ছে। রেস্টুরেন্টের ভিতরে এসি থাকার কথা থাকলেও তা কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না। লোকটার পরনে ঢিলেঢালা ঘিয়ে রঙের একটি প্যান্ট ও নীল রঙের শার্ট। পোশাক দেখেই মনে হচ্ছে, যে প্রতিষ্ঠান থেকে লোকটিকে এই পোশাক দেয়া হয়েছে তারা লোকটির শরীরের সঠিক মাপ নেয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেননি। হয়তো কে জানে, অন্যান্য বিষয়াদির মতো পোশাক-আশাকের ক্ষেত্রেও আমাদের ভদ্র সমাজ ঠিক করে রেখেছে কোন শ্রেণীর কর্মচারীদের ক্ষেত্রে যত্ন-আত্তি করে মাপযোগ নিতে হবে আর কাদেরকে অবজ্ঞা করতে হবে।

তিনি এক মনে নিবিষ্ট চিত্তে তাঁর থেকে কিছুটা লম্বা একটি কাঠের লাঠির মাথায় থাকা ব্রাশ দিয়ে বাথরুমের মেঝে ঘষে যাচ্ছেন। তাঁর পাশেই রাখা হয়েছে ছোট একটি বালতি। একটু পর পর তিনি তাঁর হাতে ধরা সেই লাঠির মাথার ব্রাশটিকে সেই বালতিতে চুবিয়ে নিচ্ছেন, আবার সেই একই কাজের পুনরাবৃত্তি। এই যে কত লোক রেস্টুরেন্টের টেবিলে আড্ডার ঝড় তুলে কফি খাচ্ছে, যাত্রাপথের অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে নানান বিষয়ে যুক্তি তর্ক করছে, তাড়াহুড়া করে কাস্টমারের কাছ থেকে এটো থালাবাটি নিয়ে যাওয়ার সময় অসাবধানতাবশত কোনো এক হোটেল বয় একটি কাঁচের ক্লাস ভেঙেছে বলে ম্যানেজার সাহেব সমানে ধমকাচ্ছে, এসবে লোকটির কোনো ভাবান্তর নেই। তিনি মাথা নিচু করে বাথরুমের মেঝের দিকে একই ভঙ্গিমায় একই মেজাজে ঘষে যাচ্ছেন। আমি কয়েক সেকেন্ড মাত্র সময় নিয়ে বাথরুমে যাওয়ার পথে লোকটিকে দেখে বাথরুম সেরে ফেরার পথে লোকটির একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম।

সালাম দিতে যেয়ে ভাবলাম, আগে নাম জেনে নেই, কে জানে কোন ধর্মে বিশ্বাসী। আমি ঠোঁটের কোনায় সামান্য ভদ্রতার হাসি বজায় রেখে বললাম, ‘মুরব্বি, আপনার নাম কী? তিনি কিছুটা হকচকিয়ে আমার দিকে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন। আমি সেই দৃষ্টির সামনে জ্বলে-পুড়ে ছাইভস্ম হয়তো হলাম না, তবে আমার বিবিকের কাছে দায়বদ্ধতা থেকে কেমন যেন খচ খচ করতে লাগল। এই যে আমরা ‘বৈষম্য’ ‘বৈষম্য বলে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করে সারা দেশ তোলপাড় করছি, ইনি সেই শ্রেণীর প্রতিনিধি হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। অনাভ্যস্ত ভঙ্গিমায় কাচুমাচু মুখ করে এবার তিনি তাঁর নাম বললেন, ‘হামার নাম চাঁন মিয়া’। হয়তো জন্মের সময় চাঁদের ন্যায় উজ্জ্বল চেহারা নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছিলেন অথবা সংসারের নানান দুঃখকষ্ট দূর করে সংসারকে আলোকিত করে তুলেছিলেন বলে বাবা-মায়ে শখ করে নাম রেখেছেন চাঁন মিয়া। আমি সবে প্রবাস থেকে এসেছি। কানাডিয়ান ডলার ভেঙে দেশের টাকাপয়সা দিয়ে পকেট ভর্তি করে রেখেছি। পকেট হাতড়িয়ে দুশো টাকার একটি নোট লোকটির দিকে এগিয়ে দিতে দিতে ভাল করে লক্ষ্য করলাম, এটি আসলে দুশো টাকা না, দুহাজার টাকার নোট। অনেক বছর পরে দেশে এসেছি বলে আমি টাকা চিনতে ভুল করে ফেলেছি। আমি একটু দ্বিধায় থেকে তবুও সেই দুহাজার টাকার নোটই তাঁর হাতে ধরে দিলাম। এবার তিনি ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেললেন।

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বললাম, ‘কাঁদছেন কেন?’ কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন, ‘বাবা, হামার ছোট বেটি আজ কয়দিন ধরে গোস্ত দিয়ে ভাত খাবার বায়না ধরছে কনতো, হামরা গরিব মানুষ হামরা কী গোস্ত কিনবার পারি ? কাল আত্রে (রাতে) ছোল হামার কান্দাকাটি করে ঘুমাছে। ছোলের মাও হামাক কোলো, বাপ হোছ, বেটির সাধ-আল্লাদ মেটাবার পারো না ? আজ হামি ওজা (রোজা) থ্যাকা ফজর নামাজ পরে আল্লাহর কাছে ক্যানদে ক্যাটা কছি (বলেছি), আল্লাহ হামার বেটির মনের আশা পূরণ করে দেও। আল্লাহ হামার কতা (কথা) শুনছে।

রহস্যে ঘেরা এই পৃথিবীতে কত ঘটনায় না ঘটে। হয়তো চাঁন মিয়াকে ভুল বশতঃ এই যে দুহাজার টাকা দিলাম, এটি একটি কাকতলীয় ঘটনা অথবা সৃষ্টিকর্তার কোনো খেয়াল। আমি সেই খেয়ালের কথা না ভেবে, সেই রহস্যের কথা না ভেবে চাঁন মিয়ার মুখের অবয়বে ফুটে ওঠা একটি তৃপ্তিময় বাবার মুখের কথা ভাবছি। সন্তানের মুখে সামান্য কয়েকটি মাংসের টুকরা তুলে দেয়ার আনন্দিত এক শ্রমিক বাবার মুখের কথা ভাবতে ভাবতে বাবা দিবসের গল্পের প্লটের কথা ভাবছি। অনেক অনেক চাঁন মিয়া, অনেক অনেক বাবা আমাদের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বিচ্ছিন্নভাবে আমাদের একেকটি সাহায্য, সহযোগিতা একেকটি চাঁন মিয়ার মুখে সাময়িক প্রশান্তি এনে দিলেও আমরা কী একটি সিস্টিমের কথা ভাবতে পারি না যে সিস্টেমে চাঁন মিয়াদের মুখে স্থায়ী প্রশান্তি লেপ্টে থাকে ???

পরিশিষ্ট : আমি উপরে আমার গল্পের শেষ অংশে যে সিস্টেমের কথা বলেছি সেটি আপনে, আমি সবাইমিলে গড়তে পারি। যখন এই গল্পটি আমি লিখছি তখন আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান জনাব ইউনুস সাহেব লন্ডনে জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের সাথে বৈঠক করে নির্বাচনের তারিখের মোটামুটি একটি ফয়সালা করে ফেলেছেন। হয়তো অতিশীঘ্রই দেশে নির্বাচনের ডামাডোল বেজে উঠবে, নমিনেশনের বেচাকেনা হবে। রাজনীতিবিদগণ মহাসমারোহে চমৎকার মুখরোচক কথা বলে দেশের মানুষদের মন জয় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। আমরা লেখক, রাজনীতিবিদ নই। তবুও আমরা আমাদের আশেপাশের ছড়িয়ে থাকা চাঁন মিয়াদের প্রশান্তির মুখচ্ছবি দেখতে মুখিয়ে থাকি। তাই, বাবা দিবসের অছিলায় এক বাবার গল্প ফেঁদে ফেললাম। আসন্ন নির্বাচনে আমরা ট্রেডিশন্যাল মার্কা না দেখে আসুন প্রকৃত ভালোমানুষ, সৎ মানুষদের নির্বাচন করি। একটি সত্যিকারের বৈষম্যহীন সমাজ গড়ি।

এই জগতের আনাচে কানাচে সর্বত্র প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ হয়ে উঠুক ‘বাবা দিবস’!!!

 

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারীর সমান অধিকার
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন
জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন (জন্ম: ১৯৬৬ ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন কর্মী হয়ে দেশীয় ও আন্তজার্তিক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী শুরু করেন এবং তখন থেকেই লেখালেখিতে মনোনিবেশ। তবে লেখালেখি শুরুটা ছিল সেই হাইস্কুল জীবনে পাড়ার বড় ভাইদের প্রকাশিত ম্যাগাজিন 'অবসর' নামক পত্রিকার মাধ্যমে। ২০০৩ সালে কানাডায় সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে, আবারও পড়াশুনা, প্রথম Humber College থেকে সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা, পরে University of Guelph থেকে ফ্যামিলি & কমিউনিটি সোশ্যাল সার্ভিস বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবারও উন্নয়ন কর্মী হিসাবে রেজিস্টার্ড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি টরেন্ট ভিত্তিক বিভিন্ন অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর করছেন । লেখকের কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক গল্পপ্রবাসী ব্লগ, কানাডা ভিত্তিক একটি সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকায় এবং মাসমিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পরে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় লেখকের তিনটি বই হোমলেস, সিঙ্গেল মাদার, জোসনা ম্যানশন উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয় । বর্তমানে হাউজ হাজব্যান্ড নামে লেখকের আরেকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক কে উপন্যাস হিসাবে ২০২৪ সালের ঢাকা একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের একটি জনপ্রিয় গল্প 'শেকড়' ২০২১ সালে বাংলাদেশের বুকল্যান্ড প্রকাশনা থেকে ৫০ লেখকের ভাবনা নিয়ে পঞ্চাশে বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প/উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও খেলাধুলা নিয়েও লেখকের অনেক লেখা রয়েছে।

আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন